[bangla_date] || [english_date]

মোহাম্মদ ইউসুফ *
সীতাকুণ্ডের আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে যে নামটি একাকার হয়ে আছে, আগাগোড়াই যিনি ছিলেন একজন নির্ভেজাল রাজনীতিক, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে যাঁর প্রবাদতুল্য অবদান, জীবন-যৌবনের বেশিরভাগ সময় যিনি ব্যয় করেছেন রাজনীতির অলিতে-গলিতে, দুই দশকেরও বেশি সময় যিনি ছিলেন সীতাকুণ্ড আওয়ামী লীগৈর সাধারণ সম্পাদক, সীতাকুণ্ডের মাটি ও মানুষের সাথে রয়েছে যার নিবিড় সম্পর্ক, দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সর্বস্তরের মানুষের কাছে ছিলো যার ঈর্ষণীয় গ্রহণযোগ্যতা, সর্বজনশ্রদ্ধেয় সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেন ডা. এখলাছ উদ্দিন আজ সোমবার(২৭নভেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম নগরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
কাছ থেকে দেখা নিবেদিতপ্রাণ এ ত্যাগী রাজনীতিকের জন্যে বড়বেশি করুণা ও মায়া হয়।শিশুর মতো সহজ সরল মানুষটি রাজনীতির জন্যে শুধু দিয়েই গেছেন, বিনিময়ে পাননি কিছিুই। দীর্ঘ একুশ বছর পর তাঁর প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকলেও মন্ত্রী-এমপি হওয়ার মতো যোগ্যতা থাকার পরও তাঁর ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। তাঁর সমসাময়িক ও জুনিয়র অনেক রাজনৈতিক সতীর্থ এমপি-মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্ণধার হলেও রাজনীতি বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা থাকার পরও হতভাগ্য ডা. এখলাছ অবহেলা আর বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই পাননি।শুধু দূর থেকে অবলোকন করেছেন ভাগ্যবান রাজনৈতিক সহকর্মীদের ক্ষমতাচর্চার দৃশ্য। কাছ থেকে দেখা নিবেদিতপ্রাণ এ রাজনীতিকের জন্যে বড়বেশি মায়া ও করুণা হয়।
শিশুর মতো সহজ-সরল মানুষটি রাজনীতির জন্যে শুধু দিয়েই গেছেন, বিনিময়ে পাননি কিছুই। দীর্ঘ একুশ বছর পর তার প্রাণপ্রিয় সংগঠন কয়েদফা ক্ষমতায় আসলেও মন্ত্রী-এমপি হওয়ার মতো যোগ্যতা থাকার পরও তাঁর ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। তাঁর সমসাময়িক ও জুনিয়র অনেক রাজনৈতিক সতীর্থ এমপি, মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্ণধার হলেও রাজনীতিতে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার পরও হতভাগ্য ডা. এখলাছ অবহেলা আর বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই পাননি। শুধু দূর থেকে অবলোকন করেছের ভাগ্যবান রাজনৈতিক সহকর্মীদের ক্ষমতাচর্চার দৃশ্য। রাজনীতির দুঃসহ বঞ্চনা, অবহেলা আর কোনোকিছু না পাওয়ার জ্বালা সইতে সইতে তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ তার কাজের স্বীকৃতি চায়। কাজ করেও যখন স্বীকৃতি মেলে না, তখন কাজের প্রতি কারো স্পৃহা থাকে না, প্রয়াত ডা. এখলাছের জীবৎকালেও তাই ঘটেছিল। রাজনীতির নিষ্ঠুর খেলায় বিপর্যস্ত হয়ে আমৃত্যু তিনি আশা-নিরাশার দোলায় দুলেছেন। দল থেকে কয়েকদফা এমপি পদে মনোনয়ন চেয়েও তিনি পাননি। অথচ রাজনৈতিক বিবেচনায়, সীতাকুণ্ডে সাবেক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত মরহুম এম আর সিদ্দিকীর পর মামুন মাস্টার কিংবা ডা. এখলাছ উদ্দিনই এমপি হওয়ার কথা।
ডা. এখলাছ ১৯৩৮ সালের ২০ এপ্রিল সীতাকুণ্ডের বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের বহরপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম সৈয়দুর রহমান বার্মা রেলওয়ের হিসাব কর্মকর্তা ও পরে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সেক্রেটারি ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাগদাদেও কর্মরত ছিলেন তাঁর বাবা। ডা. এখলাছ ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাস করেন। আইএসসি উত্তীর্ণ হন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে। চট্টগ্রাম ও ঢাকা( মিটফোর্ড) মেডিকেল স্কুলে এলএমএফ কোর্স সম্পন্ন করেন। এমবিবিএস পরীক্ষা চলাকালীন স্বাধীনতাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় তা আর শেষ করতে পারেন নি। পরে ভারতীয় দুটি মেডিকেল সংগঠন তাকে ফেলোশিপ দেয়। ১৯৬২ সালে আয়ারল্যান্ডে যাওয়ার বৃত্তি পেলেও বাবার গুরুতর অসুস্থতার কারণে যাওয়া হয়নি।
১৯৬০ সালে ডা. এখলাছ ফটিকছড়ির রোসাংগিরির জমিদার আরমান আলী চৌধুরীর কনিষ্ট কন্যার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর এক ছেলে ও পাঁচ মেয়ে; সকলেই উচ্চশিক্ষিত। একমাত্র ছেলে ডা. মাসুদ পারভেজ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন । ২০২১ সালের ৭মে একমাত্র ছেলেটি মারা যান । এর পর মৃত্যুবরণ করেন ডা.এখলাছের স্ত্রীও।
স্কুলজীবন থেকে ডা. এখলাছ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে জাতির প্রতিটি অপরিহার্য আন্দোলন- সংগ্রামে রয়েছে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। মেডিকেল স্কুলে ১৭০ দিন ধর্মঘট করে চট্টগ্রাম মেডিকেল স্থাপনেও তিনি ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৮ সালের আইয়ুবের সামরিক শাসনের সময়েও হুলিয়া জারি হলে তাঁকে বগুড়া, কুষ্টিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে আত্মগোপন করে থাকতে হয়। ১৯৬৮ সালে সীতাকুণ্ড থানা আওয়ামী লীগের প্রথম সক্রিয় কমিটি গঠিত হলে ডা. এখলাছ ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাঁর ওপর চরম নির্যাতন চালায়। ১৯৭১ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতের হরিণা ক্যাম্পে প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ও মোটিভেটর ছিলেন তিনি। এ ছাড়া যুবশিবির ও শরণার্থী শিবির দেখভাল দায়িত্বও তাঁর ওপর ছিল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর ডা. এখলাছ সীতাকুণ্ড এলাকার দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে সিভিল প্রশাসন স্থাপন করেন।স্থানীয় এমপির অনুপস্থিতিতে তিনি ডেপুটি এডমেনিস্ট্রেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সার্বক্ষণিক রাজনীতি করতে গেয়ে ডা. এখলাছকে বিভিন্ন সময়ে আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। ’৭১ সালে সীতাকুণ্ডের বড়দারোগাহাটে তার একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয় দুষ্কৃতিকারীরা। এছাড়া বহরপুরে তাঁর গ্রামের বাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় পাকবাহিনী। ড. কামাল হোসেনের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করার সময় সীতাকুণ্ড বাজারস্থ তাঁর চেম্বার পুড়িয়ে দেয়া হয়।

লেখক- প্রধান সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও chatganrbani.com