[bangla_date] || [english_date]

মোহাম্মদ ইউসুফ *


স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মু. জসীম উদ্দিন ২০২৩ সালের ১১ জুলাই তদন্ত করে ২৭লাখ ৫০ হাজার টাকার দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে সেই টাকা ১৫দিনের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। টাকা জমা না দিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সরকারি কোষাগারে টাকা জমা না দিয়ে পুনঃতদন্তের আবেদন করেন জাহাঙ্গীর চৌধুরী। এ অবস্থায় আবার নতুন করে হাসপাতাল সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর দুর্নীতি তদন্তের দায়িত্ব পান স্বাস্থ্যমন্ত্রকের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালে এ তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রকের পুনঃতদন্তেও সরকারি অনুদানের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের অনুকূলে সরকারি অনুদান প্রদান বন্ধ করা হয়েছে। প্রথমবার সরকারি অনুদানের টাকা প্রদান স্থগিত করা হয়েছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রক এ হাসপাতালকে প্রতিবছর ২কোটি টাকা অনুদান দিয়ে আসছে। হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত সরকারি তহবিল তছরূপসহ স্বজনপ্রীতি,দুর্নীতি এবং সরকারি অনুদানের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ হাসপাতালের অনুকূলে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বরাদ্দ থেকে ১৭,৫০,০০০ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে ১০,০০০০০ টাকা জরুরিভিত্তিতে চালানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব স্নেহাশীষ দাশ স্বাক্ষরিত ২০ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের এক পরিপত্রে। টাকা জমা দিতে ব্যর্থ হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। টাকা জমা দেয়ার নির্দেশনার ইতোমধ্যে দেড়মাস গত হয়েছে। সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দেয়া হয়েছে কি না- তা জানতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সিনিয়র সহকারী সচিব স্নেহাশিষ দাশকে হোটাসঅ্যাপ মেসেজ ও মুঠোফোনে বারংবার কল করার পরও তাঁরা সাড়া দেননি।
সরকারি কোনো বিধিনিষেধ না মেনে দীর্ঘদিনধরে অবৈধভাবে হাসপাতালের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন মেয়াদোত্তীর্ণ কার্যকরী কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরী। ২০১৫ সাল থেকে এ হাসপাতালের অনুমোদিত কার্যকরী কমিটি নেই। এ কমিটির সাধারণ সভা আহবান করা, ডায়াবেটিক মেলা করার বৈধতা না থাকলেও অননুমোদিত কমিটির বরখাস্তকৃত সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরী যথারীতি সকল কার্যক্রম নিজের মতো করে পরিচালনা করে আসছেন। গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ফরিদুল আলম এক পরিপত্রের (স্মারক নম্বর-৪১.০১.১৫০০.০০২১৬.১২৫.১৮.৩২৭ তারিখ ৩০মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ) মাধ্যমে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের ডাকা বার্ষিক সাধারণ সভা স্থগিত করলেও সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অননুমোদিত সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরী হাসপাতালের ২০কর্মচারি, ভাড়াটে লোকজনসহ ৫০/৬০ জনের উপস্থিতিতে এজিএম অনুষ্ঠানের বাহাদুরি দেখান। অথচ চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির ৫হাজারের অধিক জীবন সদস্য আছেন।

শুধু স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের অনুদান নয়, হাসপাতালের উপার্জিত আয় থেকে শুরু করে সকল সরকারি-বেসরকারি দান-অনুদানের টাকা সমানে ‘হজম’ করছেন জাহাঙ্গীর চৌধুরী। এর আগে হাসপাতালের বিভিন্ন খাতে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালে সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রশাসক নিয়োগের আদেশ জারি করলেও আদালত কর্তৃক ৬মাসের স্থগিতাদেশের কারণে প্রশাসক নিয়োগ হয়নি। ৬ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির বহিস্কৃত সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর আবেদনের মাধ্যমে প্রশাসক নিয়োগের স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়। হাসপাতাল তহবিলের টাকায় সকলকে ম্যানেজ করে জাহাঙ্গীর চৌধুরী বহাল তবিয়তে আছেন, চলছে দুর্নীতির লাগামহীন মহোৎসব। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), চট্টগ্রামের পরিচালক এস এম এম আক্তার হামিদ ভূঁইয়া জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে হাসপাতালের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান চালাচ্ছেন বলে চাটগাঁর বাণীকে মুঠোফোনে জানিয়েছেন।
আয়-ব্যয়,কেনাকাটা থেকে শুরু করে হাসপাতালের কোনো কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বলতে কিছুই নেই। জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে ঘিরে আবর্তিত হয় সবকিছুই। যেনতেনভাবে বিল-ভাউচার বানিয়ে হাসপাতালের টাকা আত্মসাৎ করাই একমাত্র উদ্দেশ্য এখানে। বিনাটেন্ডারে ও সিডিএ’র অনুমতি না নিয়ে প্রায় ৩কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতালের ৬তলা ভবনের নির্মাণকাজ যখন শেষ পর্যায়ে তখন সিডিএ তা বন্ধ করে দেয়, এখনও কাজ বন্ধ রয়েছে। বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় করে ভবননির্মাণ করলেও হাসপাতালের কোনো কাজে আসছে না।
হাসপাতালে প্রভিডেন্ট ফান্ড (পিএফ) নিয়েও চলছে মহাদুর্নীতি। ১৯৯৮ সাল থেকে চালু হওয়া পিএফ ফান্ডে কর্মকর্তা-কর্মচারিরা প্রতিমাসে চার লাখ টাকার ওপরে জমা দিয়ে আসছেন। বর্তমানে এ ফান্ডে ৭/৮ কোটি টাকা থাকার কথা। এ ফান্ডে কতটাকা জমা আছে- তা কখনো প্রকাশ করা হয় না, কারো জানার সুযোগ ও সাহস নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ডের কোনো পাশবই দেয়া হয়নি কাউকে। অবসরে গেলে কর্মচারিদের ২/৩লাখ টাকা দিয়ে বিদায় করা হয়। ২০০৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত যে ৪৩জন কর্মকর্তা-কর্মচারিকে জোরপূর্বক পদত্যাগে ও বেআইনীভাবে চাকরি থেকে অবসরে যেতে বাধ্য করেছেন। এসব চাকরিচ্যুতদের গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে। পরবর্তীতেও অবসরেযাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারিরা তাদের পাওনাদি পেতে নজিরবিহীন হয়রানির শিকার হচ্ছেন- এমন অভিযোগ রয়েছে।
সমাজের সামর্থ্যবানদের দান-অনুদান ও দান-খয়রাতের টাকায় পরিচালিত সেবাধর্মী এ হাসপাতালে সুলভমূল্যে ডায়াবেটিক রোগীদের সেবাদানের কথা থাকলেও বাস্তবে হচ্ছে তার ওল্টোটাই। ডায়াবেটিক রোগীদের এখানে প্রাইভেট হাসপাতালের মতো উচ্চমূল্যে চিকিৎসাসেবা নিতে হয়। বাণিজ্যিক হাসপাতালের মতোই চলছে সমিতির এ হাসপাতাল। আইসিইউ, সিসিইউ,এইচডিইউ থাকলেও বিশেষজ্ঞ কোনো ডাক্তার নেই। হাসপাতালের দৈনিক আয় ১০লাখ টাকার ওপরে। উপার্জিত টাকার ৫০% খরচ করা হলেও হাসপাতালের চেহারা পাল্টে যেতো। প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রাখা যেতো, রোগনির্ণয়ের জন্যে উন্নতমানের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি থাকতো। রোগীরা পেতো উচ্চমানের চিকিৎসাসেবা। হাসপাতালের ফার্মেসী থেকে রোগীরা ন্যায্যমূল্যে ডায়াবেটিসের ওষুধপত্র কিনতে পারছে না।
লেখক- প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম