[bangla_date] || [english_date]

নিজস্ব প্রতিবেদক  *

সরকার থেকে স্বল্পমূল্যে পাকাঘর নির্মাণ করে দেয়ার কথা বলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় অর্ধকোটি হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক রুবেল। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে সম্প্রতি এ ঘটনা ঘটে। ৩/৪ জনের ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করে দিয়ে বাকীদের টাকা নিয়ে চম্পট দেয় রুবেল। তবে মুঠোফোনে জানা যায়,  সে এখন কক্সবাজার অবস্থান করছে। রুবেলের হাতে প্রতারিত নিরীহ মানুষগুলো চোখে অন্ধকার দেখছে। তারা না পারছে কাউকে বলতে না পারছে সইতে।

প্রায় ৭মাস ধরে কাজ বন্ধ আকবরের পাকাঘরের নির্মাণ কাজ

চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ থেকে সরকারিভাবে নামমাত্র মূল্যে লাখ টাকার পাকা ঘর করে দেয়ার  লোভ দেখায় প্রতারক রুবেল। গৃহহীন নিরীহ অসহায় মানুষগুলো ঘরের আশায় তার ফাঁদে ধরা দেয়। রুবেল সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর ইউনয়নের পূর্বসৈয়দপুর গ্রামের কালামিয়া বাড়ির মদিন উল্লাহর ছেলে। ছোটভাই সোহেলও তার অপকর্মের সহযোগী।

প্রতারণার শিকার এমন বেশ কজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মো. রুবেল ‘রুবেল কন্সট্রাকশন’ নামে এলাকায় ড্রয়িং অনুয়ায়ী পাকা, আধাপাকা দালাননির্মাণ, সাটারিং, সেনটারিং, মিক্সার ও ভাইভ্রেটর মেশিন ভাড়া দেয়ার কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করতো।গ্রামের বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট নির্মাণে এসব উপকরণ সরবরাহ করার সুবাদে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষের সাথে অল্পসময়ে আলাদা একটা পরিচিতি হয়ে ওঠে রুবেলের। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ  ভূমিহীনদের মাঝে পাকাঘর নির্মাণ করে দেয়ার কার্যক্রম শুরু করলে তখন থেকে রুবেল নিজগ্রামের কয়েকজন নিরীহ ও ভূমিহীন লোককে টার্গেট করে শুরু করে প্রতারণার নতুন ফাঁদ। রুবেল ও তার ভাই সোহেল সরকারিভাবে যেসব ঘরনির্মাণ করে সেই আদলে ড্রয়িং- ম্যাপ নিয়ে এলাকার পরিচিত ভূমিহীন অসহায় লোকদের কাছে যোগাযোগ শুরু করে। এলাকার ভূমিহীন পরিবারকে সরকারিভাবে ঘরগুলো তার (রুবেল) মাধ্যমে নির্মাণ করা হবে- এমন প্রচারণা শুরু করেন তারা।

চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের কর্মকর্তারা রুবেলকে দায়িত্ব দিয়েছেন এ এলাকার (পশ্চিম ও পূর্ব সৈয়দপুর) ভূমিহীন পরিবারের নাম সংগ্রহের জন্য। রুবেল ও সোহেল এমনও বলেছে, ‘স্থানীয় মেম্বার- চেয়ারম্যানদের কোনো হাত নেই ঘর দেয়ার ক্ষেত্রে। জেলা পরিষদের কর্তাদের খুশি করতে ঘুষ (টাকা) দিতে হবে। ঘোষণা দেয় গরিবদের নামমাত্র টাকায় দেয়া হবে লাখ টাকার ঘর। এই লোভে হতদরিদ্র মানুষেরা টাকা নিয়ে হাজির হয় তার কাছে। বেশ কজনের কাছ থেকে জনপ্রতি ৭০হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক-দুই লাখ টাকা করে নেন ঘরনির্মাণ বাবদ।  বহু মানুষ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার কৌশল হিসেবে তডিঘড়ি করে নিজ এলাকা পূর্বসৈয়দপুর মো. ফারুক ও আশিষ এর পাকাঘর নির্মাণ শুরু করে দেয়। এতে ঘর পেতে আগ্রহী লোকদের মনে আশার আলো সৃষ্টি হয় যে, ঘর নির্মাণকাজ অন্তত শুরু হয়েছে। প্রতারকচক্র স্রেফ আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টির জন্যে প্রথমে নিজ এলাকার ২জনের ঘরের নির্মাণকাজ শুরু করেছে- এটা হতভাগ্য ভুক্তভোগিরা মোটেই আঁচ করতে পারেনি। এটিকে পূঁজি করে আগ্রহী নিরীহ লোকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেয়ার তৎপরতা আরও জোরেশোরে শুরু করে দেয় রুবেল। প্রতারণায় যাতে মানুষের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি না হয়, সেজন্যে রুবেল তার ভাই সোহেলের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ঘর নির্মাণ করে দেয়ার নামে যাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিচ্ছে স্থানীয় ২/৩জনকে সাক্ষী করে চুক্তিপত্র করা হয়। সরকারিভাবে ঘরনির্মাণের কাজ স্বচক্ষে দেখে গরীব নিঃস্ব লোকদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগে।

নুর আলম বল্লার অর্ধনির্মিত পাকা ঘরের কাজ প্রায় ৬মাস ধরে বন্ধ

রুবেলের দাবী অনুযায়ি যে আগে টাকা দেবে সে আগে ঘর পাবে-এমন প্রচারণায় অভাবী মানুষগুলো গৃহপালিত একমাত্র সম্বল গরু-ছাগল বিক্রি করে, কেউ ধার-কর্জ নিয়ে স্বপ্নের ঘরের আশায় রুবেল ও সোহেল সহোদরের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে শুরু করে। পূর্ব  সৈয়দপূরের ফকির আহমদ, নুরনবী,ওমরগণি, মো. রিংকুসহ আরও বিভিন্ন জনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করে নেয় রুবেল।  নিজ গ্রামের পর পাশের দক্ষিণ পশ্চিম সৈয়দপুর গ্রামেও রুবেল পরিচিতজনদের কাছে সরকারিভাবে ঘরনির্মাণ করে দেয়ার প্রচারণা শুরু করে।

এখানকার আলী আকবরের কাছ থেকে নেয়া হয় ২লাখ ১০হাজার টাকা। এলোমুনিয়াম ফ্যাক্টরিতে ছোটখাটো চাকরি করে ৪ মেয়ে ১ছেলে নিয়ে টানপোড়নের সংসার আলী আকবরের। সরকারিভাবে ঘরনির্মাণ করে দেয়ার খবর দেয় রুবেল। স্বপ্নের ঘর পাবার আশায় ফাউন্ডেশন দিয়ে পাকাঘর নির্মাণ করে দেয়ার কথা বলে প্রথমে দেড় লাখ টাকা নেয় রুবেল। তড়িঘড়ি পাকাঘর নির্মাণের কাজও শুরু করে দেয়। কাজ চলাকালীন সময়ে কয়েকদফায় নেয়া হয় আরও একলাখ দশ হাজার টাকা। এর উত্তর পাশের বয়স্ক বিধবা অজিবা খাতুন থেকে নেয়া হয় আশি হাজার টাকা। এমন কৌশল অবলম্বন করে জয়নাল আবেদীন, নুর সোলেমান, কামাল উদ্দিন, রবিউল হোসেনসহ এখানকার বিভিন্নজন থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়।

একই সময়ে একই কায়দায় উত্তর পশ্চিম সৈয়দপুর গ্রামেও বহু পরিবার এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এখানকার পিচের মাথার পশ্চিম পাশে নুর আলম বল্লার কাছ থেকে আশি হাজার টাকা নিয়ে ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করে আস্থা অর্জন করে রুবেল। রুবেলের এমন কর্মযজ্ঞ দেখে অনেকেই উৎসাহী হয়ে ওঠেন। অল্পটাকায় পাকাঘর পাবার আশায়  অনেকেই গোপনেও রুবেলের সাথে যোগাযোগ শুরু করে দেয়। সচক্ষে পাকাঘর নির্মিত হচ্ছে দেখে প্রতারণার ফাঁদে ধরা দেয় স্থানীয়রা। ৭০ হাজার থেকে এক-দেড়লাখ টাকা করে নিয়েছে বহু পরিবারের কাছ থেকে।

মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে সিএনজি অটোরিক্সাচালক আলমগীরের কাজ থেকে নেয়া হয় ৭০ হাজার টাকা। ২০মে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে কাজ শুরু করার কথা বলে স্ট্যামে চুক্তিনামার মাধ্যমে এসব টাকা নেয়া হয়।রুবেল তাড়াতাড়ি ঘরনির্মাণ শুরু করবে-এমন আশ্বাস পেয়ে আলমগীর স্ত্রী, সন্তান ও মা নিয়ে যে কুড়েঘরে বসবাস করতো তা ভেঙ্গে পেলে। ঘরের আশায় গরুছাগল বিক্রি করে আলমগীর পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেয় গরুঘরে। গরু ঘরে ঠাঁই নেয়া আলমগীর মাসের পর মাস নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করলেও রুবেলের কোনো সাড়া নেই। একই কায়দায় এখানকার নুরুল হুদা, আলা উদ্দীন, আবু জাফর, নুর হোসেন,সোহেল, বাদল হোসেন, এনাম হোসেনের কাছ থেকে জনপ্রতি ৭০ হাজার টাকা এবং পারভেজ এর কাছ থেকে এক লাখটাকা হাতিয়ে নেয় রুবেল। চমক দেখানো বল্লার ঘরও ৬মাস আগে নতুন ঘরে চতুর্দিকে ইটের ৫/৬ফুট পাকা পিলার তোলার পর উধাও হয়ে যায় চক্রের হোতা রুবেল। আলী আকবরের ঘরের ৯টি পিলারের ৪/৫ফুট করে ওঠানোর পর কাজ বন্ধ। পূর্ব সৈয়দপুরের সেলুন দোকানদার আশিষ থেকে এক লাখ ৬০হাজার টাকা নিয়ে ৯টি পিলারের ৩-৪ফুট করে ওঠানোর পর কাজ বন্ধ রাখা হয়। ফারুকের ঘরের চতুর্দিকে নিচের অর্ধেক পাকা পিলার দেয়ার পর রুবেলের আগাগোনা বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ৬-৭মাস অতিবাহিত হলেও রুবেলের কোনো হদিস নেই।

প্রতারণার শিকার বল্লা, ফারুক ও আশিষ ও আকবর চাটগাঁর বাণীকে বলেন, ‘রুবেল এলাকার পরিচিত মানুষ এবং ঘরের নির্মাণকাজ শুরু করে দেয়ায় আমাদের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। কাজ চলা অবস্থায় স্ট্যামে সই নিয়ে টাকা নেয়ায় আমরা বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস করতে পারিনি। এভাবে প্রতারণা করে আমাদের পথে বসিয়ে দেবে- আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। তার ব্যবহৃত  মোবাইল ফোনে যোগযোগ করলে ফোন ধরে না।’

প্রতারক রুবেল নিজগ্রাম পূর্বসৈয়দপুর থেকে পালিয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা ভূমি অফিসের দক্ষিণ পাশে একটি কলোনীতে পরিবার নিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে পরিবার রেখে রুবেল চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান নিয়েছে। প্রতারণার শিকার হওয়া ভুক্তভোগী নিঃস্ব লোকজন প্রতিনিয়ত ধর্না দিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। রুবেলের স্ত্রী কাউকে একবছর কাউকে ছয়মাসের মধ্যে টাকা ফেরত দেয়ার আশ্বাস দিলেও ৬-৭ মাস অতিবাহিত হলেও একজনের টাকাও পরিশোধ করতে পারেনি। রুবেলের স্ত্রী জানান, তার স্বামী মানুষ থেকে এভাবে টাকা নিয়েছে তা তিনি জানতেন না বলে দাবি করছেন। তার স্বামী রুবেল এখন কক্সবাজার ব্যবসা করছেন বলে জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ এর সদস্য আ ম ম দিলসাদ এর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি চাটগাঁর বাণীকে বলেন, “রুবেল ছেলেটা জেলা পরিষদে সাবকন্ট্রাকে কাজ করতো। বিভিন্নস্থানে কাজের নিম্নমান ও অনিয়ম দেখে আমি নিষেধ করে দিয়েছি, সে (রুবেল) নিজের জন্যে দেড়-দু’বছর আগে একটা ঘর চেয়েছিল, কিছুটা সামর্থবান মনে হওয়ায় তাকে ঘর দেয়া হয়নি। রুবেলের এমন প্রতারণার কথা শোনে বিষ্ময় প্রকাশ করে আ ম ম দিলসাদ বলেন, “জেলা পরিষদ এর পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের প্রতিটি উপজেলায় ২জন করে ভূমিহীন পরিবারকে পাকাঘর করে দেয়া হয়। কারও কাজ থেকে কোনো টাকা নেয়া হয়নি।”

প্রায় অর্ধকোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া রুবেল এর মোবাইলে কল করা হলে সে কক্সবাজার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত আছেন বলে জানায়। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ঘর দেয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে চাইলে ‘সাংবাদিক’ পরিচয় পেয়েই সে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কিছুক্ষণ পরে আবার ভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করা হলে রুবেল  বলে, ‘যারা ঘর করে দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল তারা করে দিচ্ছে না।’

তারা কারা, সরকারিভাবে ঘর দেয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছেনতো আপনি, এখন ঘর কে করে দেবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েকজনকে ঘর করে দিয়েছি, বাকীগুলো নির্বাচনের পর কী করা যায় দেখি- এমন আশ্বাস দেন প্রতারক রুবেল।”