নিজস্ব প্রতিবেদক *
মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানির ঘটনা এদেশে নতুনকিছু নয়। কারা এসব করে তা ওপেন-সিক্রেট হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথারীতি থাকে রহস্যজনকভাবে নীরব। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করছে দীর্ঘকাল ধরে আর সরকার হারাচ্ছে মোটাঅঙ্কের রাজস্ব। চট্টগ্রাম বন্দরে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির সুযোগ না পেয়ে পানগাঁও ও আইসিডি কমলাপুর বন্দরকে বেছে নিয়েছে আমদানিকারকেরা ; চালাচ্ছে তাদের অবৈধ কারবার। এ ব্যাপারে প্রতিকার চেয়ে ভুক্তভোগীরা এনবিআর চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত আবেদন করলেও কোনো কাজ হয়নি। বাংলাদেশের বিভিন্ন শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে সরকার প্রতিবছর বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক থেকে যেপরিমাণ রাজস্ব আহরণ করে তার মধ্যে বিপি সীট
(Hot Rolled Steel Sheet, Cold Rolled Steel Sheet, Galvanized Steel Sheet, Tin Plate) ইত্যাদি পণ্যের চালান থেকে আহরণকৃত শুল্ক করাদির পরিমাণ উল্লেখ্যযোগ্য। এ ধরনের পণ্য চালানসমূহ মূলত চট্টগ্রাম শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। কিন্তু চট্টগ্রাম শুল্কস্টেশনে কর্মরত কর্মকর্তাদের বিশেষ নজরদারির কারণে এখানে মিথ্যা ঘোষণার আশ্রয় নিয়ে আমদানিকারকদের পক্ষে পণ্য আমদানি করা সম্ভব নয়। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এ ধরনের পণ্য আমদানির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। বিগত কয়েক বছরের শুল্কায়ন পর্যবেক্ষণ করলে বিষয়টি সহজে অনুমান করা যাবে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আমদানিকারকেরা এসব পণ্যের চালান চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে পানগাঁও বন্দরের মাধ্যমে খালাস নিচ্ছেন। এর অন্যতম কারণ হলো- এ বন্দরের মাধ্যমে আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকারকেরা মিথ্যা ঘোষণার আশ্রয় নিয়ে সহজেই পণ্য চালান খালাস নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে সরকার এ ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
নিচের প্রদত্ত তথ্য থেকে রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি সহজেই অনুমান করা যাবে। ধরা যাক, পণ্যের ঘোষণা Hot Rolled Steel Coils, HS code: 7208 যার টোটাল ট্যাক্স ইমপ্যাক্ট (TTI) ৩৭% শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রতিটন মার্কিন ডলার-৪০০, টাকা-৪৩,৬০০ মোট শুল্ক করাদির পরিমাণ -১৬,১৩২ টাকা। কিন্তু ঘোষণার আড়ালে যদি Galvanized Steel Sheet, HS code: 7210/7210.49.90 যার (TTI) ৬৭% শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রতি টন মার্কিন ডলার- ৬০০, টাকা ৬৫,৪০০ মোট শুল্ক করাদির পরিমাণ টাকা- ৪৩,৮১৮ পণ্য আমদানি করা হয় সেই ক্ষেত্রে সরকারের রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ হবে টাকা- ২৭,৬৮৬ (আনুমানিক)। যদি প্রতিবছর পানগাঁও বন্দরের মাধ্যমে ৫লাখ মেটিক টন এ জাতীয় পণ্য আমদানি করা হয় সেই ক্ষেত্রে সরকারের রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ হবে টাকা-১,৩৮৪ কোটি (আনুমানিক)।
ধরা যাক, পণ্যের ঘোষণা Cold Rolled Steel Coils, HS code:7209.17.00/7209.16.00 যার টোটাল ট্যাক্স ইমপ্যাক্ট ( TTI) ৩৭% শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রতিটন মার্কিন ডলার-৫২০, টাকা ৫৬,৬৮০, মোট শুল্ক করাদির পরিমাণ টাকা ২০,৯৭১। কিন্তু এ ঘোষণার আড়ালে যদি Steel Sheet, HS code: 7210.30.90/ 7210.49.90 আমদানি করা হয়, সেই ক্ষেত্রে সরকারের রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ হবে টনপ্রতি (টাকা- ৪৩,৮১৮-২০৯৭১)= ২২,৮৪৭। যদি প্রতিবছর পানগাঁও বন্দরের মাধ্যমে ৫লাখ মেটিক টন এই জাতীয় পণ্য আমদানি করা হয় সেক্ষেত্রে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ হবে ১,১৪২ কোটি টাকা (আনুমানিক)। আবার Cold Rolled Steel Coils যদি ০.৫০ এম এম এর কম THICKNESS হয় এক্ষেত্রে শুল্ক ফাঁকির পরিমাণ প্রতি মেট্রিক টনে ১২,৪৭০ টাকা।
দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্য চালানের ক্ষেত্রে যেসকল কন্টেইনারে ২৭টনের নিচে ওজন ঘোষণা দেয়া হয় সেসকল ক্ষেত্রে প্রতি কণ্টেইনারে ৪/৫টন ওজনে কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। যেসকল চালানে MIXED পণ্য ঘোষণা দেয়া হয় সেসকল ক্ষেত্রে কম শুল্কের পণ্য বেশি দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে বেশি শুল্কের পণ্য বেশি থাকে। ফলে এক্ষেত্রে সরকার প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব হারায়। এভাবেই সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে CI CELL কর্তৃক একটি পণ্য চালান আটক করার ফলে কায়িক পরীক্ষায় রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি নিশ্চিত হয় এবং এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারককে প্রায় ১কোটি ১১ লাখ জরিমানা করে পণ্য ছাড় দেয়া হয়। শুল্ক ফাঁকির কাজে সহায়তা করছেন মুলত কিছু অসাধু সহকারি/ রাজস্ব কর্মকর্তা শীট পণ্য খালাসের বিষয়টি তদন্ত করলে দেখা যাবে- এ পণ্যগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাত ১০টার পরে খালাস নেয়া হয়। দিনের পরিবর্তে রাতে খালাস নেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত সন্দেহজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধ্যানে দেখা যাবে যে, বিগত ২/৩ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এই ধরনের পণ্য আমদাণির পরিমাণ আগের তুলনায় প্রায় ৭৫% কমে গেছে। এর মূল কারণ চট্টগ্রাম বন্দর তথা শুল্ক স্টশনের মাধ্যমে এই ধরনের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কোনোপ্রকার শুল্ক ফাঁকির সুযোগ নেই। শুধুমাত্র সৎ আমদানিকা্রকেরাই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে ব্যবসায়ে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
সঠিকভাবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষে চট্টগ্রাম শুল্কস্টেশনসহ দেশের সকল শুল্কস্টেশনে এই ধরনের পণ্য ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ নজরদারির মাধ্যমে পণ্য চালান, শুল্কায়ন ও ছাড় প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ ধরনের রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ অনেকাংশে কমে যাবে এবং শুল্কায়ন ও পণ্যচালান খালাসের ক্ষেত্রে গতিশীলতা আসবে। জাতীয় স্বার্থে বিষয়টির প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়া অতীব জরুরি- এমন মন্তব্য ভুক্তভোগীদের।
এ ব্যাপারে পানগাঁও কাস্টমস এর কমিশনার ড. আবু নুর রাশেদের মুঠোফোনে বারংবার কল করেও তাঁর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।