দীর্ঘ একটা সময় ছিল যখন দেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা অবহেলিত ছিল। রেল যোগাযোগ পরিষেবার আয়তন সে সময়টিতে বাড়ার পরিবর্তে দিনে দিনে কমেছে। স্টেশন কমেছে, লাইন কমেছে, ইঞ্জিন কমেছে, বগি কমেছে।
দীর্ঘ একটা সময় ছিল যখন দেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা অবহেলিত ছিল। রেল যোগাযোগ পরিষেবার আয়তন সে সময়টিতে বাড়ার পরিবর্তে দিনে দিনে কমেছে। স্টেশন কমেছে, লাইন কমেছে, ইঞ্জিন কমেছে, বগি কমেছে। পরিবেশবান্ধব, সুলভ যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে স্বাধীন দেশে রেল পরিষেবা যে পরিমাণ গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল তার ধারেকাছেও তা ছিল না। হঠাৎ করেই সাবেক সরকার রেল পরিষেবার সম্প্রসারণে উদ্যোগী হয়। এ সম্প্রসারণ যে খুব পরিকল্পিত ছিল এমন দাবি করা যাবে না। দেশের জনপ্রতিনিধিরা প্রযুক্তি চিন্তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করায় এবং পেশাজীবীরা রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করার ফলে স্বপ্নে পাওয়া নানা প্রকল্প এসেছে, কিন্তু তাতে বাস্তবতার পরশ পাওয়া যায়নি। শুধু মোসাহেবির কারণে জনকল্যাণের নামে রেল পরিষেবার যে উন্নয়ন হয়েছে তার শতভাগ সুবিধা দেশবাসী ভোগ করতে পারেনি। এমন পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন জনকল্যাণে আগামীতেও ভূমিকা রাখতে পারবে না বলেই মনে হয়। একমাত্র বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেই রেল পরিষেবার উন্নয়ন করা সম্ভব।
অনেক সাধারণ মানুষই বিশ্বাস করে রেল পরিষেবা উন্নয়নে দীর্ঘ অবহেলা মনুষ্যসৃষ্টি। দায়িত্বপ্রাপ্তরা ইচ্ছাকৃতভাবে রেল পরিষেবা উন্নয়নকে পেছনে রেখে সড়ক যোগাযোগকে গুরুত্ব দিয়ে দেশকে সড়ক পরিষেবার কাছে জিম্মি করে রেখেছে। রেল চলাচলের যে সময়সূচি তাতে জনগণ নিজেদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে কোনো সমাধান হিসেবে পায় না, সর্বোপরি কোনো জনকল্যাণও খুঁজে পায় না। তাই সুলভ ও নিরাপদ রেল পরিষেবাকে পাশে সরিয়ে রেখে সড়কপথে নিজেদের গন্তব্যপথে চলে। অনেকে দাবি করে থাকেন রেল যোগাযোগ উন্নয়নের চেয়ে সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে বিদেশী বিনিয়োগ পাওয়া সহজ, ঋণ পাওয়া সহজ। কিন্তু সাধারণ জনগণ বুঝতে পারে না ঋণ জরুরি, না নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ গ্রহণ জরুরি?
দেশে রেল যোগাযোগ উন্নয়নে কোনো ধারাবাহিক পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত আর সরকারি দলের নেতারা যখন যে স্বপ্ন দেখেছেন তার বাস্তবায়নই করা হয়েছে দীর্ঘকাল। ফলে কোনো এলাকায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রেললাইন সম্প্রসারণ করে সারা দিনে একটা রেলগাড়ি চলাচল করছে। একটা গাড়িতে কয়টা বগি সংযুক্ত আছে তার ওপর নির্ভর করে কত হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন প্রয়োজন—এ অংক একজন সাধারণ মানুষেরও ভাবনার মধ্যে আসা সহজ ও সংগত, কিন্তু আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোনোদিন হিসাবই করেননি কত ক্ষমতার ইঞ্জিন হলে আমাদের রেল পরিষেবার পথচলা মসৃণ হয়। তাই দেশে ৮-১০ রকমের অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিনই বেশি ব্যবহার হচ্ছে। এতে যে ব্যয় বাড়ে তার হিসাবও কেউ করে না, করেনি। রেল পরিষেবা যতই লোকসানি ব্যবস্থা হোক না কেন ব্যক্তি খাত লাভজনক আছে কিনা সেটাই যেন মূল বিবেচ্য।
একসময় আমাদের এক মন্ত্রী চীন সফরে গিয়ে ডেমু ট্রেন দেখে খুব পছন্দ হয়ে গেলে তিনি তা কিনে ফেললেন। এই ট্রেন বাংলাদেশে চলাচলের উপযুক্ত কিনা তা বিবেচনার ন্যূনতম প্রয়োজন মনে করলেন না তিনি। চীন থেকে ট্রেন এল, মহা আড়ম্বরে উদ্বোধন হলো, কয়েকদিন চলাচলের পর সেই ট্রেনগুলো আজ কোথায় পড়ে আছে তা শুধু কর্তৃপক্ষই জানে। এমন সব কিন্তু পরিকল্পনার অংশ করে ফেলার কারণেই রেল যোগাযোগ লোকসানের বেড়া ভেঙে বের হতে পারেনি কখনো। তদুপরি লোকসানি খাত থেকে রেলকে বের করে আনার তথাকথিত যেসব উদ্যোগ লক্ষ করা গেছে তাও যথাযথ জনকল্যাণের উদ্যোগ—এমন দাবি করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। ঢাকা-কক্সবাজার বুলেট ট্রেন প্রকল্প এমনই এক কিম্ভূত পরিকল্পনার উদাহরণ।
রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সাধারণ যাত্রীদের কথা কর্তৃপক্ষ কানেই তুলতে চায় না। তারা নিজেদের মতো করে উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে যা সাধারণ যাত্রীদের কাছে কল্যাণকর বলে প্রতীয়মান হয় না। তখন তারা বাধ্য হয়ে এলাকাভিত্তিক চাহিদা তৈরি করে আন্দোলন শুরু করে। যশোরের রেল আন্দোলনও তেমনই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে যশোরবাসীর চাহিদা। যদিও এসব চাহিদা ভুক্তভোগী ট্রেন যাত্রীদের তিক্ত অভিজ্ঞতার ওপর দৃষ্টিপাত করে নিরূপণ করা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে চাহিদা তৈরি করে আন্দোলন শুরু করে। আসুন চোখ রাখি যশোরের এবারের আন্দোলনের দাবিগুলোর দিকে
—পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পে বেনাপোল থেকে ঢাকায় নতুন দুটি ট্রেন দিতে হবে।
—দর্শনা থেকে যশোর হয়ে দুটি ট্রেন দিতে হবে।
—যশোর থেকে প্রতিদিন ঢাকায় অফিস করার মতো সময়ে যশোর জংশন থেকে ট্রেন দিতে হবে।
—বাস ভাড়া থেকে ট্রেনের ভাড়া কম করতে হবে।
—খুলনা থেকে ঈশ্বরদী-যমুনা ব্রিজ হয়ে অন্তত একটি ট্রেন বজায় রাখতে হবে।
—সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
—ফুলের রাজধানী গদখালীতে স্টপেজ দেয়াসহ যশোর থেকে সবজি, মাছ, ফল বহনের জন্য ভ্যান্ডার (মালবাহী বগি) যুক্ত করতে হবে।
—বেনাপোল যশোর ডাবল রেললাইন চালু করতে হবে।
রেল আন্দোলনে যশোরের একটা অতীত ঐতিহ্য আছে। যশোরের মানুষ জানে একসময় সরকারি সিদ্ধান্তে যশোর-বেনাপোল রেললাইন তুলে দেয়ার সব ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। মাইকেল মধুসূদন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর শরীফ হোসেন এবং আইডিইবির সাবেক সভাপতি মনিরুল হক খানের নেতৃত্বের আন্দোলন সে সময়ে যশোর-বেনাপোল রেললাইনকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। আজ সেই লাইনের ওপর দিয়ে আন্তর্জাতিক বন্ধন এক্সপ্রেস, বেনাপোল-ঢাকা আন্তঃনগর, খুলনা-বেনাপোল কমিউটার ট্রেন চলাচল করছে। সেদিন যদি কুটক্রী মহলের ষড়যন্ত্রে রেললাইনটা তুলে ফেলা হতো তাহলে নতুন রেললাইন তৈরি করে তারপর আন্তর্জাতিক রেল যোগাযোগ করতে হতো। যশোরবাসী আন্তর্জাতিক বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য যশোর জংশনে একটা স্টপেজ নির্ধারণের আন্দোলন করেছিল, সেখানেও তারা সফল হয়েছে। আমাদের ট্রেনগুলোর সঙ্গে স্টেশনের উচ্চতার তিন-চার ফুট তফাৎ ছিল যার কারণে বৃদ্ধ এবং রোগীদের জন্য স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠা ও নামা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল তাও যশোরবাসীর দাবির মুখে পূরণ হয়েছে।
রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার ঐতিহ্য আছে যশোরবাসীর। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা এবারেও তাদের লক্ষ্যে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে। এ আন্দোলন আজ পদ্মা সেতুর সুফল যশোরবাসীকে পৌঁছে দিতে যে উদ্যোগ নিয়েছে তার যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। যশোরবাসী জানে না বিগত সরকার কাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে তাদের বঞ্চিত করছে। তবে এটুকু বোঝে বাংলাদেশে প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ব্যক্তির প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো সবার দৃষ্টির সামনেই যশোর জংশনকে পাশ কাটিয়ে জেলার শেষ প্রান্তে নতুন একটা জংশন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে অথচ বিগত জনপ্রতিনিধিরা সে সময়ে জি হুজুরে ব্যস্ত থেকে চোখ বন্ধ করে পড়ে ছিলেন। আসলে এটাই স্বাভাবিক। নিজের প্রাপ্তি যেখানে নিশ্চিত হচ্ছে না সেখানে জনগণের প্রাপ্তির ভাবনা আসবে কোত্থেকে আমাদের জনপ্রতিনিধিদের মাথায়। তবে একটা অতি পুরনো জংশনকে সরিয়ে রেখে নতুন জংশন নির্মাণ কতটা যৌক্তিক হয়েছে তা পরিকল্পকদের ভেবে দেখা দরকার। এতে জনগণের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তার দায় কে নেবে সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে।
দেশে রেল যোগাযোগের প্রতি দীর্ঘদিনের উদাসীনতার কারণে এ খাতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। পরিষেবা উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ করা যায়নি। সারা দেশে রেল চলাচলে কোনো শৃঙ্খলা দেখা যায় না। পরিষেবাটি আজ পর্যন্ত সময়ানুবর্তিতার পরিচয় রাখতে পারল না যা খুব জরুরি ছিল। সাধারণ যাত্রীদের রেলের সময়সূচি নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে, তা আমলে নেয়া হয়নি কখনো। দ্রুতগতির রেল চলার মতো রেললাইনকে যুগোপযোগী করা হয়নি। ওয়ার্কশপগুলোর পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি বরং গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের নামে দক্ষ জনশক্তিকে বিদায় করে দিয়ে অন্য অনেক সংস্থার মতো একটা মাথাভারী প্রশাসন দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ রেলের যে সম্পদ আছে তা দক্ষতার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে যাত্রীসেবায় কোনো ভাড়া আদায়েরই প্রয়োজন হতো কিনা সন্দেহ। কিন্তু দুর্নীতি এ পরিষেবাকে গ্রাস করে ফেলায় রেল লাভের মুখ দেখে না কখনো, বরং লোকসানি সংস্থা হিসেবে সাধারণ যাত্রীদের জন্য সুবিধা বাড়ানোর চেয়ে ভাড়া বাড়ানোর দাপট দেখিয়ে চলে সর্বক্ষণ।
যশোর-খুলনা রুটের কথাই ধরা যাক। বেনাপোল কমিউটার যদি সকালে বেনাপোল থেকে খুলনায় যেত তবে এ অঞ্চলের মানুষ সকালে রওনা হয়ে বিভাগীয় শহরে দাপ্তরিক কাজকর্ম বা চাকরি করে আবার দিনশেষে বাড়ি ফিরে আসতে পারত। এ দাবি দীর্ঘদিনের হলেও কর্ণপাত করার কেউ নেই। রেল পরিষেবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক পরস্পরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা। বেনাপোলের এক শিক্ষার্থী যাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সংযোগ রেলটি ১ ঘণ্টা বা আধাঘণ্টা অপেক্ষার পর যশোর জংশন থেকে পেতে পারে এমনভাবে সময়সূচি তৈরি করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। কিন্তু দেশে এমন সময়সূচির ধারেকাছেও কেউ থাকে না। এ ব্যবস্থাকে সবাই জরুরি বিবেচনা করলেও আজ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে দেখেনি কেউ। পদ্মা সেতুর রেল সুবিধা যশোরবাসী ভোগ করতে চাইলে ন্যূনতম এমন একটা ব্যবস্থা রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়টি কর্তৃপক্ষের মনে রাখা প্রয়োজন সবসময়।
যশোরের রেল আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে রেল পরিষেবার উন্নয়নের অনেক ছোট ছোট বিষয় উঠে এসেছে, যা শুধু যশোরবাসীর জন্য নয়, সামগ্রিক রেল পরিষেবার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তাই আন্দোলনের প্রেক্ষিত বিবেচনা করা প্রয়োজন। মুখের জনকল্যাণ অন্তরে নিয়ে গেলে তবেই পরিবর্তন আসবে এবং সত্যিকার জনগণের কল্যাণ হবে। দেশের মঙ্গল হবে। আশা করি নতুন সরকার দেশে রেল পরিষেবার সার্বিক উন্নয়নে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে মঙ্গলের দিকে অগ্রসর হবেন।
লেখকঃ সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)