রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সোনার চেইন

খন রঞ্জন রায়

‘দুলালী’ যখন বাস থেকে দ্রুতবেগে ‘তেতুই’ গাছতলায় নামল তখন প্রায় সন্ধ্যা। শারীরিকভাবেও বেশ ক্লান্ত। সাড়ে চার ঘণ্টার বিরক্তিকর জার্নি। প্রান্তিক পরিবহন। চট্টগ্রাম- নবীনগর। বাড়িতে কোনাকুনি যাওয়ার অনুরোধী স্টপেজ। এই গ্রামে ঢুকার এমন আরও দুইটি আছে। যার যার সুবিধামতো নামে। সর্বশেষ স্টপেজ দুই কি.মি. পরে নবীনগরে।

কার্তিক মাসের শীতের হালকা আমেজ। পশ্চিমা কাশে সূর্যডুবার মুহূর্ত। সোনালী আভায় শুষ্ক গাছলতায় পীত রঙের সুবর্ণ সন্ধ্যা। দুলালীও পশ্চিমদিকে মেটোপথ ধরে এগুবে। কয়েকটা জমি, এরপর পাড়ার ভেতরের দিকে দুই তিন বাড়ি পার হলেই দুলালীর শ্বশুর বাড়ি। আইনগত যুক্তিসিদ্ধ নিজ বাড়ি। বাংলাদেশের সামাজিক রীতি অনুযায়ী বিয়ের পর মেয়েদের নতুন ঠিকানা হয় স্বামী-শ্বশুরের ঠিকানার বাড়িঘরে। দুলালীর বেলাও রদবদল হয়নি।bsrm

উপজেলা সদরের পৌরসভা এলাকায় ‘মিত্রাপুর’ নামের এই গ্রাম। নয়ন জোড়ানো মুগ্ধতা ছড়ানো সাজানো-গোছানো না হলেও মিত্রাপুর গ্রামটি ইতোমধ্যে দুলালীর অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছে। বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের রামলীলা তিথি ধরে তার বিয়ে হয়েছিল চট্টগ্রামে। জন্ম শহরে। ঠিক এক সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত সময়ের আয়োজনে।

শুক্লপক্ষের এই শেষ তারিখটিতে হিন্দুদের অনেক বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজন হয়। দুলালীর পরিবার শহরের কোনো কুলিন ক্লাব ব্যবস্থা-ভাড়া করতে পারেনি। তখন অবশ্য এতো ক্লাব-টাব ছিল না। মানুষের জীবনবোধের প্রয়োগ ছিল উজ্জ্বল। পড়শিরা ছিল কাছের-আপন।

চট্টগ্রাম বন্দর উত্তর কলোনীতে তাদের বাসার দেয়ালসংলগ্ন ছিল একটি মাঠ। মাঠের পূর্ব-উত্তর কোণায় একটি বড়সড় টিনশেড ঘর। ক্লাব ঘর। সাজানো গোছানো। রঙ মাখানো। আল্পনা আঁকা। এলাকার যুবাদের নিরন্তর সৃজনশীল কাজের অনিবার্য ঠিকানা। ওখানেই সুন্দর নান্দনিক সাজসজ্জা করে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। কোনো ধরনের বাছবিচারের সুযোগ ছিল না।ads din

আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতি ও নিয়তির এই বিয়েতে অনেকেই কষ্টসাধ্য শ্রম দিয়েছে। এই সময়ে বেশ কয়েকজনের নাম ঘিরে দুলালীর মর্মসন্ধানী কৃতজ্ঞতা বোধ জেগে ওঠলো। নৈতিকতার শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হিন্দু বিবাহরীতি। বিশ্বাসই নিরেট সত্য বিষয়। বাকীসব রীতি -আচারী। মঙ্গলাচরণ, পানখিল, দধি মঙ্গল, গাত্রহরিদ্রা, শঙ্খ-কঙ্কন, বরবরণ, সাতপাক, শুভদৃষ্টি, মালা বদল, বেদমন্ত্রের মাধ্যমে সম্প্রদান, বিবাহের মন্ত্র উচ্চারণ, কিছুক্ষণ বরের পাশাপাশি, কিছুক্ষণ মুখোমুখি বসে পুরোহিতের সাথে অগ্নিদেবকে  ঐশ্বরিক সাক্ষী করে মন্ত্র জপের সময়টা দুলালীর মনে পড়লো। কী অসহ্য অসহনীয় তপ্ত হাওয়া! গলগলে আগুন। টগবগিয়ে ওঠা। কুণ্ডলী পাকিয়ে লেলিহান অগ্নিযজ্ঞ। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে জলন্ত বাস্তবতা। বাঙালি হিন্দুদের আত্মমর্যাবোধের বিবাহরীতি। এতে দুলালী এতটাই মশগুল ছিল যে, বৈশাখ মাসের নজিরবিহীন গরমের মধ্যে আবার দাউদাউ করা আগুনেও খোশ আমদেদি মেজাজ ছিল।

কন্যাকে জামাতার হাতে সম্প্রদান করার শাস্ত্রসিদ্ধ কিছু নির্দেশনা আছে। দুলালীর জ্যেঠু এই অংশটুকুর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অগ্নি সাক্ষী রেখে বরকে কন্যার ভরণপোষণের দায়িত্ব অর্পনের মন্ত্র উচ্চারণ হয়েছিল সুরেলা সুরে।

‘যদেতং হৃদয়ং তব, তদ¯‘ হৃদয়ং মম।

যদিদং হৃদয়ং মম, তদ¯‘ হৃদয়ং তব।’

দুলালী কিছুটা আনমনা হয়ে যায়; ভাবে মেয়েদের ওপর স্বামীর কর্তৃত্বের ‘ছড়ি ঘোরানোর’ জন্যই কি এইসব মন্ত্রটন্ত্র!!

ঠিক এই সময়ে কালছে রঙের ছালওঠা একটা কুকুর দুলালীর তসরের কাপড়ের লাল পাড়ের শাড়ীর ঝুলানো আঁচলে একটু শুঁকে মেঠোপথ ধরে হন হন করে চলে গেলো। কুকুরের প্রতি দুলালীর বিশেষ দুর্বলতা আছে। তাই বলে চোখের পলকে কোথা থেকে কী ঘটে গেল! মনে হলো- অশরীরী আত্মার আনাগোনা।

দুলালীর স্বামী ‘দুলাল’ বাসযাত্রীদের মালামাল রাখার বাক্স থেকে নিজেদের সুটকেস, লাগেজ, কিছু বুঁচকা-পেটরা নামিয়ে একজায়গায় জড়ো করেছে। দুইজন যাত্রীর তুলনায় মাল সামানা একটু বেশি। নববধু নিয়ে গ্রামের বাড়িতে কয়েকদিন থাকবে বলে মন¯স্থির করে আসা। কাপড়-চোপড় ছাড়াও কিছু শুকনা প্যাকেট করা খাদ্যসামগ্রী, শহরের তরিতরকারি ও ফলফলাদির কয়েকটি পোঁটলা-পুঁটলি।

গ্রামের বাজারে সবই পাওয়া যায়। তবু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে আর দুলালীর প্রতি বিন্দুমাত্র অবজ্ঞা-অবহেলা হবে না এমন ভাব-ধারণা জন্মাতেই এই ব্যবস্থা। দুলালী অবশ্য কিছু রহস্য করতেও ভালোবাসে। এটাও তারই একটি অংশমাত্র!!

এর আগে দুলালী মাত্র দুইবার শ্যামল-নিসর্গের এই মিত্রাপুর গ্রামে এসেছিল। প্রথমবার নববধু হিসাবে বিয়ের ঠিক পরদিন, অঘুমা চোখে। বিয়ের দিন শাস্ত্রমতো নানা রুচিকর-অরুচিকর আচার আয়োজনের মধ্যে নির্ঘুম রাত কাটে। ভোরে বাঁসি বিয়ে শেষে বাবার বাড়ি চিরতরে ত্যাগ করে মন্ত্রপাঠে আইনসিদ্ধ স্বামীর সাথে। ঘুমে ডুলো ডুলো চোখে ‘স্বামী’ নামের সুদর্শন ছেলেটির কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে খুনসুটি আর আদর-সোহাগী আচরণে চার ঘণ্টার গাড়িভ্রমণ খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গিয়েছিল।

মুহুর্মুহু উলুধ্বনি আর বাদ্যবাজনার দম আটকানো আনন্দ-লহরির মধ্যে তৃপ্তিকর বৈচিত্র্যে হয়েছিল বধুবরণ। ঐ দিনই ছিল আলাদা ঘুমিয়ে সতেজ হওয়ার কাল-রাত্রি। পরদিন বৌভাত অনুষ্ঠান, ভাত-কাপড় উপহার আর সমাজের লোকজনের সাথে সৌজন্য দেখা সাক্ষাৎ। ঈষৎ-সংক্ষেপে। এর পরই হয়েছিল ফুলশয্যা। নানা নিয়ম-কানুন আর ভালোমন্দের ঘোরে কেটে গিয়েছিল কেরোসিন তেলের হারিকেন কুপিবাতির আলো ব্যবহার করা কয়েকটি দিন। অবিশ্বাস্য রকমের চকমপ্রদ সব অভিজ্ঞতা।

সন্ধ্যা নামলেই ছায়া শত্রুর মতো চারদিক ঘিরে ধরা ঘুটঘুটে অন্ধকার। গভীর ভাবব্যঞ্চনা। পিতৃভূমি ছেড়ে এসেছে ভিনভূমিতে। স্বামী বাড়িতে। অতৃপ্তির শূন্যতা না অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা পরস্পরের মধ্যে লুকিয়ে আছে তা কে জানে?

দুলালী ভাবে নিজ জীবনের বাঁকবদলের নান্দনিকতাও উপভাগ করে। ঘোরলাগা উপভোগ। আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতির উপভোগ।

সম্পূর্ণ নতুন এই পরিবেশ, মানুষজন, আত্মীয়স্বজন, অপরিচিত সুরের কথাবার্তা, বেশভূষা, নববধু বলে আগতজনরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার বিরক্তিকর মুহূর্তগুলিতে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়েছে তার স্বামী-দুলাল। কখনো কখনো দুলালীর অভ্যন্তরে রোমান্টিক বেদনা কাজ করে। নববধু হিসাবে ধীরলয়ে, নিঃস্বরে কথাবলার যে স্বভাবসিদ্ধ ঐতিহাসিক রীতি তা সে ভালোভাবেই রপ্ত করেছিল। সমস্যায় পড়েছিল অন্য জায়গায়; নিতান্ত নিরুপায় না হলে আত্মীয়স্বজন কাউকে ডাকাত পারছিল না। কিছু কিছু সমাজে আন্টি, আঙ্কেল সম্বোধন করে শেষ করা যায়। কিš‘ বাঙালির এই সমাজে সম্ভব নয়। কাকা, জ্যাঠা, জেঠি, বৌদি, মাসি, পিসি, খুড়ো, খুড়ি, মেসো, পিসে, ভাবি, খালা, দাদা, দাদু, নানি, শালা, বেয়াই, বেয়াইন, শালী, নানা, স্বামী-ভাসুরের নাম বলা মানা। এতসব শব্দের হালহদিস খুঁজে পারিবারিক কাঠামো ঠিকঠাক রাখা কিছুটা কষ্টকরই বটে। নতুন পরিবারে এসে তার গতিপ্রকৃতি বুঝে ভালোভাবেই তৃপ্তি অনুভব করছে দুলালী। দক্ষ প্রকাশভঙ্গির জন্য অল্পকয়দিনের ভেতর সে আত্মীয়-পরিজনের হৃদয়ে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। দেবর-ননদ পাড়া-প্রতিবেশির সাথে গল্প-গুজব-আড্ডা আর স্বামী দুলালের পরিশ্রমী মায়াবী চেহারা দেখতে দেখতেই সাতদিনের প্রথম মিত্রাপুর সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল।

শাশুড়ি, দিদিশাশুড়ির পায়ের ধুলো কপালে ঠেকিয়ে এক দুপুরে বাবা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। প্রায় চার ঘণ্টার দীর্ঘ পথ। লোকনাথ পঞ্চিকা দেখে দিদিশাশুড়ি আগেই দিন-তারিখ-বার যাত্রার শুভসময় ঠিক করে রেখেছিলেন। আতপ চালের গুঁড়ি দিয়ে উঠানের মাঝখানে সুলভ্য সংস্কৃতির আল্পনা করা অংশের ঠিক মাঝখানে পিঁড়িতে বসানো হয়েছিল। কাঁঠাল কাঠের চকচকা হলুদ রঙের পিঁড়ি। তাতে শিল্পবোধের আল্পনা। সামনে মঙ্গলঘট। কড়কড়ে শুকনা আতপধানের ওপর বসানো। ঘটের ওপর পঞ্চপাতার আম্রপল্লব, সিদুঁরে ‘স্বস্তিকা’ আঁকা। তার ওপর কচি ডাব। টকটকে লাল পাড়ের কাপড় দিয়ে ডাবের চারপাশ ঢেকে দেয়া।

দুলালী স্কিন প্রিন্ট জানতে কালার সাইন্স প্রফেশনাল ট্রেনিং-এ দুই একবার গিয়ে রঙ সম্বন্ধে কিছু জেনেছিল। স্বস্তিকা আঁকা ডাবের ওপর টকটকে লাল যে শাড়িটা চার ভাঁজ করে দেয়া আছে সেই রঙটিকে চিত্রশিল্পীদের ভাষায় ভার্মিলিয়ন বলে; তাও দুলালীর মনে আছে।

বাড়ির একান্ত আত্মীয়স্বজন ছাড়াও পাড়া প্রতিবেশি বিশেষ করে কাকিমা, মাসীমা, জেঠিমা গোত্রীয় স্বজন আর উৎসাহী শিশু-কিশোর ছেলে-পেলেরা গোলাকার করে উঠানের রৌদ্রে দাঁড়িয়ে বধু বিদায়ের বিনেপয়সার দৃশ্য উপভোগ করছিল। মুষ্ঠিবদ্ধ দূর্বাঘাস আর ধান কপালে ঠেকিয়ে মাথার ঘোমটার ওপর ছিটিয়ে দিয়ে মুখরিত উলুধ্বনির মাধ্যমে বিদায় জানানো হয়েছিল।

পাড়ার ভেতরের কয়েকটি বাড়ির দুপায়া মাটির পথ পাড় হয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠেছিল। পূর্বপরিচিত ড্রাইভার তার নিজস্ব গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সাথে সাথে সাঁই সাঁই করে নবীনগর-কোম্পানীগঞ্জ রাস্তা ধরে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছুটছিল। রাস্তার দুইপাশের ঝোপানো গাছের বৃষ্টিধোয়া গাঢ় সবুজ পাতারা দুলালীকে সম্মানের সাথে বিদায় জানাচ্ছিল। পাশে বসা দুলালও কিছুটা আনমনা হয়ে কাঁধের ওপর দুলালীকে ধরে রাখলো। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে নীল আকাশ উজ্জ্বল না হয়ে ঘোলাটে হয়ে দেখা দিচ্ছিল।

মিত্রাপুরের প্রতি ভালোবাসা পুরোপুরি সমর্পণ করে- মাঝখানে সপ্তাহখানের জন্য দুলালী নতুনকরে নিজের শেকড় গ্রাম ঘুরে গেছে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে হারিকেনের নিভু নিভু আলোতে ভূতুড়ে নির্জনতা উপভোগ করেছে। শাশুড়ির অভিজ্ঞ হাতের তেলেঝালের রান্না খেয়ে সময় কাটিয়েছে। ‘হ্যাবলার’ মতো অভিনয় করে  নিজেকে সামলে নিয়েছে। মানুষের জীবন যে নাটকের কাহিনির চেয়েও ঢের বেশি নাটকীয় স্নেধন্যভাবে তা উপলব্ধি করতে পেরেছে।

রিক্সা যখন বাড়ির আঙ্গিনায় এসে থামলো তখন সন্ধ্যার আকাশে দিনের বিদায়ী সূর্যের ছাপ। বাড়ির পশ্চিম দিক খোলা বলে দুলালীর মেরুণ রঙের বিয়ের সুটকেসের কানায় লালচে আলো পরে চিক্ চিক্ করছিল। সূর্যের রঙের অদ্ভূত এই আলো-আধাঁরির খেলা দুলালীর মনকে এক ঝলকে প্রফুল্ল করে তোলে। দীর্ঘ বাস ভ্রমণের সব যন্ত্রণা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। বাড়ির আশ-পাশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের রিক্সা ঘিরে ধরে বোঁচকা-পেটরা, লাগেজ, সুটকেস নামানোর আনন্দ-উল্লাস শুরু করে। শাশুড়ি প্রায় দৌঁড়ে এসে কুশলতা জিজ্ঞাসার আগে তাকে জড়িয়ে ধরে। মাথা ঝোকে সামনে এসে গালে গাল লাগিয়ে আগমনী সম্ভাষণ জানায়। হাত ধরাধরি করে বসতঘরে নিয়ে যায়। পুত্রবধু ‘ন্যাওটা’ এই শাশুড়ি দুলালীর জন্য এক স্বর্গীয় প্রাপ্তি।

সংসারে কত কিছুই তো ঘটে। কুৎসা, নিন্দা, ষড়যন্ত্র, এইসব শব্দ দুলালী শুনেছে মাত্র। কিন্তু‘ তার জীবনে এইসব ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাতে সে কিছুটা হতবাকও হয়।

পূর্বপরিচিত এলাকার রিক্সাওয়ালার ভাড়া খুশি হয় মতো পরিশোধ করে। গ্রামীণ ছেলেপুলেবেষ্ঠিত হয়ে কাঠকেওয়ারী চৌচালা ঘরের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে ঘরে ঢুকে দুলাল। সরকারি চাকুরিজীবী ঘরের বড় ছেলে সন্তান দুলাল এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। কৈশোর উত্তীর্ণকাল থেকেই মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হয়। কোনোরকম উচ্ছৃঙ্খলতায় জড়িত হয় না। বরং বন্ধুস্বজন পাড়াপড়সিদের ভ্রান্ত ও গর্হিত কাজ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। শৈশবে পাড়ার এক ‘কৃষ্ণপ্রতিভা’ বড় ভাইয়ের সঙ্গে মিশে এইগুণ অর্জন করেছিল। সেই সময় থেকেই তার ধারণা জন্মেছিল সকল মানুষ একে অপরের ভাই-ব্রাদার। কারো প্রতি বিদ্বেষ, বিরোধিতা, বিষোদগার করা অন্যায়। মানুষ দৈর্ঘ্য বা প্রস্তে নয়, চিন্তার ব্যাপ্তিতে বড় হয়। জনপ্রিয় হয়। দুলাল সেই বড় ভাইয়ের ভাবশিষ্য হয়ে আনন্দের  স্রোতে ভাসে। নিজের জীবনে দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন প্রয়োগের চেষ্টা করে। অন্যদেরও তালিম দেয়। বিশেষকরে শিশু-কিশোরদের। এই বয়সটাই মনুষ্যজীবনের ‘বালাইষাট’। তাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে যতটুকু সুযোগ পায় তাতে তাদের সাথে লেপ্টে থাকে। আদর-সোহাগ জানিয়ে সামান্য চকলেট, বাতাসা, কদমা দিয়ে কাছে টানে। বা”চারাও দুলালের ছায়াসঙ্গী হয়। বাড়িতে পৌঁছার খবর পেলেই সব ধরনের দস্যিপনা ফেলে ‘জাদুর বাক্সর’ মতো দুলালকে ঘিরে ধরে। অকল্পনীয় আনন্দের অফুরান উৎস হয় দুলাল। আজও তাই হলো।

এবার মাস দুইয়েকের বিরতি। এরপরও দুলালের মনে হয় যেন কতকাল পরে জন্মভিটায় পা ফেলেছে। শৈশব কৈশোরের দুরন্তপনা; দুষ্টুমি আর সারাদিন ছোটাছুটির স্মৃতি তার মনে পড়ে। চদ্রি বাড়ির ময়লা পানির পুকুরে ছেলেমেয়ে একসাথে  স্নানের নামে দাপাদাপি, ডুব দিয়ে পলাপলি খেলার মুহূর্তগুলো তার সামনে ভেসে ওঠে। ঘটনাবহুল কৈশোরের কাণ্ডকারখানার হিসাব নিয়ে জটিল জালে বন্দি হয়। স্মৃতির খাতায় ভাবনাগুচ্ছের সংযুক্তি তার জীবনের বড় রহস্যময় -অভিনব অংশ। দুলাল ভাবনার ডালপালা এইদিকে না মেলে দুলালীর চোখে চোখ রেখে ঠোঁটের কোণে একটা উচ্চাঙ্গের হাসি দিল।

হারিকেনের সলতের চাকতি যতদূর সম্ভব বাড়িয়ে ঘরে আলো ফুটানোর কায়দাপূর্ণ চেষ্টা করেছে দুলালীর দিদিশাশুড়ি। নব্বুইঊর্ধ্ব বয়স। এখনো টনটনে। একটু কুঁজো হওয়া ছাড়া তেমন কোনো রোগবালাই নাই। আটপৌরে এই বৃদ্ধা কথাবার্তায় আচার-আচরণে, কর্মগুণে বেশ ‘তাজা মানুষ’। বয়সের ভারে কিছুটা কুঁচকে গেছে গলা ও চোয়ালের চামড়া। কিন্তু দুধে আলতা রঙের  কারণে বরং উজ্জ্বল দেখায়। নাক-কান-চোখের দুর্দান্ত অভিব্যক্তি দুলালীর দিদিশাশুড়িকে ‘গাঁও গেরামের’ মানুষ মনে হয় না। সংসার-কাজে ভাব এমন দেখান যেন ‘সাতেও সেই পাঁচেও নেই’। আসলে তিনি আছেন সবখানে। সর্বত্র। সর্বময়। ক্ষেত্রবিশেষে নীরবে-সরবে। গালগল্পও বেশ জানেন। ভাবখানা এমন যেন সিনেমার কাহিনি নয়, বাস্তব, পরাবাস্তব। হাসান, কাঁদান, গল্পের মোচড়ে বিস্ময়ে অভিভূত করে তোলেন। কখনোবা হতবাগ হতে হয়।

এলাকার মানুষের দুষ্কর্ম, কুকীর্তি, অপকীর্তির ঘটনাও তরতরিয়ে বলেন। নতুন অতিথি বলে দুলালীর নিকট কখনো অভিনয় মনে হয়। কখনো বা আকর্ষণ জাগে। আরো বেশি করে শোনার আগ্রহ জাগে, মুগ্ধতা সৃষ্টি করে। এই মুগ্ধতা ক্রম অতিক্রমধর্মী।

– তেমনই একটি ত্যৎপর্যময় গল্প সিঁধেল চোরের কাহিনি। ব্রিটিশ-পাকিস্তান-বাংলাদেশ তিন আমল দেখা এই দিদিশাশুড়ি আকারে-ইঙ্গিতে গল্প বানাতে চেষ্টা করছেন। বলছেন কখনো এই মিত্রাপুরের মানুষ সিঁধেল চোরের দৌরাত্ম্যে নাকাল হয়েছে।

– এক সন্ধ্যার এই গল্প; হারিকেনের আলোয় ঘরের ব্যবহার্য জিনিসপত্র আবছা-আবছা দেখাচ্ছিল। কিন্তু দখিনের জানালা খোলা থাকায় ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলালীর শরীর-মন জুড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছিল জ্বীন-পরির কল্প-গল্প শুনছে।

-এর মধ্যে সিঁধেল চোর।

আরো খায়েশ হলো, আগ্রহ জাগলো সিধেঁল চোরের ‘তামাশা’ বিষয়ে জানতে। সিঁধেল চোরের লোমহর্ষক কাহিনি নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি নাটক দেখেছিল দুলালী। ভাসাভাসা মনে পড়ছে। জীবিকার সংগ্রামে জর্জরিত দুঃখ-বিষাদ, অতৃপ্তি, একাকিত্ব ও অপ্রাপ্তির বেদনা নিয়ে সত্য ঘটনা অবলম্বনে সৃষ্টি এই নাটক। অবিরাম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জীবিকা সন্ধানী এই চোরের কাহিনিটি কী ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের!

-দুলালীর চিন্তা জগৎকে উস্কে দেয়।

-সিঁধেল চোরের সঙ্গে ছিঁচ্কে চোর, ডাকাত, বাটপার, জোচ্ছোর, চশমখোরদের গুষ্টিসুদ্ধ সত্য গল্পের নাটকটি কী একেবারে নবীনগরের এই গ্রামের কাহিনি!!

-এখন যেখানে বসে দিদিশাশুড়ির মুখে রসালো গল্প শুনছে; ঠিক এই গ্রামের!!

-আতঙ্কে দুলালীর গা ছমছম করে ওঠল। শিউরে ওঠার মতো অবস্থা।

এক হাতে কেরোসিন তেলের হারিকেন অন্য হাতে চাপাকলের জলসহ পিতলের লোটা-গ্লাস শক্ত হাতে ধরে দুলালকে ঘেঁষে ঘেঁষে উঠান পার হলো। ঘুমের প্রস্তুতি। তাদের জন্য বরাদ্ধ করা আলগা ঘর। পুব ভিটার।

দুলাল টিনের দরজার শিকল খুলে দিতেই বিশেষ তাড়াহুড়া আর ঠ্যালা ধাক্কার মতো করে চৌকাঠ লাফিয়ে ঘরে ঢুকলো দুলালী।

দুলাল-দুলালী এই নিশুতি রাতে আশ মিটিয়ে আলাপ-আড্ডা জমাবে এই ভাবনায়!!

না !! মোটেও না।

– টান টান উত্তেজনায়। সন্ধ্যা রাতে দিদিশাশুড়ির কাছ থেকে শোনা সিঁধেল চোরের ব্যতিক্রমী গল্পগুলোয়। এই চোরেরা নাকি অন্ধকার পছন্দ করে। অমাবস্যার অন্ধকার। দৈবক্রমে আজ অমাবস্যা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সামান্য তফাতে গেলে কিছু দেখা যায় না। অদ্ভুত ভূতুড়ে পরিবেশ।

-দুলালী কোথা থেকে জানি শুনেছিল অমাবস্যা রাতে আন্দাজে চলাফেরা করে গ্রামের মানুষ। নিজের হাত অন্ধকারে মেলে ধরলে তা দেখা যায় না।

– দুলালী অবশ্য সেই চেষ্টা করেনি। পশ্চিমের বসতঘর থেকে মাটির ভিটের দোচালা পূর্বের এই ঘরে আসতেই তার ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে। মাঝখানের মোটামুটি বড়সড় উঠানের চারপাশে লাগানো ফুলের গাছে ফুটে থাকা ফুলের সুঘ্রাণও নিয়েছে। হেঁটেছেও কয়েকবার। খাবার ঘরের দরজাকে ঠেস দিয়ে আলগোছে চালের টিনে বেড়ে ওঠা ঝাকড়া এক বাগান বিলাস। অসংখ্য হলুদ ফুল মাথায় নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দুলালী হাউস মিটিয়ে সন্ধ্যায় তা দেখেছেও।

সমস্যাটা বাঁধে অমাবস্যা আর সিঁধেল চোর সমান্তরালভাবে একই দিনে, একই ক্ষণে, দুর্ভাগ্যক্রমে নাড়াচাড়া করা। লেপ্টালেপ্টি অবস্থায় তেড়েমেড়ে আসায়।

দুলালীর চারদিকে দূষিত বাতাস। তাকে জরাক্রান্ত করে। বড়শির কাঁটার মতো মনে গেঁথে আছে। অন্ধকারেও চারদিক মাতিয়ে রাখছে জলজ্যান্ত গুল্পগুলো। সিঁদ, লোহার সাবল, গলাখাঁকারী, তন্ত্রমন্ত্র, খালি গা, শরীরে বিশুদ্ধ সরিষার তেল মেখে কুঁচকুঁচে করা, পিচ্ছিল করা, কড়ানাড়া, লালসালু কাপড় আরো ‘চুলবুল’ কতকিছু মনে পড়ছে।

– টাঙ্গানো মশারি একটু ফাঁক করে নতুন খাটে পাতানো ধবধবে বিছানায় ঢুকলো দুলাল।

-একগাল শব্দহীন হাসি দিয়ে দুলালীও খাটানো মশারি অনুসরণ করলো।

সাত মাসের সংসার। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা, নির্ভরতা, সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত  হয়েছে। এরপরও দাম্পত্য জীবনে প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, আশা, প্রত্যাশার দোলাচল টপকানো সারাজীবনের আফসোস।

এরই নাম সংসার! এটাই দাম্পত্য! স্বামী-স্ত্রীর খুঁনসুটির অনুসঙ্গ।

– দুলাল বিছানা থেকে একটু সামনে ঝুঁকে- মশারির কোণায় হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিলে রাখা হারিকেনের চাকতি কমিয়ে ঘরের আলো নিভু নিভু করে নিল। দুইজনের মাঝখানের ‘ব্যারিকেট’ দেয়া কোলবালিশটি পায়ের দিকে ঠেলে দিল। কিছুক্ষণ দুইজনেই চুপ থাকলো।

দুলালী অব্যাক্ত যাতনা চেপে রেখে অভিমানী ভঙ্গিতে পাশ ফিরতেই দুলাল তীব্র আবেগে জড়িয়ে ধরল।

= সাথে সাথে ছাইচাপা ক্ষোভ ছলছল গর্জন করে ওঠল। কিছুসময় দুলালকে তুলাধোনা করল।

-দুলাল টুটাফাটা ইয়ে, মানে, অ্যাঁ, উহু করে দুলালীকে শান্ত করে নিল। যেন বিরাট ‘ক্যাচাল’ না হয়। শান্ত হয়ে কানাঘুষায় বলাবলি চলে। দুইজনের গলা আবেগে জড়ায়। অতঃপর “নাটের গুরু” হয়ে আবির্ভূত হয় দুলাল। শব্দাতীত শব্দে আবেগের  স্রোতে আছড়ে পড়ে নিরিবিলি এই ঘরে।

– শেষে ‘কইতরের এই জোড়া’ কালঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

– দুলালীর ঠেলা-ধাক্কা আর ভয়ার্ত চেঁচানিতে দুলালের ঘুম ভাঙ্গে। কাঁচা ঘুম। পুরোপুরি চেতনাহীন।

– কী ঘটনা, সো হোয়াট? দুলাল অর্ধচেতনে বলে

– ঘরে কে জানি ঢুকেছে। আমার গলার সোনার চেইন ধরে হেঁচকা টান দিয়েছে। দুলালীর ভীতিকর কাঁপাকাঁপা স্বর।

ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে নাড়াচাড়া করার শক্তি হারিয়ে দুলালের ‘বোবা ধরা’ অবস্থা। মুখে আওয়াজ করার সামর্থ্য নেই। অনেক চেষ্টা শেষে আড়ামোড়া খেতে খেতে একটু গোঙানি দিল।

হারিকেন নিভিয়ে ফেলা নিকষ অন্ধকার ঘরে অশরীরী হাঁটার দুপ দুপ শব্দ কানে ভেসে এলো। ঘুমের পক্ষাঘাত বা কয়েক সেকেন্ডের স্লিপ প্যারালাইসিস শেষে দুইজনের সম্মিলিত চিৎকার।

দুলালীর দিদিশাশুড়ির পাতলা ঘুম। গোঙানির শব্দেই টের পেয়ে পশ্চিমঘর থেকে হারিকেন-লাঠি হাতে উঠানে। ততক্ষণে প্রতিবেশিরাও হাঁকডাক, হুড়াহুড়ি, হৈ চৈ করে খাঁচাবন্ধি দুলালীদের ঘর-ঘিরে।

-সব ঠিকঠাক আছে কি না দেখতেই বিস্ময়-মহাবিস্ময়, চোখ-মুখ আর্দ্র করা নির্দয় বিস্ময়। পিদ্দরের দোয়ারের ঠিক নিচে ছোটখাট খাল আকৃতির কাটা-সিঁদ।

সিধেঁল চোরের মমতাহীন কাজ।

লেখক- প্রবন্ধিক ও সমাজকর্মী।

 

 

সর্বশেষ

এই বিভাগের আরও