রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

পানমূল

খন রঞ্জন রায়

-কোটিপতি বানায় দিমু আপনাকে ।

-শুনেন; শুনেন বলে চিৎকার করছিল উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সুঠাম দীর্ঘদেহী তারুণ্য উত্তীর্ণ যুবক তিনজনের একজন। কালো ট্রাউজার,কালো টিশার্ট ,কালো রিমলেশ চশমা । মোটা উঁচু রিবক কেড়স পড়া প্রায় সমান উচ্চতা ও দেহকাঠামো । বেকব্রাস করা কুকড়াচুল। ডান হাতের কব্জি বরাবর মোটা চেইনের স্বর্ণের ব্রেসলেট। বাম হাতে কালো বেল্টের রিস্টওয়াচ । তিনজনের কথাবার্তার সুর, চাওয়াচাওয়ি আর ভাবনাবিনিময়  সাজুস্যপূর্ণ । সাধারণ-স্বাভাবিক জীবনাচারের মনুষ্য কাঠামোর বাইরে । তবে দেখার মতো সৌষ্ঠভ । ডাকাডাকির মধ্যে যেমন রাগ আছে; আবার কিছুটা মরমী ভক্তির সুরও আছে ।bsrm

-আপনারা কারা!! রঞ্জনের মায়ের বিতর্কহীন প্রশ্ন।

তখন মার্চ মাস । ঋতুপরিক্রমায় যা বসন্তকাল । গ্রীষ্ম ও শীতের মাঝামাঝি দুপুরবেলা কিছুটা তপ্ত হাওয়া । কখনো মোলায়েম , কখনো রৌদ্রকোজ্জ্বল। কখনোবা উৎসবী আমেজ । দোলযাত্রা, হোলি, বসন্ত উৎসবের কোন না কোনটাতে মাতোয়ারা থাকে পরিবেশ-প্রকৃতি, সমাজ- সংস্কৃতি। সেইদিন দোলযাত্রার ঠিক আগের দিন। দুপুরের সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে । খাবারের পর ‘মাইজ্জাল’ ঘরেই কিছুক্ষণ গা এলিয়ে নেন। রঞ্জনের মা। বিছানায় যাবেন! ঠিক এই সময়ের ঘটনা। ডাকাডাকি ।

মডেল টাইপের সতেজ টগবগে উঠানের ঠিক মাঝখানে দাঁড়ানো যুবকটি কয়েক কদম এগিয়ে এল । চৌচালা ঘরের মূল দরজা বরাবর । কপালে কালো ফিতা বাধা, চোখভর্তি আগুন, চেহারা অবয়রে চাটপটে দ্যুতি ।ads din

-আমাদের চিনবেন না । ঢাকা থেকে এসেছি । আমরা সারা বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে মানুষকে কোটিপতি বানাই ।

– বিনিময়ে —-।

বলতেই উরাধুরা তিন যুবকের পাশে সাধারণ পোশাকের অচিন লোকটি কথা টেনে নিল।

– আমি সবজানি, সবসাক্ষী, ওপরওয়ালার ইচ্ছায় গাড়ি চালিয়ে আমি টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, মনপুরা ! থেকে ভূরুঙ্গমারী ভাইজানদের নিয়ে গেছি । এখানেও একটানে চলে এসেছি । মাইক্রোগাড়ি বলে আপনাদের বাড়ির গলিতে ঢুকাই নাই । করই গাছতলায় রেখে এসেছি। কিছুটা ফোঁফাতে ফোঁফাতে বলল । যেখানেই গেছি ভাইজানদেরকে সবাই বিশেষ খেদমত করে।

কথাটা বিশেষ বেহায়ার মতো মনে হলেও, এইদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই । ভাবখানা এমন যে এখানে-তো নাজায়েজ কিছু হচ্ছে না ।

– শ্বাস একটু জোরে টানতেই পাশে দাঁড়ানো শাণিত ও প্রাণিত এক যুবক ডান তর্জনী দিয়ে পিঠের নিচে গুতা দেয় । পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি হয় । কথা বলার সুর আরো চড়ে যায় ।

-ভাইজানরা কিন্তু র্দোদ- প্রতাপশালী । দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে এক তুড়ি লাগে মাত্র। ভাইজানদের কথামতো কাজ করলে অন্তহীন, সুখশান্তি, স্বাচ্ছন্দ্য লুটোপুটি খায় । ‘সার্ভিস’ একেবারে ‘হলমাকর্’ করা । বহু গরিব-গুরবা, আনপড় মানুষ ভাইজানদের হিসাবের সাথে মিলে গিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে । কতো অন্তহীন লীলাখেলা দেখেছি তার অন্ত নাই । শুধু প্রয়োজন সুযোগের সদ্ব্যবহার করা ।

একটু জিরিয়ে আবার বলতে থাকলো-কিছু চাইতে গেলে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি বিসর্জন দিতে হয় । ভাইজানরা কী বলছে শুনেন । পরে কিন্তু কপাল চাপড়াবেন ।

এইবারের কথাটাতে বেশ গোলকধাঁধা । কিছুটা নালিশের সুর । ‘শুধু তেলে ভাজা তেলে চোবানোর মতো বাজারী কথা’ । প্রস্তাবটাকে কুহকজালে আটকানোর জেনুইন ব্যাপারের গন্ধও আছে ।

– কী সব বলছেন ।

– পাশে থাকা সোফায় শরীর ছেড়ে বসে রঞ্জনের মা জিজ্ঞাসু ভঙিগতে বললেন । সত্তোরঊর্ধ্ব বয়স। গ্রামের বাড়ি। থাকেন  একা। সার্বক্ষণিক সঙ্গী একজন । পাশের বাড়ির বৃদ্ধা মহিলা। তাও ষাটের ঊর্ধ্বে। আপন বলে কেউ নাই। স্বামীহারা নি:সন্তান মহিলা । স্বামী থাকতেও রঞ্জনের মাকে একনজর না দেখলে পেটের ভাত হজম হতো না। আর এখন-তো নিঃসঙ্গতা, হাহাকার, অতৃপ্তি, ক্ষুধা,অর্থকষ্ট ও বঞ্চনার মিশেল নিয়ে এখানে। রক্তে থাকা নির্জনতা সঁপে দিয়েছে আরেক নির্জনতার কাছে । একেবারে পাকাপাকিভাবে। কিছুকাল আগেও তা ছিল পার্বণিক। পূজা পার্বণের মৌসুম ঘনালে কিংবা রঞ্জনরা শহর থেকে বাড়িতে বেড়াতে এলে । তখন পাকের ঘরের পুরোপুরি দায়িত্ব পরতো বিধবা এই নারীর উপর । বিভার মা । বিভা এবং তার বাবা কখন দেহ রেখেছে এই হিসাব মেলা ভার। সেই দিন তারিখের ইতিহাস ধূলিময়লাযুক্ত। গড়মিল। নস্টালজিক জীবনচিত্র। মর্মান্তিক আঘাতের এসব কথা মনে পড়লে ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায় । মুষড়ে পড়ে । যৌবন থেকে জীবন সবকিছু বেঁকেচুরে যায় । বুকের ভেতরটা থরথর করে কাঁপে। বিভার মায়ের দুঃখজনক সেইসব ইতিহাসও এখন ‘প্রয়াত’। রঞ্জনের মায়ের হাত ধরাধরি করে চলে, তাতেই শান্তি । নৈসর্গিক শান্তি । দুইজনের রান্নাবান্না করে । প্রথম প্রথম রান্না চড়ানোর আগে লাকড়ি জোগাড় করতে হতো। এখন তাও লাগে না। তবে মাঝে মাঝে পুকুরঘাটে গিয়ে শীতল, মায়াময়, সুন্দর বাতাস উপভোগ করে আসে । আজ দুপুরে তাই করেছিল । ঠিক এই সময়েই বাড়ির ভেতরে কিছু একটা হৈ-হুল্লোড় । দূর থেকেই বুঝতে পারলো উঠানে কিছু একটা তামাশা মঞ্চস্থ হচ্ছে।  একাত্তরের মিলিটারির বুটের আওয়াজ এখানো তার কানে বাজে । আৎকে ওঠে । খুব বেশি দিন আগের নয় । মনে হলো এমনই কিছু একটা । ঘটনা না অঘটন; অনেক কাহিনি শুনেছিল তখন বর্ণনাময় । বহুবর্ণের বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ,দিল্লির দ্যা স্টেটম্যান, ব্রিটেনের দ্যা গার্ডিয়ান ও ডেইলি টেলিগ্রাফ, নিউ ইয়র্ক টাইমস , আয়ারল্যান্ডের দ্যা আইরিশ টাইমস , আর্জেটিনার বুয়েনস এইরেস হেরান্ড, ব্যাংকক পোস্ট , বার্তা সংস্থা এপি কতো রকম ও ধরনের খবর। যে প্রচার  করতো তার ইয়ত্তা নেই। জয়-পরাজয়ের কাহিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা গৌরবের কাহিনি তাকে বিশেষভাবে আন্দোলিত করতো। এইসব খবরই ছিল তখন মুক্তির যুদ্ধের অপরিহার্য জীবনীশক্তি । পাঞ্জাবীদের কা-কারখানা নিয়ে-তো পুঁথি -পুস্তক, দলিল-দস্তাবেজ কম সৃষ্টি হয় নাই । তখন-তো তারা দেশের মানুষকে অহর্নিশ জালিয়ে মেরেছে । গভীর ক্ষতের উপসর্গ নিয়ে আমরা বেঁচে আছি । আজো কী সেইসব ঘটনার ধারাবাহিক কোনো অঘটন নাকি !!

-বিড়ালের মতো সাবধানে, নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলো বিভার মা । ‘কেওয়ার’ বরাবর সোফার পিছনে হেলান দিয়ে বিরক্ত না সহানুভূতিশীল হয়ে বসে আছে রঞ্জনের মা; তা বুঝতে পারলো না। সে কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো। রঞ্জনের মায়ের সাথে সুখ-দুঃখ-কষ্ট-বেদনা-ভালোবাসা-ভালোলাগার কতানা; গল্প জড়িয়ে আছে। এখন-তো সেইসব প্রয়োজনহীন নিস্পোজন। মায়াময়-মলিন চেহারা করে রঞ্জনের মায়ের দিকে তাকাতেই!!

-তুই একটা বেজন্মা; এই গালিটাই রঞ্জনের মায়ের মুখস্থ । এর বেশি কোনো গালি বা অসৌজন্যমূলক কথাবার্তা বা আচরণ তিনার জানা নেই । অতীতে এমনটাই ঘটছে । দেখা গেছে দু’জনেই ন্যায়নীতির প্রতিভূ। রোজ তিনবেলা তৃপ্তির ঢেকুর তোলে খেতে পারলেই হলো। শান্তির। পরম শান্তির । অন্যথায় নৈতিকভাবে অধিকারহীন হয় । মনখোলা হাসির পরিবর্তে কঠিন চোখে তাকাতাকি হয় । এতটুকুই। কিন্তু আজকের পরিবেশে দমকা হাওয়া ।

এতোগুলো মানুষের সামনে ‘বেজন্মা’ ডাকায় বিভার মায়ের মনে হলো ‘গরম খুন্তির ছ্যাঁকা খাওয়ার’ মতো। তারপর ও মনটা ভালো করার জন্য ঘরের মাঝ বরাবর বড় করে বাঁধিয়ে টাঙ্গানো একটি ছবির দিকে তাকালো । কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠিত ‘ইসকন’ কর্তৃক প্রবর্তিত ‘হরে কৃষ্ণ’ আন্দোলনের রাধাকৃষ্ণের শ্রী বিগ্রহের ছায়ালিপি । জীবনকে সর্বপ্রকার আবর্জনামুক্ত রাখতে আর থাকতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবধারাকে ভক্তিযোগে অনুশীলন করে । দুইজনেই বিশ্বাস করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক অবতীর্ণ ও শ্বাশত হরে কৃষ্ণ বানী সর্বজীবের মঙ্গলের জন্য । এই বানীর প্রাণ অনুসরণকারীরা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে পরম মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হয়।

নিষ্ঠার সাথে এই মহামন্ত্র উপাসনা ও জপ করলে জীবনবোধের কখনোই ব্যত্যয় ঘটে না । নশ্বর এই দেহ তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে প্রাণবায়ুকে নির্দিষ্টস্থানে পৌঁছে দেয় । মনুষ্যজন্মকে কাক্সিক্ষত পরমপ্রাপ্তির দোরগোড়ায় পৌঁছাতে মহাজাগতিক এই নিয়ম শাস্ত্রসিদ্ধ। এই বিশ^াস বুকে ধারণ করে অনেকের গালমন্দ সহ্য করেও রঞ্জনের মা গ্রামের বাড়িতে একা থাকতে পছন্দ করে। মৃত্যুকালে যেন কোনো আফসোস না থাকে সেইজন্য সাধ্যমতো, শাস্ত্রপ্রমাণমতো কাজকর্ম করেন। আচার, অনুষ্ঠান, উপদেশ, উপাসনা, উৎসব, ভোজন, ধ্যান, প্রার্থনা, জনসেবামূলক কাজ করে থাকেন । মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রও কায়মনোবাক্যে জপ করে শরীর পরিশুদ্ধ করেন। বুড়ো বয়সে শরীর-তো যৌবনের মতো থাকে না, তবু ভোরবেলায় ওঁ নমঃ ভগবতে বাসুদেবায়; ওঁ, নম: শিবায় : মন্ত্র উচ্চারণ করে শয্যা ত্যাগ করেন।

– বিভার মা বার কয় নিষেধও করেছে । বলেছে-শরীর আগের চেয়ে বেশ শীর্ণ হয়েছে। এবার ধীরে চলুন। তাতে মন্ত্র জপের কন্ঠস্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে এনেছেন । এতটুকুন-ই । এরপরও সকাল-সন্ধ্যা ঠাকুরঘরের পবিত্র বেদিতে কুশাসন-এ বসে ‘ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর’ দীর্ঘ সময় নিয়ে জপ করেন । প্রবল আবেগে পাথরের মূর্তির মতো নির্বাক হয়ে যান । অনাস্বাদিত পরমপ্রাপ্তির আনন্দে ভাসেন । বিবশ-বিহ্বল তীব্র আনন্দ-যাতনার মুহুর্ত স্মরণ করে ক্ষণেক্ষণে কেঁপে উঠেন । কখনো কখনো রহস্যের মৃদু হাসিও হাসেন। চোখ জুড়ানো রোমাঞ্চকর এইসব অভিজ্ঞতা বিভার মা হাড়েহাড়ে টের পায় । ভক্তিবেদান্ত আবেগের তাড়নায় কী না কী করে বসেন এইজন্য কখনো কখনো বিভার মা দি¦ধায় পড়ে। বিব্রতবোধ করে । নিজের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সজাগ থাকে । দায়িত্ব সচেতন তো বটেই । এরপরও মাঝে মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলে । শংকিত দৃষ্টি নিয়ে রঞ্জুনের মায়ের দিকে তাকাতেই উঠান থেকে হুংকার।

– কী হলো! আমরা কী অপারেশনে যাবো । এইসবে বাড়ির মালিকের অনুমতি ছাড়া আমরা মূল কাজে হাত দেই না। ওস্তাদের নিষেধ। কঠোর বিধিনিষেধ। আজ নয়; আপনি বললে। আগামীকাল বেলা বাড়ার আগে আগে গাছের ছায়ায় ছায়ায় কাজটা সেরে ফেলবো । প্রথমে মগের মুল্লুকের কায়দায় আচরণ করলেও! এখন সুর নরম ও নমনীয়ভাবে বলছেন উঠানে দাঁড়ানো দশাসই, আগন্তুক ।

– কী দুঃসাহস ; কী চান আপনারা!! চোখের দৃষ্টি স্থির রেখে পাল্টা প্রশ্ন করলো বিভার মা । নিজের অজান্তেই তার মন অশান্ত হয়ে গেলো । স্বভাবগতভাবে সে খুব বুদ্ধিমান ও চালাকচতুর বলা যাবে না । কিন্তু এখানের প্রশ্নে কোনো জড়তা, দ্বিধা, শঙ্কা ইত্যকার কোনো কিছুই মনে হয়নি । কন্ঠের গাম্ভীর্যে কেবল তাপের আভাস ছিল! তা নয়’ একেবারে আগুনের হলকা । বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো। রূপের আড়ালে মানুষের রূপ বহুরুপী। বিভার মার আচরণে তা আবার প্রমাণ হলো।

-কোনো প্রতিক্রিয়া কিংবা উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বলল।

– আপনারা খাড়ান! আমি বড়দা কে মোবাইল করি। তার দেহের ভেতরে তীব্র কম্পন শুরু হয়েছে। অবশ্য কেউ দেখার বা বুঝার মতো নয়।

– তুই চুপ কর; একগ্লাস খাওয়ার জল দে; সোফায় মাথা একটু কাত হয়ে বসে বলল রঞ্জনের মা । এবার কিছুটা উদভ্রান্ত-এলোমেলো মনে হলো । অল্প বয়সে তিনি খুব জেদি আর অভিমানী ছিলেন । বাপ-মার একমাত্র সন্তান । জীবন ছিল আনন্দে থই থই । এখন আবার কোন দৈব ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন। এই ভাবনা হয়তো কিছুটা বিচলিত হচ্ছেন ।

– ঢকঢক করে পিতলের এক গ্লাসের জল গিলে বিভার মার চোখে চোখ রাখলো। চোখ মানুষের মনের কথা বলে । চোখের রঙ, রূপ, ভাষা নিয়ে কবি সাহিত্যিকদের আদিখ্যেতার শেষ নেই । কাজলকালো চোখ, পটলচেরচোখ ,হরিণী চোখ নানা উপমা ব্যবহৃত হয়েছে । এখানে-তো সেইসব অভিব্যাক্তি জানানোর প্রয়োজন নেই । এখানে প্রয়োজন উত্তাপ, উত্তেজনার প্রশমন করা। আসলেই কী নিয়ে এই পরিস্থিতি; কোন্ দুরভিসন্ধিতে অপাঙ্তেয় এইসব ষন্ডামার্কা লোকের আগমন তা জানা ।

আমরা কি ঘরে ঢুকবো ? বসে কথা বলি । এখানে তর্ক -বির্তক নয় ,আন্ডারস্ট্যান্ডিং । আপনি সামান্যতম মন খারাপ করে অনুমতি দিলেও আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না । বিশেষ কাঠির সাহায্যে নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় অতি সন্তর্পণে গাছের গোড়া থেকে আলগা করতে হয়। আর আপনার এইটা-তো বিশাল বড় আম গাছের সঙ্গে লেপ্টে আছে। এর শিকড় বাকলের ভিতরে ভিতরে গেথে গেছে। আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে আছে। মূল লতাটির নীচের দিকে দুইটি ভাগ হয়ে মাটির ভিতরে প্রবেশ করেছে। এর গভীরেই লুকিয়ে আছে আমাদের কাক্সিক্ষত জিনিসটি। আরাধ্য-পরমারাধ্য। দলের মধ্যে থাকা একটু বয়স্ক যুবকটি একগাল কৃত্রিম বিগলিত হাসি নিয়ে বলছিল কথাগুলো। মেজাজ-চিন্তা-আচরণে আগের দাম্ভিকভাব উধাও। ভাবখানা এমন যে তাদের স্বপ্নটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা!! না! নতুন কোনো ঘুটির চাল তা কে জানে? তবে একেবারে হতাশায় দিশাহারা এমন নয়।

পুবের ঘর। একেবারে দরজা বরাবর তিন সিটের সোফার মাঝখানে বসা রঞ্জনের মা, তার পূর্বপাশে সোফার হাতল ধরে পাশের দাঁড়িয়ে বিভার মা ।

পড়ন্ত বিকেল। হেলে পড়া সূর্য্য। এক চিলতে সূর্য্য, আলো মেখে হাওয়ায় ভেসে রঞ্জনের মায়ের গালে পড়ে চিকচিক করছে। সেই আলোতে নির্মমতার ছাপ। সিদ্ধান্তহীনতার স্পষ্ট ইঙ্গিত। মনে ভেতর কিছুটা অনিশ্চয়তাও হেটে বেড়াচ্ছে।

– অনন্যোপায় হয়ে ভুরু কুঁচকে কিছু বলতে যাবে; থামিয়ে দিল বিভার মা। সাগরেদ-সারিন্দারা এক কাঠি সরেস হয়। আর বিভার মা-তো ঘোরতর শিষ্য। ঝাড়ামোছা থেকে রান্নাবান্না, খাইখরচ শেষে ‘লক্ষীর ভাণ্ড’ সবই তার নখদর্পণে । নি:শ্বাসের দূরত্বে । সর্বত্র উপস্থিতি। বৈধব্যবেশের এই ‘সেনাপতি’ ছাড়া রঞ্জনের মা একেবারে অচল । এই সুযোগে ‘লাই’ পেয়ে পেয়ে একেবারে মাথায় উঠেছে । সাতপাঁচ না ভেবেকখনো চেঁচামেচি করে’ কখনো-বা গজগজ করে । অনেক ক্ষেত্রেই রঞ্জনের মা চুপ করে থাকে । অনেক সময় ন্যায়ভিত্তিক যৌক্তিক কথাও বলে । বিশাল এই বাড়িতে যে কোনো ক্রান্তিকালে ভরসা-তো একে অপরেই। বাকীরা তো থেকেও নেই।

-বড়দা-কে ফোন দেই, সংকট সমাধানের তাগাদা না বিভার মার আজগুবি বোধের উদয় বুঝতে পারলোনা রঞ্জনের মা। পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের গর্বিত জননী । মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দুই ছেলেকেও ইতোমধ্যে বিবাহ করিয়েছেন । নাতি-পুতিও হচ্ছে । সম্ভাবনাময় আগামীজুড়ে । কষ্টের দিন,অনটনের সময় অনেক আগেই পার করেছে । এখন আনন্দের দিন, উপভোগের সময়। এরপরও মনের ভেতর হাহাকার । মনে হয় উপভোগের আনন্দ এখন ঠুনকো । বেশ খানিকটা জুড়ে বেদনার বহ্নিজ্বালা। অভাব চলে গেছে , নিয়ে গেছে আনন্দের উপাচার ।

একাকীত্ব! সব ছেলেই গ্রামহীন । প্রাণহীন শহরে। বড় ছেলের চট্টগ্রামের বাসায় গেলে দুই-তিন দিনেই অস্থির লাগে । ৮ তলার বাসা । চারদিকে খোলামেলা। প্রচুর আলোবাতাস। মা থাকবে বলে এটাচ বাথের বড়সড় একটি রুম ছেলে খালি রেখেছে । ৬ ফুট বাই ৭ ফুট ডাউস সাইজের সেগুনকাঠের একটি খাটও পেতে রেখেছে । লক্ষ্মীসোনা বড় বউও শাশুড়ি গেলে খুশি হয় । ভীষণ আনন্দ পায় । প্রথমদিন মিষ্টিমুখ করায়। একটি নাতিন হয়েছে । দেখতে অবিকল পূর্ব  প্রজন্মের  উত্তরসূরী । সুন্দর ফুটফুটে কাটাকাটা চেহারা। একেবারে তার মায়ের মতো । নাতিন ফেলে আসতে কষ্ট হয়। কিন্তু উপায়হীন। একেবারে মন বসে না। মন পড়ে থাকে শৈশবে নিজ হাতে লাগানো মৌসুমী ফলজ আর লকলকে গাছগাছালির শনৈ: শনে: উন্নতির দিকে। গাছ নড়াচড়ার শীতল বাতাস এক অন্যরকম অনুভূতি । স্বর্গীয় পরশের মতো । শহরের আধুনিক জীবন তাকে একাকীত্বের কোলে ফেলে দিয়েছে।

নিজ সন্তান বৌ-বাচ্ছা-নাতি-পুতির সাথে যে রকম ব্যাক্তিগত সম্পর্ক থাকার কথা ,তা তো নেই বরং আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে । নিজের ভিতরে এক রকম শূন্যতা আবেগ-অনুভূতির জায়গাগুলি ক্রমেই দখল হয়ে যাচ্ছে । কিছুদিন আগেও ছেলে বাড়ি আসবে বলে বুভুক্ষের মতো অপেক্ষা করতো । রাস্তায় চেয়ে থাকাতো। এখন অপেক্ষা খাইখরচের টাকার জন্য ।

রঞ্জনের মা ভাবে তিনি কি একা; আবেগের সর্বরকম সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে একাকীত্বে ভুগছেন; না; বর্তমান পৃথিবীব্যাপী। যুগপরিক্রমায়। গবেষণায় বলছে-সারা পৃথিবীতে ৩৩% মানুষ একাকীত্বে ভুগছে । বাংলাদেশে এইক্ষেত্রে এখনো পুরোপুরি খাদে পড়েনি । টাকাকড়ির দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও একাকীত্ব এখনো নাভিশ^াস ওঠেনি । গবেষণায় বলছে সবচেয়ে বেশি ব্রাজিল,তারপর তুরস্ক তৃতীয় ¯থানে আছে আমাদের পাশের দেশ,কাছের দেশ ভারত। এককীত্বের কারণে ডিমেনশিয়া, আলজাইমার, ডিপ্রেসন এইসব দেশে প্রায় মহামারীর আকার ধারণ করেছে । এই হিসাব আমলে নিলে রঞ্জনের মায়ের ‘ছিন্ন বীনার তারে বেদনার সুর মাত্র’ । ইচ্ছা নির্বাসন । স্বাধীন-স্বতন্ত্র জীবনযাপন । প্রকৃতির কোলঘেষে। প্রাকৃতিকভাবে । নিজ বাড়িতে বসে-বারো মাসের প্রায় প্রতিদিন-ই কোনো না কোনো ফল সংগ্রহের আনন্দ উপভোগ করে । কলা, পেঁপে, ডাব, পেয়ারা-তো সারা বছরই বাড়ির কোণায় কাণায় পেকে থাকে । সুস্বাদু শরীফা, বেল, তাল, জাম, জামরুল, কামরাঙ্গা, করমচা, তেতুল ডাব, দেশি-বিলাতি গাব, সফেদা, আমড়াগুটা, আরো কত কী? আম, কাঁঠাল, লিচু, নারকেল, সজিনা গাছ-তো বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে। বন্যাগুটা ও একটি বড়সড় ডেউয়া গাছ একেবারে পুকুরের ভিতরে, জলে-ফলে খেলা করে। অমাবস্যা ও পূর্ণিমা ‘জো’ এলে আসে মৌয়াল । রশিদ মৌয়াল আবার সময়মতো নারিকেল-তালগাছ ছাফ করে। মধু বালতিভরে ঘরের দরজায় এনে ভাগাভাগি করে অর্ধেক দিয়ে যায়। মধুর বৈয়াম – কৌটায় রান্নাঘরের রেক-আলমারি ভর্তি হয়ে বড় ঘরে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে । সময়মতো কাউকে পেলে শহরের ছেলেদের কাছেও শিশিভরে মধু পাঠায়।

এইসব ছাপিয়ে সবচেয়ে নিবিড় সংযোগ প্রায় শতবর্ষী পানগাছটার প্রতি। গেছোপান। সংগ্রামের অনেক আগে লাগানো এই পানগাছ। ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি আমগাছে লাগানো এই পানগাছ। কালের বিবর্তনে ,সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমগাছ চর্তুদিকে ডালপালা মেলে বটবৃক্ষসম হয়েছে। সাথে পান গাছেও। তিনজনের সমান বেড়ের কা- পেরিয়ে ডাল শাখা-প্রশাখাসহ মগডাল পর্যন্ত দখল করেছে। শখের এই পানগাছ। মায়াবী ইতিহাসধারী এই পানগাছ কখনোই জৌলুস হারায়নি। আম কা-ের মূল পানলতাটি আকারে টিউবওয়েলের পানির পাইপের সদৃশ্য। চারদিকে গিজ গিজ করা কিছু শাখা-লতাপাতা আর পান পাতার হঠাৎ দৃশ্য আস্ত একটা বাঁশঝাড়। আশ্চর্যের বিষয় আমগাছের পরগাছা পানগাছ কিন্তু কেউ করো জন্য ক্ষতির কারণ হয়নি। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে একে-অপরে জড়াজড়ি করে বেড়ে ওঠা। প্রত্যেকেই সমৃদ্ধ ও বিচিত্রবৈভবে ঋদ্ধ। আমের দিনে ‘আম’ আর সারা বছরই ‘পান’। ভাবখানা তারা একই গোয়ালের গরু।

দুপায়া রাস্তার ধারে থাকায় পায়দলচারী আর পাড়াপড়শি সবাই পানের সুফলভোগী । এলাকায় মোটামুটি চাউর আছে কারো গাছপান খাওয়ার ইচ্ছা হলেই সহজ সমাধান রঞ্জনের মা । কেবল খাওয়াখাওয়ি নয়। চাওয়াচাওয়িতেও এই গাছ অনন্য। অতুলনীয় । ত্রিকালস্পর্শী এই গাছপান সম্বন্ধে অনেকেই আগে জানতো না। দেখেনি। সাধু-অসাধু সবার বিশেষ আকর্ষণ। পান খাওয়ার প্রতি আলাদা আকষর্ণীরা প্রথমবার ভ্রুঁ কুঁচু করে খেয়ে এর প্রেমে পড়েছে। মুগ্ধ হয়েছে । বৈচিত্র্যময় গুণে-মানে-স্বাদে বিহ্বল হয়েছে। প্রথমে যারা নিষিদ্ধ গাছলতা মনে করেছিল, তারাই ভেদাভেদহীন আকন্ঠ আকর্ষণ অনুভব করতে থাকে । আগে নামগন্ধ না শুনা পানপিয়াসীরা একগাল পানের রস আস্বাদনে আছাড়ি- বিছাড়ি করতে থাকে । শতগুণে সহজলভ্য রঞ্জনের মায়ের পানগাছ ধীরে ধীরে জগদ্ধিখ্যাত হয়ে পড়ে ।

ঘরের পিছনের রাস্তা দিয়ে যাওয়া বাইসাইকেলের টুং টাং শব্দে ঘোর ভাঙে রঞ্জনের মার। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে গুণিপাড়ার মতু মিঞা কাঁধে করে লাঙ্গল , জোয়াল, আচঁড়া ,মই নিয়ে তাঁদের পাড়ার দিকে যাচ্ছে। মতু মিঞা-কে ডাকবে কি ডাকবে না এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্ধে পড়লো । পরবাসী ছেলেদের অনুরোধে মতু মিঞা প্রাত্যহিক বাজারসওদা, বাড়িঘরের ‘ছৈয়লী’ কাজ দেখভাল করে । প্রায় সন্ধ্যায় হুক্কা টানতে টানতে রঞ্জনের মার কাছে এসে চা মুড়ির সাথে গাছপানের মৌলিক স্বাদ গ্রহণ করে । সুযোগ বুঝে বস্তাভরে পান পেরে দেয় । বিলিবণ্টন করে  । প্রতিবেশীর অনেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল স্বাদের এই পানের কঠিন ভক্ত। উন্মাদ । উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে এই পান। পাকা পান পাতা সাদা হয়। ঝড়ে পড়ে । ভোরে বড় একটি এলাকা জুড়ে দুধ সাদা পানপাতায় চাদর বিছানোর মতো হয় । চোখ ধাঁধানো দৃশ্যের অবতারণা হয়। সূর্যের আলো তাপ বাড়ানোর আগেই যে যার মতো কুড়িয়ে নেয় । এখানে কোনো বাধানিষেধ নেই । রঞ্জনের মাকে কেউ কেউ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখায়। এইবিষয়ে বিভার মা অত্যন্ত নির্বিষ। রক্তমাংসশূন্য কঙ্কাল । এ যে প্রাত্যহিক জীবনের অংশ ।

-কিছুটা অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালো রঞ্জনের মা ।

-বলছি না! আপনি কোটিপতি হবেন । আজগুবি নয় । সত্য। নিরেট সত্য।স্বগতোক্তির মতো বড় চঞ্চল হয়ে বলল এতক্ষণ ধরে চুপ করে থাকা দ্বিতীয় যুবকটি ।

-রঞ্জনের মা বলতে গিয়েও বলল না! যে বর্তমান সময়ে জগৎটাই চলছে মিথ্যার উপরে; সত্য কথা কারা বলে তা ভাবনার বিষয় । আর তোমরা!! চোখের ইশারায় বুঝাতে চাইল।

-অন্যায় কাজ করে কেউ কেউ তুমুল আনন্দ পায়!! আমরা না! আমাদের দ্বারা এই কাজ হয় না। জোড়াজোড়ি করে যেই কয়টা করেছি সবগুলিই কোনো কাজে আসে নাই। নষ্ট হয়ে গেছে । ব্যর্থ হয়েছি আমরা সবাই। কোথায়ও একটু উদাসীনভাব যুবকের কন্ঠে । পাশের জন বিড়বিড় করে কী জানি বুঝিয়ে দিচ্ছিল তাকে। টানটান চেহেরা ফরসা গালের যুবকটির ফিসফিসানি রঞ্জনের মা কিংবা বিভার মার কানে পৌঁছাল না । কথাবার্তায় চালু যুবকটির কণ্ঠস্বর এতক্ষণ মিনমিন ভাবের নিবেদনী ছিল । পাশের জনের ‘বীজমন্ত্র’ পেয়ে চোখের পলকে উল্টে গেলো । দক্ষ, চৌকশ, তুখোড়, দাম্ভিক ভাব এসে গেলো ।

– ঠোটে আলগা একটু হাসি নিয়ে যুবকটি যা বললো তা শুনে রঞ্জনের মায়ের কৌতূহল আরো বেড়ে গেলো । আমাদের অনেকেই অঘটনঘটনপটিয়সী। আমরা চাইলে রাতকে দিন, দিনকে রাত বানাতে পারি । একদম জলের মতো পরিষ্কার।

– চোখ একটাকে ট্যারা করে আরেকজনের দিকে ঈষৎ ইশারা করে ।

বেশভূষায় একটু বেশি ফিটফাট মুরুব্বি কিসিমের যুবকটি দীর্ঘক্ষণ গোমূর্খের মতো দাঁড়িয়েছিল। ভাবখানা এমন ছিলে যে দীর্ঘ এই অপেক্ষা আর কথোপকথন মুখস্থ করেছে। এতক্ষণ ধরে বুকের ভেতরে জমে থাকা ‘ক্ষোভ’ যেন একসঙ্গে-একটানে বেরিয়ে আসে । বিকট চিৎকার এর মধ্য দিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমনের ‘মিসাইল’ নিক্ষেপ করলো ,

– অনেকক্ষণ কথার দড়ি টানাটানি হয়েছে । আপনার এই ‘স্বর্গীয়’ বাড়িসহ সবকিছু আমাদের নখদর্পণে । গত একবছরে ধরে নিয়মকরে মাসে-পনের  দিনে অন্তত একবার এই বাড়ি ঘুরে গেছি। আমার ‘জানী দোস্তরাও’ জানে । আরাধ্য এই জিনিসটি দেখাশোনার পাশাপাশি পাহাড়া দিয়েও রেখেছি । পানগাছের ফুল এবং ফল সমকালীন এই প্রকৃতিতে অত্যন্ত বিরল। আপনারই আপনজন গ্রাম-সম্পর্কীত আমার এক চাচা এই পানমূলের তথ্য দিয়েছিল। এর অগ্রপশ্চাত ভালো-মন্দ গুণাগুণ বিবেচনা না করে আমরা বছর খানেক আগে এখানে প্রথম এসেছিলাম । তখন থেকেই কাহিনির অবতারণা । ফুল ফুটে যাওয়া পানগাছ মহামূল্যবান । কী পরিমাণ অর্থমূল্য তার হিসাব পাওয়া ভার ।

-স্বর কিছুটা নামিয়ে খুব আন্তরিক আর সরলমনে বলছে-সবগাছেই ফুল ফোটে । মওশুমে । পান গাছেও ।কিন্তু এই গাছ বিরল ব্যতিক্রম । মহাকীর্তির সারা বছর ধরে ফুল ফুটে যাচ্ছে ।  আরো কয় বছর আগে থেকে কে জানে?

– আপনার কী খেয়াল আছে? অসংখ্য সম্ভাবনাময় কালের সাক্ষী এই পান গাছের? পাশের পথে হাঁটলেই কিন্তু কাঞ্চনকৌলিন্য এই গাছের বিশেষ গন্ধ পাওয়া যায় । যারা অল্পবিস্তর জানে তাদের মাতোয়ারা করে । কী মনোহর!! ঠিক গোড়ার কাছে গেলে গন্ধের রহস্য আরো বেড়ে যায় ।

রঞ্জনের মাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে আবার বলতে লাগালো-কিছু বজ্জাত লোক কিন্তু এই পানমূলটি চুরি করার চেষ্টা করেছে । রাতের অন্ধকারে। গোড়ায় কিছু খোঁড়াখুড়িও করেছে। যাদের এটি নেওয়ার খায়েশ আছে তারা কালো টাকার মালিক। তবে তারা জানে না জোরজবরদস্তিমূলকভাবে ছুরি, কাঁচি ,খুন্তি, বল্লম, শড়কি, কোদাল ব্যবহার করলে এর গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। ধুলোবালিকাদামাখা অবস্থায় তুলে আনলে কোনো কাজেই আসবে না । এর মালিকের প্রতি কোনো অন্যায়, অবিচার ,অনাচার, জুলুমবাজী না করে ভালোবাসার ঝিলিক দেখিয়ে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে তুলে আনতে হয় । সকালের লালচে সূর্যের আলো হলে ভালো । সূর্যের উত্তাপের সময় না হলে সবকিছু অর্থহীন । আত্মবলিদানের করুণ দৃষ্টান্ত হয়ে যাবে । এইজন্যই আপনার কাছে আসা। এতো কথা!!

– করুণ মুখশ্রী নিয়ে কানখাড়া করে এতক্ষণ শুনছিল রঞ্জনের মা। পূর্বপুরুষের লাগানো, সমাজ উপকারী আর জীবনের জন্য দরকারি পানগাছটি নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে । গভীর ষড়যন্ত্র। এখানে কেবল রুই-কাতলা নয়, শোল, গজার, বোয়ালরাও জড়িয়ে গেছে ।  ঢেলা, মলা, কৈ, পুঁটিরাও উঁকিঝুঁকি মারছে। তাদের সামনে কোনো অনুনয় বিনয় খাটে না। বুঝা গেলো হ্্রদয় তাদের পাথরে গড়া। তাদেরকে দাবড়ানির উপর রাখবে। না ছড়াগানের সুর: ‘আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি’ কায়দা অবলম্বন করবে! ধন্দে পড়ালো। আজকালকার ফাজিল পোলাপান ময়মুরুব্বি কিছু মানে না । নিজেদের প-িতি কেবল জাহির করতে চায়। আর এখানে-তো কোটিপতি বানানোর পাঁয়তারা। একটিবারও ভাবলো না; কোথায়; কার সাথে!! কী আশ্চর্য!

জীবনে এখন পাকাপাকিভাবে ভাটার টান। যৌবন হারানোর নীরব অভিশপ্ত সময়। শরীর হালকা কেঁপে ওঠল। জন্ম থেকেই এই বাড়িতে। কতকাল-কতসময় ভয়কে জয় করেছে। ভয়কে চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে তার হিসাব নেই । ঐসব তরিকা শূন্যতামুখী । বাস্তববাদী, বাস্তবদ্রষ্টা, বাস্তবধর্মী রঞ্জনের মায়ের ধর্নুভাঙ্গা পণ তিন পুরুষের ঐতিহ্য এই পানগাছের মূল তুলতে তিনি দিবেন না। ফ্যারে পরে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলেন না!

আসলেই কোটিপতি হতেন।

তারপর-তো অনেক ইতিহাস।

 

 

সর্বশেষ

এই বিভাগের আরও