[bangla_date] || [english_date]

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী  *

২০২৩ সাল আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। রাত ১২টা বাজলেই নতুন বছরে আমরা প্রবেশ করবো। এক বছর আগে যেভাবে ২০২৩-এ প্রবেশ করেছি, এক বছর পর ২০২৩-কে বিদায়ী বছর বলে বিদায় জানাচ্ছি। এই এক বছরে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জীবনে অনেককিছু ঘটে গেছে, ব্যক্তিগতভাবে অনেকের জীবনে এই এক বছরে অনেক অর্জন যেমন ঘটেছে আবার অনেক অর্জনই ধরা দেয়নি। জাতীয় জীবনেও অনেককিছু ধরা না দেয়া এবং ধরা দেয়ার মধ্যে এই এক বছর ছিল চলমান। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতা অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করেই এগুচ্ছে। সেই সব চ্যালেঞ্জের অভিঘাত থেকে মুক্ত থাকা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।

২০২০-২১ সালে যখন করোনার অভিঘাতে গোটা বিশ্ব থমকে দাঁড়িয়েছিল তখন মনে হয়েছিল এমন বিপর্যয়কর সময় বোধহয় আর অতিক্রম করতে হবে না। কিন্তু ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে পৃথিবী টালমাটাল হয়ে গেল। সেই অভিঘাতে আমাদের মতো দেশগুলো ব্যবসাবাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানিতে বড়ো ধরনের ধাক্কা সামাল দিতে হলো। ২০২৩ সালটি শুরুই হয়েছিল অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে। ডলার সংকট আমাদের আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রায় ৩০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটালো। এর ফলে আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে আমাদের অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে গেল। বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠলো। এক পণ্যের দাম বাড়তে না বাড়তেই আরেক পণ্যের দামও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে থাকে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ভূ-রাজনৈতিক সংকট ২০২৩ সালে ব্যাপকভাবে আমাদের মতো দেশগুলোকে বিপাকে ফেলেছিল। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারব্যবস্থা টালমাটাল হয়ে উঠেছিল। নিকট অতীতে এমনটি খুব বেশি একটা দেখা যায়নি। দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক থাকেনি। হুন্ডির মতো কালো ব্যবসা এতে প্রবেশ করেছে। ফলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ এক মাসে বেড়েছে তো অন্য মাসে কমেছে। হুন্ডি কারবারিদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক এটে উঠতে পারেনি। ফলে বছরটি আমাদের জন্য অস্বাভাবিক এবং অস্তিতিশীলতারও জন্ম দিয়েছিল। তবে সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষার সমর্থন বৃদ্ধি করে তাদের কিছুটা কষ্ট লাঘব করেছে। সে কারণে দেশে বড়ো ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য প্রান্তিক অথবা নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনে ঘটেনি।

অর্থনীতি বেশ চাপের ভেতর দিয়েই বছরটাতে গেছে। বিরোধীরা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার গুজব আর অপপ্রচার ছড়িয়েছে দেদার। তারপরও ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প সমাপ্ত করেছে। এগুলোর উদ্বোধনও ঘটেছে। কর্নফুলী বঙ্গবন্ধু টানেল, পদ্মা রেল সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, দোহাজারী কক্সবাজার রেললাইন চালু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, একসঙ্গে শত শত সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট উদ্বোধনসহ অসংখ্য প্রকল্পের উদ্বোধন ঘটেছে এ বছরই। ২০২৩ সালে গৃহহীন পরিবারদের মধ্যে বিনামূল্যে বাসস্থান বিতরণ করা হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ উপরে উঠে আসার সুযোগ পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড়ো ধরনের কোনো সংকট সৃষ্টি হয়নি। সে কারণে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।

আমাদের গার্মেন্টসশিল্পে এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি ৭.৯৬ শতাংশ বেড়েছে। গত তিন মাস ধরে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৩ সালে প্রবাসে কর্মী প্রেরণের গতি বৃদ্ধি অব্যহত রয়েছে। এটি এখন দেড় কোটি ছাড়িয়ে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতি ২০২৩ সালে নিকট অতীতে কয়েক বছরের চাইতে একটু বেশি চাপে থাকলেও শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো ভয়ানক সংকটে পড়তে হয়নি। দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকায় চাল আমদানি করতে হয়নি। ফলে খাদ্যসংকট অনুভূত হয়নি। যদিও বাজারে আলু, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যসামগ্রী নানা সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে ভোক্তাদের বেশ কষ্টে ফেলেছে।

২০২৩ সালটি রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনের বছর হিসেবে প্রথম দিকটা স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়েই এগুচ্ছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে রাস্তায় সক্রিয় ছিল। কিন্তু সকল মহলই আশঙ্কা করছিল বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না? রাজনীতি সচেতনমহল মনে করেছিল বিরোধী দলগুলো নিজেদের কর্মী সমর্থকদের চাঙা করার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু গত ২৮শে অক্টোবর বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচি সহিংস রূপ ধারণ করায় সমস্ত হিসাবই বদলে গেল। বিরোধী দলগুলো হরতাল অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং রেললাইন কাটাকাটি, অগ্নিসংযোগে মানুষ পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি কর্মসূচি প্রদানের মাধ্যমে নির্বাচন প্রত্যাখান করায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বড়ো ধরণের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। তবে ২০১৩ সালের মতো অগ্নিসন্ত্রাস, যানবাহন পোড়াপুড়িসহ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় আক্রমণ ও মানুষ হত্যার মতো ব্যাপক হারে নাশকতা ঘটাতে পারেনি।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনকারীরা গত দুমাস সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনি তফসিল বাতিল এবং নির্বাচন কমিশন ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু তাদের আন্দোলন এবং কর্মসূচি খুব একটা জনসমর্থন পায়নি- ফলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সম্মুখে এবং আশপাশের কয়েকটি রাস্তায় যুগপৎ আন্দোলনকারীদের বক্তৃতা, খণ্ড খণ্ড মিছিল ছাড়া আর তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারতসহ পৃথিবীর বড়ো বড়ো দেশগুলো নজিরবিহীনভাবে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে। অতীতে কখনো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বৃহৎ দেশগুলো এতখানি সম্পৃক্ত হয়নি। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস-এর ভূমিকা সবচাইতে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো থেকে বিরতিহীনভাবে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি ঢাকায় আসা যাওয়া করেছেন।

২৮ শে অক্টোবরের পর নির্বাচনি তফসিল ঘোষিত হলে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেমন বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়েছে, একইভাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের খুব কাছাকাছি উপনীত হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি আগের মতোই বহাল আছে। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীর প্রচারণা শেষ পর্যায়ে বেশ উত্তপ্ত ও উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। কিছু কিছু হামলা, দুর্ঘটনা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়া পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূলেই যাচ্ছে। তবে যুগপৎ আন্দোলনকারীরা দেশের মানুষকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে আহ্বান জানাচ্ছে। এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে তাদের নতুন কর্মসূচি আসছে বলে হুমকিও দিচ্ছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী এবং নির্বাচন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রশি টানাটানির মাঝেই ২০২৩ সাল বিদায় নিচ্ছে। অন্যান্য বার দেশে নতুন বছর বরণ করার যে ধরনের প্রস্তুতি শহরগুলোতে পরিলক্ষিত হতো- এবার সেরকম উত্তেজনা আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না। তবে নতুন বছর সীমিত আকারে হলেও বরণ করা হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

২০২৩ সালের নানা অর্জন, চ্যালেঞ্জ, রাজনৈতিক উত্তেজনা ইত্যাদিকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বের মতো আমরাও ২০২৪ সালকে বরণ করতে যাচ্ছি। ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রধান বিরোধী দল এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর থেকে দেশের পরিস্থিতি একভাবে তৈরি হতো। এখন হয়তো আমরা তীব্র একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের অপেক্ষা করতে পারতাম। কিন্তু সেটি আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটেনি। তবে প্রধান বিরোধী দল ছাড়াও নির্বাচনে যেসব দল ও প্রার্থী অংশ নিয়ে এখন মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তাতে নির্বাচনি উত্তেজনা ও উত্তাপ কিছুটা ভিন্ন চরিত্রের হতে যাচ্ছে। যদিও বর্জনকারী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন প্রতিহত করার হুমকি মাঝে মধ্যেই দিয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত তারা কী করবে সেটি হয়তো দেখার অপেক্ষা করতে হবে। আপাতত অংশ নেয়া দল ও প্রার্থীরা প্রচারণার শেষ মুহূর্তে আছেন। তাদের মধ্যেও উত্তেজনার কমতি নেই। সকলেই আশা করেন নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে শেষ হবে। কোনো ধরনের সংঘাত কারো কাছেই কাম্য নয়। নির্বাচনটি ভালোয় ভালোয় শেষ হলে যে সরকার গঠিত হবে সেই সরকারের ওপর প্রত্যাশার পারদটি অনেক বেশি উঠে আছে। ২০২৪ সালের শুরুতে নির্বাচন এবং সরকার গঠন সম্পন্ন হওয়ার পর অনিয়ন্ত্রিত বাজার, দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি, বৈশ্বিক সম্পর্ক এবং নির্বাচনি ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই সরকারকে মাঠে নামতে হবে। ২০২৪ সাল অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক হানাহানির মধ্যে যেন না পড়ে- সেই কঠিন দায়িত্ব নিয়েই সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নতুন বছরের সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে আসতে হবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: ইতিহাসবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়