রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ভিখারি

খন রঞ্জন রায়

রুম নম্বর – ০৭, উকিল কলোনি, ডিসি রোড, চকবাজার, চট্টগ্রাম। নামে রুম হলেও আসলে টিনশেড ও কাঠের দরজা জানালাসহ পাশাপাশি ২টি রুম; ছোট আকারের একটি রান্নাঘর ও একটি বাথরুম কাম টয়লেট। বিত্তহীন, নিম্মবিত্তের ছোটখাট পরিবারের ‘সবর ও শোকর’ হয়ে বসবাস করার কাঙ্ক্ষিত বাসা। কলোনি নামের আলাদা মাহাত্ম্য আছে। সারি সারি বাসা। মূল গেট থেকে কলোনিতে বসবাসকারীর সবার মূল দরজা দেখা যায়। স্পষ্ট। পরিষ্কারভাবে। দুই সারি বাসা। মাঝখানে ফাঁকা লম্বাটে। উঠান আকৃতির। কলোনি বাসার বৈশিষ্ট্য। এই ফাঁকা জায়গাটিই বসবাসকারী সকল বয়সী বাসিন্দার আড্ডাস্থল। বাচ্ছাকাচ্চাদের খেলাধূলার স্থান। ঝগড়া-বিবাদ, বিচার-আচার বসার মোক্ষম জায়গা।

সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি এই ফাঁকাতে কী না হয়। বান্দর খেলা, সাপের নাচন, শিঙা লাগানো বা হিজামা করা, দাঁতের পোকা বের করা, ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ আরো কত কী। এখানের বাসিন্দাদের দরজা-জানালা বন্ধ করে বন্দি হয়ে থাকার সুযোগ নেই।bsrm

কলোনীতে বসবাসকারীদের কারো ছোটখাটো কারখানা আছে। কেউ তেলের আড়তে চাকুরি করে। কেউ বেকারিতে, না হয় গার্মেন্টেসে। কেউ আবার ছাপাখানায়। কেউ ম্যালা মেন্নত করা দৈনিক শ্রমজীবী, শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবী। বীমাকর্মী, দোকানদার, স্বাস্থ্যকর্মী, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ব্যাচেলর বাসা, ফ্যামিলির সরগরম। এটা সেটা অনেক রকম ধরন ও কিসিমের।

কলোনির শেষ প্রান্তের একটি ইউনিটে কোচিং সেন্টার। আগমনী কোচিং সেন্টার। ১ম-১০ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের আনাগোনায় মুখরিত। কখনো হাসির কলরোল ওঠে। শুরুর দিকে। একেবারে রাস্তা বরাবর একটি ওষুধের দোকান। অবশ্য দোকান বললে কিছুটা ভুল ও অপমানজনক হবে। ওখানে মাদল বড়ুয়া নামের একজন ‘পল্লী চিকিৎসক’ বসেন। স্বজন-পরিজনহীন। বয়স্ক ব্যক্তি। বলা যায় যমের হাতে হাত ধরে চলেন। কিন্তু এলাকায় অনেক প্রভাব আছে। আবার সমাজে সময়ে সময়ে বেড়ে ওঠা অস্তিত্বহীন অপাঙ্ক্তেয় লোকজনকে জমা-খরচ দিয়ে চলেন। ঠিক এর পরের রুমটিই ‘কাজী অফিস’। এখানের সামনের কক্ষে গদিআটা চেয়ার। মানুষের সৃষ্টিচক্রের নিয়মে এখানটা অহর্নিশ জমজমাট। জীবন মানুষকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেয়। কত কিসিমের লেভেল আঁটা মানুষের আনাগোনো তার ঠিকঠিকানা সেই। পলিটিশিয়ান। বিজনেসম্যান, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, সিভিল সার্জেন্ট, নিরাপত্তা বাহিনির লোকসহ হোমড়া-চোমড়া ক্ষমতাহীন, ক্ষমতাশালী সব শ্রেণি-পেশা মানুষের নিরাপদ নির্বিঘ্ন নিশ্চিত আশ্রয়স্থল। মূল কাজী সাবকে অনেকে চিনে না। উনার দুই সহকারি সাহাবউদ্দিন ও রওশন মিয়াজী সার্বক্ষণিক। ইভেন রাত্রীকালীনও এখানে থাকার কারণে সবার সাথে সখ্যতা। বলা যায় গভীর আত্মীক সম্পর্ক।

সাহাবউদ্দিন গায়ে-গতরে, আচার-আচরণে, পোশাক-পরিচ্ছেদ আসল কাজী সাবের একেবারে ‘ব্লু প্রিন্ট’। আদর্শগত অবস্থান বিচার-বিশ্লেষণ করলে সাহাবউদ্দিন-ই কাজী সাব। কলোনির  বাসিন্দারাও ‘হাপুস নয়নে’ উনাকেই কাজী সাব ডেকে অহেতুক ক্ষেপিয়ে দেয়। নাদুস -নুদুস চেহারার কারণে অনেকে চাঁদের কণা মিছরি দানা”ও ডাকে। ২৮-৩০ বছর বয়সী সাহাবউদ্দিন সাবকে লুঙ্গি মালকোচা, মাথায় টুপি ও হাতে তসবি ছাড়া কেউ দেখেছে এমন নজীর নেই। ভেরি ইন্টারেস্টিং যে, অনেক ক্ষেত্রে আচানক হতে হয়, অবারিত এই টীকাটিপ্পনীর মধ্যে তিনি কেবল বলেন-ads din

‘আই লাভ ইউ, ডিয়ার লয়ার’

এই কলোনির বাসিন্দারা আসলে ভাগ্য না যোগ্যতায় আনন্দফূর্তির মধ্যে বসবাসের সুযোগ পেয়েছে তা তর্কসাপেক্ষ।

সবচেয়ে রহস্য। পুঞ্জীভূত রহস্য। ০৭ নম্বর রুমটি। এতএত সুন্দর কিছুর মধ্যেও এই রুমটি সদাসর্বদা তালাবদ্ধ থাকাটা বড় বেখাপ্পা। কিন্তু ভাড়াটে আছেন। অন্য বাসিন্দাদের তেমন আগ্রহ না থাকলেও ঠিক পাশে ৬ নম্বরের বাসিন্দা অনল এটাকে বহু তাৎপর্যপূর্ণ মনে করে।

জমিদারের সহকারি থেকে কৌশলে চলমান ভাড়াটিয়ার নাম সংগ্রহ করে নিয়েছে। সহকারি কুদ্দুস শিউর করেছে ওখানে ফ্যামিলি থাকে। আসলে নির্ঘাত সত্য কে থাকে কেউ জানে না। অনল; কুদ্দুসের সাথে তর্কজালে আটকালো না। কুলি-মজুর যে কেহ থাকুক আর না থাকুক জমিদারের সমস্যা নাই। বরং কেউ না থাকলেই সুবিধা। পানি-বিদ্যুৎ ইত্যাদি খরচ হবে না। ভাড়া যথাসময়ে আদায় হলেই-সই। সর্বার্থে সঠিক। কুদ্দুস কিছুটা সন্দহের সাথে অনলকে এটা নিয়ে গুঁতাগুতি না করতেও নিষেধ করে দিয়েছে।

যৌবনের চৌকাঠে পা দেয়া অনলের কৌতূহল আরো বেড়ে গেলো। রুম নম্বর-৭। তার কল্পনার আকাশে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। কখন, কে, কোন সময়ে ৭ নম্বরের তালা খুলে ভেতর ঢুকে তা জানা অনলের প্রাত্যহিক রুটিনের অংশ হলো। একা একা এই রহস্যজট খুলতে পারবে; পারলেও কী হবে। কিংবা হতে পারে এইসব নিয়ে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলায় দোল খায়। এখানে হয়তো টাকাকড়ি লাগবে না। কিন্তু বিষয়টি আগ্রহ উদ্দীপক; সুড়সুড়িদায়ক। হয়তো বা বিপদজনক। দেশের যে রাজনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতি। চারদিকে উলঙ্গ চর্চার প্রতিফলন, কী অর্থনীতি; কী রাজনীতি; কী সমাজ-সংস্কৃতি সর্বত্রই মানুষের আগ্রাসী মনোভাব। সবাই ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো।

-অনল কিছুটা আতংকগ্রস্ত হয়। কে জানে এই বাসার ভাড়াটিয়া নিয়ে জমিদারের কোনো কুমতলব আছে কী না; ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে তাদের বেশ জানাশোনা। বিপরীতে নিজেরাই-তো বেশ দাপুটে ক্ষমতাশালী।

অনলের রুমমেট বশর হঠাৎ করে এক সন্ধ্যায় হাত কচলে বলে-এসব ঝামেলায় না জড়ানোটাই উত্তম। যার মরা সে মরুক। কথাটার মধ্যে একটা গুরুত্ব আছে। আছে একটা অশনিসংকেত। বশর একটু খাটাশ প্রকৃতির ও ভেতরগুঁজা। কিন্তু তলে তলে সবার সাথে বেশ খাতির। কুদ্দুসের সাথে কুটুর কুটুর কী সব কথাবার্তা হয়;

কুদ্দুস-বশর নিয়ে বাতাসে অনেক হাবিজাবি কথা ভেসে বেড়ায়। সবচেয়ে জোড়ালো ও যুক্তিসংগত হলো ব্যবসা। স্থানীয় এই জমিদারের অঢ়েল সম্পদ। কানি কানি জমি। এইসব জমিতে একটা-দুটো ছোটখাট দালানকোঠা আছে। কিন্তু বেশিরভাগই ফাঁকা। কিংবা ডোবা। ডেভেলপারদের খপ্পরে তখনো পড়েনি। আলোচিত দুই সাগরেদ মিলে ঐসব জায়গা ব্যবহার করে বাতিল সব জিনিসের ব্যবসা করে। ভাঙ্গারি ব্যবসা। কাঁচের টুকরো, ওষুধের খালি বোতল, প্লাস্টিকের ভাঙ্গা ড্রাম, ঢাকনা, ব্যাগ, ভাঙ্গা চিরুনি, ছেঁড়াজুতা, টিনের টুকরো, মরচে ধরা লোহার টুকরা-টাকরা, বালতি, জগ, পুরান তালা, চাবি, চাবিরগোছা, টিউবলাইটের হোল্ডার, পাউডার-শ্যাম্পুর টিউব-কৌটা, ভাঙ্গা-টেলিভিশন, রেডিও, পুরান-ভাঙ্গা খাট, পা ভাঙ্গা চেয়ার, সাইকেলের টায়ার-হ্যান্ডেল, মোমদানি-ফুলদানি-সুরমাদানি-সাবানদানি, আয়নার ফ্রেম, পাখির খাঁচা, খেলনা, পানির পাইপ, দোলনা-ঝুলনা, রড-বাটখারা আরো আজানা-অচেনা কত কিছু।

হাওয়াই খবর; কামাই নাকি বেশ ভালোই জমেছে। কোন দুঃখে বশর-কুদ্দুস মুখোমুখি হবে। বশরের সাফ জবাব-ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াক অনল; তাতে আমার কী? কথাবার্তা আচার- আচরণ অনেকটা প্রভুসুলভ।

– অনল দমে না; কলোনির এক ইউনিটে কয়েকজন ছাত্র মিলে ব্যাচেলর বাসার একজন আসিফ; বেশ চটপটে, চট্টগ্রাম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ে, তার বড় ভাই শফিক এই বাসাতে থেকেই পড়ালেখা করে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তাও কাঙ্ক্ষিত সাবজেক্ট। আইন। ছুটি হলে বা পেলে গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির সুন্দরপুর বাবা-মার সাথে দেখা করেই এখানে চলে আসে। কলোনির যাঁরা খোঁজ খবর রাখে তাকে ‘সাবাস বেটা’ বলে পিঠ চাপড়ে দেয়। অনল এক পড়ন্ত বিকেলে ৭ নম্বরের কাহিনি নিয়ে আইনের ছাত্র শফিকের সাথে শলাপরামর্শ করে। দীর্ঘ আলোচনা শেষে জিজ্ঞেস করে।

– ইউ মে নট লাইক ইট; আর ইউ ইন্টারেস্ট ইন দিস প্লিসেন্ট্রি রুম নাম্বর সেভেন?

-গরম শিঙারা খান; ছোট চৌপায়া টেবিলের ওপর রাখা কাগজের ঠৌঙার দিকে ইশারা করে শফিক বলে।

– আই নিড ইয়াংম্যান লাইক ইউ; বলে অনল।

হাতে থাকা বল পয়েন্ট কলমটি টেবিলের এক কোণায় ঠুকতে ঠুকতে শফিক বলে- ইন্টারেস্টিং। ভেরি ইন্টারেস্টিং কেইস। ভর্তি পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়ার সময় ৭ নম্বর রুমের তালা খোলার আওয়াজ পেয়েছি। কিন্তু কোনো মানুষজন দেখিনি। দরজার পাশে লোহার ফেমের যে জানালাটা খোলা জায়গা বরাবর ওটাওতো সবসময় আটকা থাকে। ভেতরের দিকে একটা ময়লা ছেঁড়া লুঙ্গি দিয়ে আয়নাগুলো ঢেকে দেওয়া। পর্দা সদৃশ।

ভেতরে বিজলী বাতি জ্বালাতেও দেখেছি। বাট অনলি ফিউ সেকেন্ড। দেন অফ।

– ভেতরের তামাসা কী? বেশি কিছু জানার আগ্রহ ছিল না। এখন-তো রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। জানতে ইচ্ছা করছে। ফিল গুড স্টোরি। কিন্তু আমার যে আগামীকাল ক্লাশ শুরু; আজ রাতেই ঢাকা যাচ্ছি। থাকলে আপনাকে সঙ্গ দিতাম।-

উইশ ইউ গুড লাক বলে বিদায় নিল শফিক।

শফিকের ভাবনায়-বাসনায় অনুকম্পা। অনলকে উদ্দীপ্ত করলো। জয় বাবা ভোলানাথ, বম বম ভোলানাথ, মনে মনে জপ করে এই রহস্যের মূলোৎপাটনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। দেশে চলমান বিরূপ-বৈরী রাজনীতির কারণে অনেক সচেতন নাগরিক বিচলিত-বিক্ষুব্ধ। কিন্তু অনল নির্লিপ্ত। গাছাড়াভাব; গা সওয়া অবস্থা। সকাল-সন্ধ্যা চাকুরি। কখনো বিকালের; কখনো রাত্রীকালীন ডিউটি করে। নিজ পেশার প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা রেখে চলে। ক্লান্তিহীন প্রহরী হয়ে পেশার লোকজনকে একত্রিত করে। সংগঠন বানায়। অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হয়। লেজ গুটিয়ে বসে না থেকে নিজেদের অধিকার সমূহে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করে। অনেকে আকথা-কুকথা বললেও বুদ্ধি-কৌশল আর যুক্তিতে কাটিয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক সংগঠন করে। কবিতা আবৃত্তিতে বিশেষ ঝোঁক। সময় পেলেই দৌঁড় দেয় নিউ মার্কেট মোড়ে। দোস্ত বিল্ডিং-এ।

তরঙ্গভঙ্গ সাংস্কৃতিক দলের অফিস। পুরনো-পরিত্যক্ত ৬ তলা দালানটি যে যেভাবে পারে দখলে নিয়ে অফিস বানিয়েছে। সংস্কৃতিকর্মীরাও ফুরফুরে মেজাজে কয়েকটি রুম দখল করতে পেরেছে। বিবেকের স্বাধীনতা নিয়ে প্রগতিমনা অনেকের আড্ডা জমে এই বিল্ডিং-এ। নাটক, গান, কবিতা, একক, দ্বৈত, কোরাস যে যার নির্দেশনামতো চর্চা করে। রিহার্সাল চলে। প্রতিবাদী জোশ প্রখরভাবে আছড়ে পড়ে পুরো বিল্ডিং জুড়ে। দলপতি প্রত্যেকের কাছ থেকে সেরা পারফরমেন্সটুকু আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করে। এই বিরল ক্ষমতা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। পেশাদারিত্ব আর প্রগতিশীলতা যাঁর মজ্জাগত তিনিই পারেন। সফল হন। জগতে তাঁর নাম উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধায়। অনল এমন এক নির্দেশকের প্রভাবে আটকা পড়ে। গাছাড়াভাব ছিল অনলের। গেলে গেলাম ভাবনার। কবিতা তার পছন্দের হলেও একেবারে ‘দিওয়ানা’ হওয়ার মতো নয়। কবিতায় স্বপ্নের কথা বলে, সম্ভাবনার কথা বলে, জীবনের আলোকময় দিকের কথা তাকে টানে।

-এতটুকুই।

কাজী মোতাহার হোসেনের একটি লাইনের মর্মবানী অনলকে দোস্ত বিল্ডিং পর্যন্ত যেতে প্রেরণা যুগিয়েছে। “সংস্কৃতি হলো শিক্ষিত মানুষের ধর্ম; আর ধর্ম হলো মূর্খ মানুষের সংস্কতি”। অতি আবেগী এই কথার যুক্তিযুক্ত নির্যাস নিতে সংস্কৃতি সংগঠনে সম্পৃক্ত হওয়া। নানাভাবে বিবিধ কাজে তার ব্যস্ততা অন্তহীন।

– তোমাকে ‘তুমি কে, আমি কে’ শ্রতি নাটকে মূল চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আগামীকাল ৫.৩০ মি. থেকে সম্মিলিত রিহার্সাল। যথাসময়ে চলে আসবে- দৃঢ়তার সাথে আন্তরিক নির্দেশে বললেন নির্দেশক পান্থ শাহীন।

– অনল আপত্তিজনক অজুহাতী কিছু বলতে চাচ্ছিল।

-নো, দেটস ফাইনাল- থামিয়ে দিলেন পান্ত শাহীন। আপাদমস্তক প্রাণচঞ্চল এই নির্দেশক আট পাতার একটা স্ক্রিপ্ট অনলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে শেষমেশ শান্ত হলেন।

– কী অবাক কাণ্ড!! এ যে ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’। অনল ভাবে।

ভাবনার অনেক বাঁকবদল ঘটিয়ে সেইদিন উকিল কলোনির বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল। চারদিকে স্তব্ধ-নিস্তব্ধতা। চকবাজারের গুলজার সিনেমা হলের সামনে তখনো কিছু লোক এদিক-ওদিক হাঁটাচলা করেছে। কিছুক্ষণ আগেই হয়তো সিনেমার শেষ-শো ভেঙ্গেছে। পূর্বদিকের বাঁশঝাড় মোড়ের আনাচে-কানাচে কিছু পুরুষ মানুষ দাঁড়িয়ে নিজেদের হালকা করে নিচ্ছে। অনল নিজেও এক-দুইবার বাঁশের ঝোপে এইকাজ সেরে নিয়েছিল। লালচাঁন রোড ধরে সোজা পূর্ব দিকে হাঁটা শুরু করল। নির্জনতা। মাঝে মধ্যে রিক্শার টুং টাং শব্দ। তখন ভাদ্রমাস। বেশ  গরম হলেও মধ্যরাতে তা সহনীয় পর্যায়ে।

কলোনিতে ঢুকার মুখে একটি লোহার গেট আছে বটে, কিন্তু সবসময় তা খোলা দেখেছে অনল। আজকে অন্যরকম। দুইপাশ থেকে টেনে বন্ধ করার চেষ্টা, পুরোপুরি লাগেনি। একটু ফাঁক, সঙ্গতই মনে করল। আরেকটু ফাঁক করে ভেতরে ঢুকল। দেখে টিনের চালের উপর রোদে দেয়া কাঁথা বালিশ-কাপড় এখনো ঝুলছে। বাসিন্দারা অঘোর ঘুমে। ঢুকার মুখে বামপাশের কাজী অফিসও নিঃশব্দ। কেউ কোথায় নেই। আকাশ ঝেঁপে নেমে আছে এক চাঁদ আলো। একটু টেনশন হলো। টেনশনে অনামিকা কানে ঢুকানোর অভ্যাস আছে তার। কানে আঙ্গুল বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে গা ঝাড়া দিয়ে সামলে নিল। ঘোর থেকে বাস্তবে ফিরে আসার চেষ্টা করে।

নিজের রুম নম্বর ৬-এর দিকে আগায়। উদ্দেশ্যে অমোঘ গন্তব্য। মানিব্যাগের এক কোণায় রাখা সিঙ্গেল চাবিটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলো না। বাম হাতে ছোট তালাটি ধরে ডান হাতে চাবি লাগাতেই খটাশ শব্দে খুলে গেলো তালা। রুমমেট বশর ১৫ দিনের শ্রান্তি-বিনোদন ছুটিতে। দরজা ঠেলা দিতেই চোখ গেলো পাশের সেই ৭ নাম্বারে। ৬-এর দরজার পাশে লাগানো ৭-এর জানালা। টাঙ্গানো লুঙ্গির ফাঁক দিয়ে আলাজিলা আলো। আলোর কারসাজি। জানালার কাঁচ এক কোণায় একটু ভাঙ্গা আগেই তা খেয়াল করে রেখেছিল; অনল।

চাবির মাথা ভাঙ্গা কাঁচে ঢুকিয়ে পর্দা কিঞ্চিত ফাঁক হতেই অসামান্য অভূতপূর্ব দৃশ্য। অদেখা এক অনুভবের জগৎ। ভিতরের রুমের দরজা বরাবর ফ্লোরে বসে আছে ধবধবে সাদা লম্বা দাড়িগোঁফওয়ালা এক সমুজ্জ্বল ব্যক্তি। ডোরাকাটা চেকের লুঙ্গির সাথে সাদা কাবলি পাঞ্জাবি। কী একটা নুরানি চেহারা; ঘরে আর কেউ আছে কিনা; তা বুঝা গেল না। বুক ধুকপুক করে ওঠল অনলের।

– ইয়েস; দিস ইজ মাই —– এক ঝাপটায় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকবে কি না?

– না!

-না! এই ছেলেমানুষিতে গেলো না; ৭ নম্বরের শেকড়সুদ্ধ অনুসন্ধানের চিন্তা মাথায় এলো। অলৌকিকভাবে নিশানা পেয়ে যাওয়ায় উল্লাসও করলো। বুনো উল্লাস।

জানালার ফাঁক থেকে আলগোছে চাবি বের করে আনলো। খুব সাবধানে-সচেতনভাবে শব্দহীন নি:শব্দে নিজের ঘরে ঢুকলো। ঘরে বাতি জ্বালালো না। সোজা ভেতরের রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। অন্ধকারেরও বিশেষ আলো আছে। সেই আলোতে অনুমান সঠিক করে খুন্তি নিল একটা। ৭ নম্বরের ভাঙ্গা জানালায় খুন্তির লেজ ঢুকিয়ে পর্দা সামান্য বেশি ফাঁক করলো।

– খুব বিরল দৃশ্য। স্বচক্ষে দেখেছে, না স্বপ্নে ঠাহর করতে একটু সময় লাগলো।

লুঙ্গি হাঁটুর বরাবর তুলে দুই পা ফাঁক করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছে। দুই পায়ের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় সিকি, আধুলি, এক, দুই, পাঁচ,  দশ টাকা-পয়সার স্তূপ। পাশে একটি চলটা ওঠা টিনের থালা, অন্যপাশে একটি কাঁধে ঝুলানো ময়লাযুক্ত থলের ব্যাগ। ভাবের ঘোরে গভীর মনোযোগে নোটগুলো ভাঁজ করছে।

-ভাদ্রমাস। পূর্ণচন্দ্র রাত। ঝিরঝির বাতাস হেলছে দুলছে। পাশের বাসাগুলো থেকে গভীর ঘুমের গোঙানির শব্দ বেশ জোরালোভাবে কানে আসছে।

– অনল দোদুল্যমান অবস্থায় পড়লো। মুখে একরাশ বিরক্তি। ভাবছিল কী? আর দেখছে কী?  অকারণ সব ঝামেলা। চিৎকার দিবে; না দরজা ঠেলা দিবে? জানালার কাঁচে ছোট করে টোকা দিতেই ত্রস্তে উঠে দাঁড়ালো। নিমিষেই বাতি অফ। পুরো ঘর অন্ধকার। চিৎকার, চ্যাচামেচি, ডাকাডাকি করলে ভাড়াটিয়ার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। আশপাশের ঘুমন্ত মানুষজন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। ক্লান্ত-বিমর্ষ মানুষের নিদ্রাভঙ্গ হবে। সেই দিকে গেলো না।

– ব্রাইট ইয়াংম্যান! হঠাৎ বুদ্ধি খেলে গেলো। কাঁচের ভাঙ্গা ফাঁকে ঠোট লাগিয়ে কন্ঠশীলনের কন্ঠে পরিষ্কার ফিসফিস করে বল্ল।

– ‘বহুদিন আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার চেষ্টা করছি। আমার খুব ইচ্ছা। আপনিআমি গল্প করি। একসাথে বসে চা খাই। সুখ-দুঃখের কথা বলি। আমি ৬ নম্বরের। সকালে ডাকিয়েন। অনুরোধ; আমার প্রস্তবটা মাথায় রাখিয়েন’।

রাত্রের বাকী কয়েকঘণ্টা বিছানায় গেলো কিন্তু নিদ্রাদেবী প্রসন্ন হলেন না। চিৎ হয়ে চোখ খুলেই পুরুটা সময় কাটালো; অনল।

এই জীবনযুদ্ধের বাজারে কে কোনোভাবে নিজের কুঞ্জ সাজায়। আহারে!! দূরে ভেসে এলো আজানের ধ্বনি। ধনিরপুলের ডান পাশের বড় মসজিদ। এটাও এই কলোনির মালিকগণের। আজ আশ্চর্য এক নতুন প্রভাত। বহুদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের মহাক্রান্তিলগ্নে। সামগ্রিক চেতনা, আবেগ ও প্রত্যাশার মহামিলনের এক উজ্জ্বল প্রভাত।

– ধড়ফড় করে বিছানা থেকে ওঠে গেলো। নাক একটু খুঁটল। বাথরুমে কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইল। আকাশ কিছুটা ফর্সা হলে দরজা খুলে দিয়ে অপেক্ষা। ৭ নম্বরের দেখা পাওয়ার বিস্ময়কর অপেক্ষা।

– মাইগড! গতরাতে আবছা আলোয় অশীতিপর মনে হওয়া বৃদ্ধ আসলে সুঠাম দেহের অধিকারী। সাদা আর হালকা নীলের বর্ডার দেয়া লুঙ্গি। গায়ে ঘিয়ে রঙের মসৃণ টান টান ভাঁজ করা পাঞ্জাবি। পায়ে নতুন স্যান্ডেল, হাতে স্টিলের ফ্রেমের বড়সড় ফ্লাক্স নিয়ে বের হচ্ছিল। অন্যরা ওঠার আগেই চা-নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়া।

– চাচা! ডাক দিতেই থমকে দাঁড়ালো। আশেপাশে কেউ আছে কি না ঘার ঘুরিয়ে দেখে নিল। কেউ নেই। কারো ঘুম ভাঙে নাই। সব দরজা বন্ধ।

– আর কেউ নাই- ভেতরে আসেন; বলতেই ধরফরিয়ে ঢুকলেন। আলাপ জুড়ে গেলো। বৈরিতা ধীরে ধীরে দূর হতে লাগলো।

অনল তার চাচাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিল। অপূর্ব-অনবদ্য-দীপ্তিময় কান্তি দেহখানি। বয়স পঞ্চাশের নীচে। মায়াময় চেহারায় রূপবান চোখ ২টি একটু লালচে।

-কী করেন!!

– দুগ্গা হইসার লাই- আর বলতে পারলেন না। চোখের পানি লুকাতে দ্রুত ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। চাচা-ভাতিজায় সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা হয়। চাচার প্রতিদিনকার আয়-রোজগারের হিসাব ভাতিজার উপর বর্তায়। চাচাও দায়িত্ব সঁপে দিয়ে জীবন পরিবর্তনের উপায় খুঁজেন। প্রতিদিন জমে। কাঁড়ি কাঁড়ি না হলেও নিত্যকার ‘খয়রাতি’ একেবারে কম না। শিক্ষিত ভাতিজার চাকুরির বেতনের চেয়ে স্বশিক্ষিত চাচার আয় রোজগার বেশি। একেবারে নিভের্জাল -ফরমালিনমুক্ত। চাচার জীবন ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পরিণত হয় ভাতিজা-অনল।

– ২ বছর ৩ মাস পর:- ভাতিজা অনল বদলী হয়। বাসা অন্যত্র নিতে হয় । চাচার ডিপিএস, এফডি, নগদ টাকাকড়ির হিসাব অনুপুঙ্খ বুঝে দেয়া হয়। সঙ্গে সাক্ষী প্রতিবেশি বশর। বশর মুচকি হাসে। চাচা নিঃশব্দে কাঁদে।

– ১৮ বছর ৭ মাস পর:- চকবাজার মোড়, গুলজার সিনেমা হল ভেঙে গুলজার মার্কেট। পেছনের বাঁশঝাড় ডোবা ভরাট করে মতি টাওয়ার সংলগ্ন ৪ তলা দালান ভেঙে ১৬ তলা সৈয়দ সেন্টার পাশে মতি কমপ্লেক্স। চট্টগ্রামের নামকরা কেনাকাটার এলাকা। জনপ্রিয়। অধিক মানুষের ভীড়। ঠেলাঠেলি অবস্থা। প্রায় প্রতিদিন। সকাল-সন্ধ্যা। রমজানের সময় এক শুক্রবার ইফতারের ঠিক পরপর ভাতিজা অনল মতি টাওয়ার থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। দূর থেকে পরিচিত কেউ দাঁড়িয়ে আছে বলে ঝাপসা দেখছে। আপনমনে হাঁটছে । এদিক-ওদিক। এখন আর হাতে থালা নেই। যুগপরিবর্তন। কাছে যেতেই চোখ ছানাবড়া। এতো দিনে চিনতে পারে কী না সন্দেহ! তার পরেওÑ

-আরে চাচা !!

কিছুক্ষণ সেই লাল চোখে চোখ রেখে একটু হেলে চুপ থাকার ইশারা বুঝে নিল বড় মক্কেল টার্গেট। অন্যের পকেটের টাকা কোনো কারণ ছাড়া বিনাপরিশ্রমে নিজ হাতে আনার বিশেষ কিছু কায়দা -কৌশল-অভিনয়-ভান সমন্ধে সেই সময়ে জেনেছিল অনল। মিথ্যাও কখনো উপভোগের হয়। ইচ্ছা করে চোখ লাল রাখা, মুসল্লিদের তসবিহ জপার মতো অভিনয় করা, গাড়ি  থেকে নামার মুহূর্তে দরজা বরাবর এতিমের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো আরো কতোশতো কা-কারখানা অনলের মুখস্ত, তার ইয়াত্তা নেই!!

মানুষজন একটু ফাঁকা হলে আবার কাছে গেলো অনল। চাচা ঘ্যান ঘ্যান করলেও তার মায়া হলো। ভর যৌবনে একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র-মৌলিক পেশা সমন্ধে অনেক কিছু জেনেছিল। একেবারে গভীরের। সঠিক মানুষটির সঠিক জায়গার। ফোঁটা ফোঁটা ভেজা নোনা ঘামের কথা। অদ্ভূত সব কাজকারবার। টানটান মসৃণ পিছল ত্বক কিছুটা ঝুলেছে। বাকী সব সেই মতো। কেবল চোখ ইচ্ছা করে লাল করে রাখা।

– চিনছেন!!

– কেন চিনুম না।

– কেমন আছেন; ইনকাম কেমন

একটু জোরে নিঃশ^াস নিলেন; দুই কদম পাশের ফাঁকাতে গেলেন।

– ভালা নাই। আমার ক্ষয়রোগ। তোমার চাচী গতবার আমাদের ছাইড়া গেছেগা।

-আর!!

বড়পুতটা ডুবাই পাঠাইছি।

ছোটটা এহানে (মতি টাওয়ার) ৩ তলায় টেইলারিং করে। বিয়া করাই নাই।

মায়া বিয়া দিছি। জামাই বৌবাজারে মুদি দোকান করে। ২ডা নাতি।

– বাড়িতে!!

-দুইতলা হেস কইছি। এহন আড়াই-এ। আন্নে!!

– চাচা; কল্পনা বড় সুন্দর মোহময়। আছি! চাচা আছি!! বলে স্যাকারিন দেয়া কাঠি আইসক্রিম চুষতে চুষতে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

সর্বশেষ

এই বিভাগের আরও