[bangla_date] || [english_date]

মোহাম্মদ সেলিম  *

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌরসদরের প্রাণকেন্দ্রে  অবস্থিত শতবর্ষী প্রাচীন ঢেবারদিঘি ( রেলওয়ের দিঘি) অযত্ন অবহেলায় পাড়গুলো ভেঙে যাচ্ছে। দিঘির চারপাশে  চট্টগ্রাম লালদিঘির আদলে ওয়াকওয়ে  ও  শিশুপার্ক নির্মাণের ব্যবস্থা করলে  দিঘির সুরক্ষা, সৌন্দর্য বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা এবং পৌরসভা এলাকার  অর্ধলাখ মানুষের দৈনন্দিন শারীরিক ব্যয়াম ও হাঁটাহাঁটির সুব্যবস্থা এবং সর্বস্তরের  মানুষের এক চমৎকার বিনোদনের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হবে ।

দেশের উপজেলাগুলোর  মধ্যে অত্যধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত জনপদের নাম সীতাকুণ্ড।

প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হলেও পৌরসদর এলাকায় সব বয়সের মানুষের জন্য উন্মুক্ত বিনোদনকেন্দ্র, শিশুপার্ক, বয়স্ক নাগরিকদের জন্য ওয়াকওয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই।

সীতাকুণ্ড কলেজ রোডের  দুই-তিনশ’ গজ দক্ষিণে রেল লাইনের পশ্চিম পাশেই ঢেবারদিঘিটির অবস্থান।

শতবছর পূর্বে বৃটিশ সরকার রেলের  কয়লার ইঞ্জিনে পানি সরবরাহের জন্যে রেলের নিজস্ব জায়গায় দিঘিটি স্থাপন করে রেল কর্তৃপক্ষ।

দিঘির উত্তর পাশের স্থানীয় বাসিন্দারা  রেলওয়ে থেকে লীজ নিয়ে ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য প্যালাসাইটিং দিয়ে   দিঘির  উত্তর পাড় ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করে চলাচলের রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করছে ।

দিঘির পশ্চিম পাশেও রয়েছে রেলওয়ের আরও বিস্তীর্ণ  অনাবাদী জায়গা।  এসব জায়গা  সীতাকুণ্ড সরকারি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা  মাওলানা ওবায়দুল হক ১৯১৪ সালের দিকে তৎকালীন বৃটিশশাসনামলে রেলওয়ে থেকে লীজ নেন।  তিনি স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর খেলারমাঠ হিসেবে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেন এসব জায়গা। যেখানে প্রতিদিন স্থানীয় শিশু -কিশোর- যুবক এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকেন। আর জাতীয় দিবসগুলোতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকহাজার ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারি ও বিভিন্ন সামাজিক ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের  অংশগ্রহণে নানা অনুষ্ঠানমালায় মুখরিত থাকে এ বিশাল খেলারমাঠ । দিঘির পশ্চিম পাড় ও খেলারমাঠের  পূর্বপাশ দিয়ে দক্ষিণমুখি ঢেবারপাড় সড়ক দিয়ে চৌধুরীপাড়া,  দক্ষিণ মহাদেবপুর ও সীতাকুণ্ড বাজারের শতশত মানুষ প্রতিদিন   চলাচল করে থাকে। কয়েক বছর পূর্বে সীতাকুণ্ড পৌরসভা দিঘির পাড়ের চলাচলের পথটিকে পিচঢালাই করে দেওয়ায় সর্বসাধারণের চলাচলের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে।

দিঘির দক্ষিণ পাড়ে রেলের জায়গায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সফিকুল ইসলাম বাচ্চু লীজ নিয়ে  চারদশক আগে প্রতিষ্ঠা করেন কথাকলি উচ্চবিদ্যালয়।

এ দিকে গত ৩০-৩৫ বছর থেকে বিভিন্ন সময় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা রেলওয়ে থেকে লীজ নিয়ে মৎস্য চাষ করেন দিঘিতে। বছরের পর বছর মাছচাষ করলেও দিঘির সংষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের  কোনো নামগন্ধ নেই।

তবে দিঘির উত্তর পাশের স্থানীয় বাসিন্দারা গত ৪/৫বছর  আগে  ভাঙন স্থানে প্যালাসাইটিং দিয়ে  দিঘির  উত্তর পাড়কে সুরক্ষা করেছে। দীর্ঘদিন থেকে ভেঙে সঙ্কুচিত হয়ে পড়া দিঘির উত্তর পাড়ের পূর্ব -পশ্চিমে ইটের সলিং এর ব্যবস্থা করে দিয়েছে  চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ। এর আগেই ১০-১৫ফুট পাড়ের মাটি ভেঙে পানিতে  মিশে গেলেও প্যালাসাইটিং দেয়ার পর দিঘির  উত্তর পাড় ভাঙন থেকে রক্ষ পায়। সলিং করা দিঘির পাড় দিয়ে প্রতিবছর শিব চতুর্দশী মেলায় হাজার হাজার তীর্থযাত্রী চলাচল করে থাকে চন্দ্রনাথধামের উদ্দেশ্যে।  আর  ঢেবারদিঘিতে প্রতিদিন স্থানীয় শত শত মানুষ ছাড়াও প্রতিবছর শিব চতুর্দশী মেলা উপলক্ষে আগত লক্ষাধিক তীর্থযাত্রী  গোসল বা স্নান করেন।

তবে দিঘির তিনপাড় প্রতিনিয়ত ভাঙছে। বছরের পর বছর যারা  দিঘিতে মাছচাষ করছেন তাদের অযত্ন অবহেলায় দিঘির পাড়গুলোর ভাঙন জোরালো হয়ে ওঠেছে।

কার্প জাতীয় মাছসহ যেগুলো মাটি খেয়ে থাকে এমন মৎস্য চাষ করার কারণে দিঘির পাড় এর বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । যে কারণে চতুর্দিকে ১০-১৫ফুটেরও বেশি পাড় ভেঙে পানিতে মিশে গেছে – এমন অভিযোগ স্থানীয় জনসাধারণের। চলতি বর্ষায় গত মাসখানেক আগেও পশ্চিম পাশের পাড় সড়ক ঘেঁষে বড় ধরনের ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। ভারি বর্ষণ হলে  অসংখ্য গাছসহ পাড়ের বড় অংশ দিঘির পানিতে তলিয়ে যাবে। এতে জনসাধারণের চলাচলের যে সড়ক তাও  ভাঙনের কবলে পড়বে।

সংশ্লিষ্ট প্রশাসন  ও  জনপ্রতিনিধিদের সুদৃষ্টিকামনা করে  স্থানীয় বাসিন্দা  নুরুল হুদা সেলিম চাটগাঁর বাণীকে  বলেন, ‘শতবছরের পুরোনো ঢেবারদিঘি সীতাকুণ্ড পৌরবাসীর ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশের ধারকবাহক। অযত্ন অবহেলায় এটি যেভাবে  ভাঙছে তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে একসময়। তিনি দিঘির সুরক্ষা ও সীতাকুণ্ডবাসীর সুবিধার্থে  চতুর্দিকে ওয়াকওয়ে ও শিশুপার্ক নির্মাণের  জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জোরালো দাবি জানিয়েছেন।’

স্থানীয় আরেক বাসিন্দা কৃষক  আবুল হাশেম  শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত ঢেবারপাড় এর বর্ণনা দিয়ে চাটগাঁর বাণীকে  বলেন,  ‘ছোটবেলায় প্রায় অর্ধশত বছর আগে দেখেছি ঢেবারদিঘির পাড়গুলো ছিলো একএকটা খেলার মাঠের মতো। ক্রমান্বয়ে ভাঙতে ভাঙতে পাড়গুলোর ওপর দিয়ে চলাচলের পথ সংকীর্ণ হয়ে ওঠেছে। ঐতিহ্যবাহী দিঘিকে সংষ্কার করে এলাকাবাসীর বৃহত্তর স্বার্থে চট্টগ্রাম লালদিঘির মতো উন্মুক্ত বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ওয়াকওয়ে  ও শিশুপার্ক নির্মাণ করার জন্যে তিনিও  প্রশাসনের প্রতি জোরালো দাবি জানিয়েছেন।’

দিঘির উত্তর প্রান্তের স্থায়ী বাসিন্দা সবিতা ভট্টচার্য্য চাটগাঁর বাণীকে বলেন, ‘কার্পজাতীয় মাছ  চাষের কারণে এবং বিভিন্ন সময়ে বড়শি প্রতিয়োগিতার নামে পাড় এর মাটি খুঁড়ে সীট বসানোর কারণে দিঘির চতুর্দিকে ১৫-২০ ফুট পর্যন্ত ভেঙে গেছে।

পাড় এর   পাশে কয়েকফুট ছেড়ে প্যালাসাইটিং ও নেট দিয়ে মাছ চাষ করলে এমন ভাঙনের কবলে পড়তে হতো না দিঘির পাড়গুলো।’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এম. সলিমুল্লাহ বাহার এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি চাটগাঁরবাণীকে বলেন, ‘রেলকর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই জনস্বার্থে কিছু করলে  কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।’

রেলওয়ের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা (পূর্ব) সুজন চৌধুরীর কাছে সীতাকুণ্ড রেলওয়ে দিঘির পাড় ভাঙনরোধে ওয়াকওয়ে নির্মাণের প্রস্তাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি  চাটগাঁরবাণীকে বলেন, রেলের নিজস্ব  কোনো  মেরামত বা উন্নয়ন করা ছাড়া বাইরের অন্য কোনো সেবামূলক কাজ করার সুযোগ বা বাজেট আমাদের থাকে না । অন্য প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা যদি ওয়াকওয়ের ব্যবস্থা করে এতে স্থানীয় সর্বসাধারণ উপকৃত হবে এবং দিঘির পাড়ও সুরক্ষিত হবে। তবে এর আগে অবশ্যই রেলের বিভিন্ন বিভাগের লিখিত অনাপত্তি লাগবে।’ লেখক- সম্পাদক, চাটগাঁর বাণী

 চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে শতবর্ষী রেলের ঢেবারদিঘি