[bangla_date] || [english_date]
লেখক মো. শফিকুল  আলম খান

সমস্ত উদ্বেগ, উত্তাপ,উৎকণ্ঠা, সংশয় ও জল্পনা কল্পনার অবসান  ঘটিয়ে  দ্বাদশ  জাতীয়  সংসদের নির্বাচন কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অত‍্যন্ত সুষ্ঠু ও সফলতার সাথে সুসস্পন্ন হয়েছে।বাংলাদেশ  জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবং  এর মিত্রদের ভোট বর্জনের মধ‍্যে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর  রহমানের  কন‍্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী  লীগ টানা চতুর্থবার নির্বাচিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুসারে প্রায় বিয়াল্লিশ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার  প্রয়োগ করেছে।শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইতোমধ্যে ছত্রিশ সদস‍্যের মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছে।  বিএনপি এবং  তার মিত্ররা শুরু থেকেই বলে আসছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া  হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না এবং  কোনো নির্বাচন করতে দেয়া হবে না দেশে। তারা যেকেনো উপায়ে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনা পদত‍্যাগ না করা পর্যন্ত  কোনো সংলাপেই বসবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তারা। অপরদিকে আওয়ামী লীগও গো ধরে বসে সরকার সংবিধানের বাইরে একচুলও নড়বে না। তারাও জানিয়ে দেয় সংবিধানের বাইরে কোনো সংলাপ হবে না।। এর মধ‍্যে লম্বা সময় দিয়ে নির্বাচন কমিশন সাত  জানুয়ারি ২৪ খ্রিস্টাব্দে ভোটের দিন নির্ধারণ করে দ্বাদশ  সংসদের তফশীল ঘোষণা  করে।নির্বাচন প্রতিহতের জন্য বিএনপি প্রথমে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়  আন্দোলন শুরু করলেও ২৯অক্টোবর থেকে তারা সহিংস হয়ে ওঠে। ওইদিন তারা  সারাদিনব‍্যাপী হরতাল পালন করে। এরপরে তারা দু’মাস প্রতি সপ্তাহে চারদিন করে অবরোধ ও হরতাল পালন করে।  অবরোধ  ও হরতাল পালনকালে তারা শত শত গাড়িতে আগুন দেয়। আগুন দেয় কয়েকটি চলন্তট্রেনের বগীতে। এতে প্রাণ হারাতে হয় বেশকিছু সাধারণ মানুষকে। তারা নির্মমভাবে পিটিয়ে  হত‍্যা করে নিরীহ একজন পুলিশকে। নির্বিচারে হামলা চালায় প্রধান  বিচারপতির বাড়িতে । হামলা চালিয়ে জ্বালিয়ে  দেয় পুলিশ  বক্স। গাড়ী বা ট্রেনে আগুন জ্বালিয়ে বা ভাংচুর করে কিছু আতংকের সৃষ্টি  হলেও বিরোধী  দলের হরতাল এবং অবরোধের সময় যান চলাচল ও জীবনযাত্রা বলা যায় মোটামুটি স্বাভাবিক  ছিল। অন‍্যদিকে সরকারও হার্ডলাইনে চলে যায়। বিএনপির শীর্ষনেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম, আমির খসরু মাহমুদ, মীর্জা আব্বাস, গয়েশ্বর  রায়সহ শত শত নেতাকর্মীকে বিভিন্ন  অভিযোগে গ্রেফতার  করে।

এদিকে অনেক আগে থেকেই  বিদেশী রাষ্ট্রদুতগণ বিশেষ করে আমেরিকার  আ‍্যমবেসডার পিটার হাসের প্রকাশ‍্য অপ্রকাশ‍্য দৌড়ঝাঁপ  শুরু হয়। আমেরিকা ভিসা নীতি ঘোষণা  করে। অন‍্যদিকে বিশেষ একটা শ্রেণি সামাজিক যোগাযোগ  মাধ‍্যমে দেশে এবং বিদেশে বসে বিভিন্নভাবে সত‍্য-মিথ‍্যা প্রচারণা  শুরু করে বলে এখনি হাসিনা সরকারের পতন হচ্ছে। হাসিনা তার মন্ত্রীদের নিয়ে পালাচ্ছে। বিশেষ বিমান, বিমানবন্দরে অপেক্ষায় আছে। বিদেশে অবস্থানরত বিএনপিনেতা  তারেক জিয়া আন্দোলনকে  বেগবান করার জন্য স্কাইপিতে মিটিং করে প্রতিনিয়ত দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। শেষের দিকে তারা অসহযোগ আন্দোলনেরও ডাক দিয়ে ভোটারদের ভোট প্রদানে নিবৃত্ত করার ব‍্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়।কিন্ত বিএনপির  নির্বাচন প্রতিহত করার সমস্ত প্রয়াস ব‍্যর্থ করে সাত জানুয়ারি  যথানিয়মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত  হয়।

আমরা একটু পেছনে ফিরলে দেখি  জাতির  পিতা বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে  নৃশংসভাবে  হত‍্যার পর সামরিক  অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ‍্যুত্থানের মাধ‍্যমে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। এ সময়ে সেনানিবাসে আরো অনেকগুলো ছোটখাট অভ‍্যুত্থান সংঘঠিত হয়। অন‍্য এক অভ‍্যুত্থানে জিয়াউর রহমান  নিহত হলে স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসেন। নব্বই  সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের  দাবিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি তাদের মিত্রদের নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। পরে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত  নির্বাচনে বিএনপি বিজয় লাভ করে। একইভাবে  ছিয়ানব্বই সালে বিচারপতি হাবিবুর  রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী  লীগ ক্ষমতায় আসে। পরেরবার বিচারপতি  লতিফুর রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসে। এবার ক্ষমতায় এসে বিএনপি ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার অভিপ্রায়ে তাদের দলের বিচারপতি হাসান আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করার উদ্দেশ্যে  বিচারপতিদের চাকরির মেয়াদ  দু’ বছর বাড়িয়ে দেয়।  তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিয়ে এখান থেকেই শুরু হয় বিতর্ক। আওয়ামী  লীগ এই বিচারপতির মেয়াদ  বৃদ্ধির  বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে। এরপর বিএনপির রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ নিজে নিজে তত্ত্বাবধায়ক  সরকারের প্রধান হয়ে যান। আওয়ামী লীগ তার অধীনে নির্বাচন করতে সম্মত হলেও তার বিভিন্ন পক্ষপাতিত্বমূলক কার্যক্রমের প্রতিবাদে ড.  আকবর আলী খানসহ বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা সরকার থেকে পদত‍্যাগ করেন। এরমধ‍্যে সেনাবাহিনী  প্রধান জেনারেল  মঈন  ইউ আহমেদ  অভ‍্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসে। দু’বছর পরে তত্ত্বাবধায়কপ্রধান ফখরুদ্দিন আহমদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী  লীগ বিজয়ী হয়। এই চারটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যে দল পরাজিত হয়েছে তারাই  প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনেছিল।

ফখরুদ্দিন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী  লীগ ক্ষমতায় এসে আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক  সরকারের অধীনে নির্বাচন  করার বিষয়টি  বাতিল করে দেয়।যার কারণে চৌদ্দ সালে বিএনপি দলীয় সরকারের  অধীনে নির্বাচনে  অংশ না নিয়ে আন্দোলনের নামে সারা দেশকে ধ্বংস  স্তুপে পরিণত করেছিল। সারা দেশে হাজার হাজার গাড়ীতে পেট্রোলবোমা মেরে শত শত নিরীহ মানুষকে তারা হত‍্যা করেছিল। ভোটের আগের  রাতে শত শত ভোট সেন্টার আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। তাদের এই নৃশংসতায় কয়েকজন প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার আগুনে পুড়ে  মারা যায়। এরপরেও তারা নির্বাচন প্রতিহত করতে পারেনি। ২০১৮

সালে বিএনপি একই কায়দায়  দাবী আদায় করতে ব‍্যর্থ হয়ে শেষ মুহূর্তে হযবরল অবস্থায় জোটবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়।  অভিযোগ আছে সত্তর সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এল এফ ও অর্থাৎ লিগ‍্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার এর অধীনে নির্বাচন করেছিল। দলের ভেতরে বাইরে অনেক বড় বড় নেতা বঙ্গবন্ধুকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের দেয়া শর্তের খড়্গ্ মাথায় নিয়ে এই নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী সিদ্ধান্তে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতার ম‍্যান্ডেট পেয়েছিলেন।যেটা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক হয়েছিল।বিএনপি গত পনেরো বছরে না পেরেছে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে না পেরেছে ক্ষমতায় যাওয়ার বিকল্প কোনো পথ বের করতে বা সরকারকে হটাতে। প্রতিবারই তারা শেখ হাসিনার কৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছে। এটা এখন পরিস্কার বতর্মান যুগে দেশের জনগণ অবরোধ হরতালের মতো কর্মসূচিতে সাড়া দেয় না। এগুলো এখন ভোতা হয়ে গেছে। তাই এখন বিএনপিকে আন্দোলনের বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে। সাথে সাথে এটাও স্পষ্টত প্রমাণিত হয়েছে যে বিদেশের মাটিতে বসে নিদের্শনা দিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করা যায় না।বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তা প্রতিহত করার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী এখন জেলে আবদ্ধ। ভবিষ্যতে জামিন পেলেও আদালতে হাজিরা দিতে দিতে তাদের আগামী পাচঁ বছর কাটাতে হবে। প্রতিবার আন্দোলনের ব‍্যর্থতায় হাজার হাজার কর্মী হতাশাগ্রস্ত হয়ে রাজনীতি থেকে নিষ্কৃীয় হতে পারে। একইভাবে বয়োজ‍্যেষ্ঠ নেতারা যারা মনে করেছিলেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ক্ষমতার স্বাদ পাবেন তারাও আরো দীর্ঘ সময়ের জন‍্য কতটুকু সক্রিয় থাকবে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই আমার মতে, আঠারো সালে নির্বাচনের দিন মাঝখানে ভোট বর্জন না করলে তারা অনেক আসনে বিজয়ী হত। ঠিক একইভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের সাথে তাদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হত। এমনকি জয়েরও সম্ভাবনা ছিল। কারণ, চৌদ্দ সাল আর আঠারো সালের নির্বাচন এবার হত না। পশ্চিমা দেশসহ সারা বিশ্ব ঈগল চোখে এই নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি রাখত। এরপরেও তারা ক্ষমতায় যেতে না পারলেও উল্লেখযোগ্যসংখ‍্যক সদস‍্য নিয়ে তারা সংসদে যেতে পারত। একই সাথে তারা সংসদ এবং মাঠে জনগণের কথা বলার সুযোগ পেত। এতে দেশে ধীরে ধীরে নতুন করে গণতান্ত্রিক ধারা সুচিত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ ছিল।
এখন বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তার টানা তিনবারের শাসন আমলে দেশের সব সেক্টরে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। অবকাঠামো, বিদ‍্যুত, জ্বালানি খাতে যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা নজিরবিহীন।সামাজিক উন্নয়নের সব সূচকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে। কিন্ত এ সরকারের সবচে বড় ব‍্যর্থতা হচ্ছে, সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ, দুর্নীতি প্রতিরোধ,বিদেশে টাকা পাচার এবং দ্রব‍্যমূল‍্যের উর্ধগতি নিয়ন্ত্রণ। বর্তমানে সরকারের প্রথম এবং প্রধানতম কাজ হবে এগুলো স্থায়ীভাবে সমাধানের জরুরি ব‍্যবস্থা নেয়া।

লেখক: বাংলাদেশ রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক।