মোহাম্মদ ইউসুফ *
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনে কে নির্বাচিত হচ্ছেন সেই কৌতুহল চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ১৯৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচন থেকে শুরু করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে এ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে আসছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য,সাবেক মন্ত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি। স্বাধীন বাংলাদেশে ৭৯, ৮৮, ৯১ ও ২০০১ এর নির্বাচন ছাড়া বাকি প্রতিটি নির্বাচনে তিনি এ নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। বয়স-জটিলতা ও শারীরিক অযোগ্যতার কারণে এবার তিনি আর নির্বাচন করছেন না। আগে থেকে তিনি ঘোষণা দিয়ে আসছেন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তাঁরই মেঝছেলে মাহবুবুর রহমান রুহেল নির্বাচন করবেন। ফলে যথারীতি মোশাররফ-তনয় রুহেলই এ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন।নৌকার বিপরীতে এখানে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে মাঠে রয়েছেন দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগনেতা,মীরসরাই উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ আসনে সর্বমোট ভোটারসংখ্যা ৩,৬৬,৫২৫ জন ( পুরুষ – ১,৮৮,৭৪১, মহিলা- ১,৭৭,৭৮২ ও হিজড়া–২জন) ও কেন্দ্র ১০৬টি।নৌকা আর ঈগলপ্রার্থী ছাড়া এখানে আরও ৫জন প্রার্থী নির্বাচনীমাঠে আছেন। তাঁরা হচ্ছেন, এমদাদ হোসাইন চৌধুরী (লাঙ্গল), আবদুল মান্নান (চেয়ার), মো. ইউসুফ (টেলিভিশন),নুরুল করিম আফছার (একতারা) ও শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী (পাঞ্জা)।
শুক্রবার (৫জানুয়ারি) সকাল ৮টায় নির্বাচনের শেষ মুহুর্তের প্রচারণা শেষ করেছে প্রার্থীরা। প্রচারণার শেষ পর্যায়ে এসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটপ্রার্থনা করেছেন প্রার্থীরা। গতকাল (৪জানুয়ারি) গণসংযোগ,পথসভা,পোলিং এজেন্ট প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে ব্যস্তসময় অতিবাহিত করেছেন প্রার্থী ও কর্মীসমর্থকেরা। আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শেষ হলেও অনানুষ্ঠানিক প্রচারণা যথারীতি চলছে। এখানে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণফ্যাক্ট হতে পারে নীরব ভোটারেরা। তারা পাল্টে দিতে পারে ভোটের চিত্র- এমন তথ্য মেলেছে।
এ আসনে দুই প্রার্থীর জয়-পরাজয় নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার শেষ নেই। নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ভোটার সাধারণ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে। ভোটারেরা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি-না এমন আশঙ্কা ও অবিশ্বাস রয়েছে তাদের মনে। তবে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধি ও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার জন্যে প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের জোরালো আহবান- এ আশঙ্কা কমে আসছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ নির্বাচনযুদ্ধ গিয়াস-রুহেলের যুদ্ধ নয়,এ ভোটযুদ্ধ হবে মূলত মোশাররফ-গিয়াস (গুরু-শিষ্যের) এর যুদ্ধ। এ লড়াই নৌকা-ঈগলের লড়াই নয়,এ লড়াই হবে গিয়াস ও মীরসরাই আওয়ামী লীগের লড়াই। এ লড়াই আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত নেতাকর্মীদের অস্তিত্বের লড়াই। নৌকার মাঝি রুহেল রাজনীতিতে নবীন ও অর্বাচীন। বাবার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও সারা জীবনের অর্জনই নির্বাচনযুদ্ধে তাঁর একমাত্র হাতিয়ার। তবে রুহেল একজন সুদর্শন ও উচ্চশিক্ষিত আইটি বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাতনয় সজিব ওয়াজেদ জয় তাঁর সহপাঠী বন্ধু। কিন্তু এলাকায় অবস্থান না করার কারণে মীরসরাইয়ের আমজনতার সাথে তাঁর সম্পর্ক নিবিড় নয়। তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিনি মীরসরাই এলাকার সর্বত্র চষে বেড়াচ্ছেন,মিশছেন সাধারণ মানুষের সাথে। বিপরীতে সাবেক ছাত্রনেতা গিয়াসউদ্দিন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন। অতীতে সংসদ নির্বাচনে মোশাররফ হোসেনের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভ্যানগার্ড লিডার হিসেবে কাজ করেছেন গিয়াস উদ্দিন। বলা যায়,মীরসরাই রাজনীতিতে মোশাররফের পরেই গিয়াসউদ্দিনের অবস্থান। পাঁচ বছর মীরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় দলের বাইরেও সর্বমহলে তার বিশেষ পরিচিতি ও সম্পর্ক রয়েছে। তবে ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে গিয়াস উদ্দিন দল থেকে মনোনয়ন চাওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করলে দলের শীর্ষনেতৃত্বের বিরাগভাজন হন; তার ওপর নেমে আসে “মহাবিপদ”। বহুবার হয়েছে তাঁর ওপর হামলা। শুধু তিনি নন,৮/৯বছর ধরে উপজেলাজুড়ে তাঁর যত অনুসারী নেতাকর্মী আছেন তাঁরা বিভিন্নভাবে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। এবারের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্রপ্রার্থী হওয়ার গ্রিনসিগন্যাল দেয়ায় গিয়াস উদ্দিন এমপি প্রার্থী হয়েছেন। দলীয় রাজনীতিতে প্রতিকূল এ পরিবেশের কারণে দীর্ঘদিন ধরে তিনি সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন। রোগীসেবা দিয়ে তিনি ‘মেডিকেল বন্ধু’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। মীরসরাইয়ের যেকোনো মানুষ (দল-মত-নির্বিশেষে) রোগাক্রান্ত ও দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চট্টগ্রাম শহরের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে গিয়াস উদ্দিন ওই রোগীর পাশে এসে দাঁড়ান। রোগী যদি আর্থিকভাবে দুর্বল হয়,তাকে আর্থিক সহায়তাও দিয়ে আসছেন।
এদিকে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করে ইগলের স্বতন্ত্রপ্রার্থী গিয়াস উদ্দিন চাটগাঁর বাণীকে বলেন, “আমার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নৌকার লোকজন এখনো নানানভাবে ভয়ভীতি, মারধোর ও চাপে রাখার চেষ্টা করছে। ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ ও দখলের ষড়যন্ত্র চলছে। এ ব্যাপারে প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে- সেই প্রত্যাশা করছি।” এছাড়া নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ভোটারেরা যদি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে বাধাহীনভাবে তাদের ভোট দিতে পারেন তাহলে আমি বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করবো।” সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে একই ধরনের সংশয় ও শঙ্কা প্রকাশ করে ইগলপ্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী কেন্দ্রীয় যুবলীগনেতা নিয়াজ মোর্শেদ এলিট মুঠোফোনে চাটগাঁর বাণীকে বলেন,“নৌকার লোকজন বিভিন্নভাবে আমাদের কর্মীদের ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন ও ভোটকেন্দ্র জবরদখল করে ভোট নেয়ার পাঁয়তারা করছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের নিরেপক্ষ ভূমিকা প্রত্যাশা করছি।”
মীরসরাইয়ের বিভিন্ন ইউনিয়নে ঈগল প্রতীকের অফিস ভাংচুর, কর্মী-সমর্থকদের মারধোরের অভিযোগ ওঠেছে। এ ব্যাপারে আজ (৫জানুয়ারি) রাত ৯টায় মুঠোফোনে আওয়ামী লীগপ্রার্থী মাহবুবুর রহমান রুহেলের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি চাটগাঁর বাণীকে বলেন, “ তারা নিজেরা মারামারি করে অন্যের ওপর দোষ চাপাতে চায়। এখনো বিভিন্ন স্থানে ঈগলপ্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের নানাভাবে হুমকি ও পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রীপুত্র নৌকাপ্রার্থী রুহেল বলেন, এগুলো সবই মিথ্যা,বানোয়াট ও সাজানো। নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে কতোটা আশাবাদী জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনগণ যেভাবে সাড়া দিয়েছে এবং নৌকার অনুকূলে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে নৌকার বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।তাই জয়ের ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।”
মীরসরাইয়ের নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানকে বারংবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। সহকারী রিটার্নিং অফিসার মীরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহফুজা জেরিনের সাথে কথা হয় চাটগাঁর বাণীর। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই আমাদের। এখানে ৭জন এমপিপ্রার্থী আছেন,সকলেই আমাদের জন্যে সমান। নৌকার লোকজন কর্তৃক ইগলপ্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মারধোর ও ভয়-ভীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ আসছে তা আমলে নিয়ে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। ”
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আতাউর রহমানের সাথে মীরসরাইয়ের নির্বাচন নিয়ে চাটগাঁর বাণী’র কথা হয়। তিনি নির্বাচনী হালচালের বাস্তবচিত্র তুলে ধরেন। নৌকার লোকদের দ্বারা স্বতন্ত্রপ্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মারধোর ও ভয়-ভীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ নির্বাচনতো অনেকটা স্বার্থের খেলা,দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিছুটা থাকবেই। সুষ্ঠু নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তো কাজ করছে।”
ঈগলপ্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও মারধরের ব্যাপারে মীরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সহিদুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে বলেন,এ ধরনের অভিযোগ পেলেই আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। এছাড়া সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে আমরা শতোভাগ বদ্ধপরিকর।”