[bangla_date] || [english_date]
লেখক-  মো. শফিকুল আলম খান

একমাস সময়ের মধ্যে সুন্নতে খতনা করতে গিয়ে কোমলমতী দুই শিশুর মৃত্যু এবং এক শিশুর  পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ কেটে ফেলায় এদেশের  চিকিৎসাব্যবস্থা  তথা ডাক্তারদের দায়িত্বহীনতা নিয়ে সারাদেশে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়।

গত বিশ ফেব্রুয়ারি মতিঝিল আইডিয়েল স্কুলের চতুর্থ  শ্রেণির ছাত্র আহনাফ তাহমিন আয়হামকে খতনার জন্য মালিবাগের জে এস ডায়গনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করা হয়।সেখানে অ্যানেস্থেসিয়ার ভুল প্রয়োগে তার আর ঘুম ভাঙ্গেনি। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা  করে। একইভাবে সাত জানুয়ারি  ইউনাইটেড হাসপাতালে খতনা করতে এসে প্রাণপ্রদীপ নিভে যায় শিশু আয়ানের। অ্যানেস্থেসিয়ার  ভুল প্রয়োগের শিকার হয়ে প্রায় এক সপ্তাহ লাইফ সাপোর্টে থাকার পর সে মারা যায়। এই দুই শিশুর মৃত্যুতে তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের আহাজারি টেলিভিশনে যারা দেখেছে তাদের চোখের পানি কেহ সংবরণ করতে পারেনি। এ শিশু দুটির মা-বাবা এখন কি নিয়ে বাঁচবে? ছেলে দুটিকে নিয়ে তাদের সব স্বপ্ন চুরমার  হয়ে গেছে। এখন কান্নাই হবে তাদের সারা জীবনের সম্বল।   তাদের সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা অভিধানে খুজেঁ পাওয়া যাবে না।এ ধরনের  মৃত্যু  খুবই অনাকাঙ্খিত  ও  দুর্ভাগ্যজনক। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে  কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কারো অবহেলা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় আর কেউ অকালে প্রাণ না হারায়।

এই শিশু দুটির মৃত্যুর রেশ  কাটতে না কাটতেই গত বাইশ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরেক শিশুর পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ কেটে ফেলা হয়।  এর আগে পায়ে হেঁটে হাসপাতালে  আসা এক টগবগে  যুবক রেজাকে এন্ডোস্কোপি করতে অতিরিক্ত অ্যানেস্থেসিয়ার ঘোর কাটতে না পারায় অকালে চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে।

ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা  শিশুসন্তানের বয়স সাত/আট বছর হলে সুন্নত হিসেবে তাদের খতনা করে থাকে। আমাদের সময়ে হাসপাতালে নিয়ে খতনা করার সুযোগ ছিল না। স্থানীয় হাজাম তখন গ্রামের হাজার হাজার শিশুকে খতনা করাতেন। আমাদের খতনাও হাজামই  করেছে। যতটূকু মনে পড়ে হাজাম বাঁশের খুবই সরু ধারালো চিকন কঞ্চি দিয়ে পুরুষাঙ্গের ওপরের চামড়ার অগ্রভাগ কেটে ছাই বা স্থানীয় টোটকা  জাতীয়  কিছু ঔষধ  লাগিয়ে কাপড়ের বেন্ডেজ করে দিতেন। এন্টিবায়োটিক বা অন্য কোন ঔষধ দেয়া হত না। কয়েকদিন পর পর মায়েরা বা পরিবারের  বড় কে্উ কাপড়ের বেন্ডেজ বদলিয়ে গরম পানির সেক দিতেন।আমরা লুঙ্গি দূহাতে মেলে ধরে বাইরে হাঁটতাম যাতে পুরুষাঙ্গের সাথে লুঙ্গি না লাগে। মূলত তখন থেকেই হাফপ্যান্ট ছেড়ে আমাদের লুঙ্গি পরা শুরু।

খতনা সাধারণত মুসলমানের পরিচয় বহন করে। যদিওবা খতনা করাতেই হবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা ধর্মে নেই।স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পুরুষের প‍রনের প্যান্ট বা লুঙ্গি  ফাঁক করে দেখতেন কে মুসলমান  বা কে অন্য ধর্মের। সে অনগ্রসর সময়ে হাজামের করা খতনায় কেহ মারা গেছে বলে কোনো সময় শুনা যায়নি। একবিংশ শতাব্দিতে এসে যখন দেশের স্বাস্থ্য চিকিৎসাসেবায় অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে এবং আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন  হয়েছে  সে সময় খতনা করাতে পরপর তিনটি দুর্ঘটনা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়।

পরপর ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনাগুলো আমাদের দেশের স্বাস্থ্য  ব্যবস্থা তথা ডাক্তারদের সেবা প্রদানে তাদের আন্তরিকতা, দক্ষতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ  করে তুলেছে। এক গবেষণায়  দেখা গেছে, দেশের সিংহভাগ  মানুষ এদেশের চিকিৎসাসেবায় নেতিবাচক  দৃষ্টিভঙ্গি  প্রকাশ করেছে। তাদের ওপর আস্থাহীনতার কারণে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সিংগাপুর ও ব্যাংকক এবং একটু স্বচ্ছল পরিবারের  লোকজন পাশ্ববর্তী  দেশ ভারতে যান চিকিৎসাসেবা নিতে। এতে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বৈধ এবং অবৈধভাবে  বিদেশে পাচার হচ্ছে।

আমাদের দেশে ,দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিৎসকের অভাব নেই।তাদের অনেকেরই  দক্ষতা অন্য যেকোনো দেশের চিকিৎসকের তুলনায়  ঈর্ষণীয়। তারা ইতোমধ্যে চিকিৎসার স্ব স্ব ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখে সুনামের অধিকারী হয়েছেন। কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু চিকিৎসকের অতি মুনাফালোভী ও অনৈতিক  আচরণ সমগ্র চিকিৎসকসমাজকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের অযোগ্যতা, অদক্ষতা,অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, জনবলের ঘাটতি, ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধভাবে  গড়েওঠা বেসরকারী  হাসপাতাল , ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ইত্যাদি পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংকটকে  আরো ঘনীভুত করেছে। করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য  অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার আশ্রয় প্রশ্রয়ে শাহেদ ও ডাক্তার সাবরিনা ও তার স্বামীর উত্তান ও  যোচ্চুরি, কেলেঙ্কারি তখন সারাদেশে আলোচনার খোরাক ছিল। এই অধিদপ্তরের ড্রাইভার মালেকের শতকোটি টাকার মালিক হওয়া ও কেরানী আবজালের দেশে ছাড়াও  কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে বাড়ি কেনার অনেক খবর তখন ছিল বিভিন্ন  পত্রিকার শিরোনামে।এগুলো ছাড়াও পর্দার অন্তরালে থেকে যায় আরো শত শত অনিয়ম ও  দুর্নীতির  খবর। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ  হচ্ছে আন্তরিকতার  অভাব, রোগীকে পর্যাপ্ত  সময় না দিয়ে প্রেসক্রিপসন লিখে দেয়া, কমিশনের জন্য অপ্রয়োজনীয়  পরীক্ষা দেয়া,হাসপাতালে নির্দিষ্ট  সময়ে ডিউটি না করে বিভিন্ন ক্লিনিকে রোগী দেখা ও অপারেশন করা। তাদের বিরূদ্ধে আরো অভিযোগ হচ্ছে, গর্ভধারী মহিলাদের স্বাভাবিক প্রসব না করিয়ে অপ্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করা। বর্তমানে এই অস্ত্রোপচারের  হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি  পেয়েছে। অবশ্যই স্বচ্চল শ্রেণির কিছু মহিলা প্রসববেদনা থেকে  নিস্তার পাওয়ার জন্য অনেক সময় নিজেরাই অস্ত্রোপচারে সম্মতি প্রদান করে। অথচ গ্রামাঞ্চলে বা এমনকি শহরের বস্তিতে প্রতিনিয়ত মেয়েদের স্বাভাবিক ডেলিভারি হতে দেখা যায়। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি মায়ের গড়ে সাত আটটি করে সন্তান হতো। স্থানীয় ধাত্রীরা তাদের স্বাভাবিক  ডেলিভারি  করাতেন।

জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের  দোড়গোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য  বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। করোনাকালীন সময়ে দেশের ষোলো কোটি মানুষকে বিনামূল্যে তিন ডোজ করে টিকা  দিয়ে দেশে করোনায় মৃত্যহার অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায়

নূন্যতম সীমায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। বর্তমানে মা ও শিশুর মৃত্যুহার আমাদের দেশে এ অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায়  খুবই কম। একইভাবে সামগ্রিক  স্বাস্থ্যসেবার সুফল হিসেবে আমাদের দেশের জনগণের  আয়ুস্কাল অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর  তথা চিকিৎসকরা তাদের কাজে আরো নৈতিক ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলে আর কেহ ভুল চিকিৎসায় প্রাণ হারাবে না।

লেখক : বাংলাদেশ  রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত  পরিচালক ।