[bangla_date] || [english_date]

কখনো অনুভব করিনি রাজনীতির বাস্তবতা এতোটাই নির্মম, এতটা করুণ হবে ।যে মানুষটাকে সারাজীবন বিশুদ্ধ সুন্দর একজন মানুষ হিসেবে দেখে এসেছি, শ্রদ্ধা করে এসেছি,ভালোবেসেছি,যে মানুষটি আমার জল-জোছনার ‘নক্ষত্র পুরুষ ’,যে মানুষটি আপাদমস্তক একজন অভিনয় শিল্পী,অভিনয়ের ক্ষেত্রে মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এর পরিবারের একজন হয়ে আমার বাসায়ও এসেছিলেন, সুনাম ও সুখ্যাতির শিখরে পৌঁছা এই মানুষটার গ্রেপ্তার দেখে (সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী,ও নীলফামারী-২ আসনের ৫ম বারের এম পি আসাদুজ্জামান নূর) দেখে মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো,শত স্মৃতি কেঁদে উঠলো।

এই দৃশ্য কোটিদর্শকের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। এটি উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও আতঙ্কের বিষয়।

আমি আশৈশব নন্দিত অভিনয় শিল্পী আসাদুজ্জামান নূরের একজন তীব্র ভক্ত। বহু গুণে গুণান্বিত এক আশ্চর্য সুন্দর মানুষ তিনি। সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রিয় মুখ আসাদুজ্জামান নূর। পরিচয়ের সীমানা ছাড়িয়ে ব্যক্তি নূরভাই এখন গণমানুষের নেতা। জনগণের কল্যাণে উৎসর্গকৃত প্রাণ। ছোটখাটো গড়নের এই একহারা মানুষটির মধ্যে অমিত তেজ আছে,কাজের প্রতি দুর্মর ভালোবাসা,দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। তিনি প্রতিভার অগ্নিস্ফুরণে প্রজ্জ্বলিত একক ও অদ্বিতীয় এক ব্যক্তিত্ব।

আমাদের প্রজন্মের খ্যাত অখ্যাত সকলেই নূর ভাইয়ের ভক্ত। নূর ভাইকে প্রধানত বাঙালি মাত্রেই চেনেন দক্ষ নাট্য অভিনেতা হিসেবে। অসাধারণ কণ্ঠস্বরের অধিকারী তিনি। বাচিক শিল্পী হিসিবে তিনি বাঙালিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম পুরুষ। কাজী সব্যসাচী বা শম্ভু মিত্রকে প্রত্যক্ষ করিনি কিন্তু আমি নূর ভাইয়ের আবৃত্তি শুনেছি। আমরা নূর ভাইকে কাছ থেকে দেখেছি। এই প্রাপ্তি আমার পরম সৌভাগ্য।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একজন সংগঠক হিসেবে এক সময় আমার প্রায় ঢাকা যাওয়া হতো। এক সন্ধ্যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে নূর ভাইয়ের কণ্ঠ নিঃসৃত আবৃত্তি শুনে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়েছিলাম। যেন ঐন্দ্রজালিক স্মৃতি। যেন জাদুতে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম আমরা সকলে। কতো দুর্বল কবিতা নূর ভাইয়ের ম্যাজিকে সবল হয়ে ওঠে। শিল্পরস সঞ্চালনে নূর ভাইয়ের দক্ষতা দেবতুল্য। ভারী, চিন্তাশীল কবিতার পর হালকা ও লঘুরসের কবিতা পাঠ করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিদগ্ধ শ্রোতাকুলকে মোহাবিষ্ট করলেন। আমাদের প্রত্যেকের মনে সেই স্মৃতি চিরন্তন হয়ে আছে। ‘গ্যালিলি’ নাটকে আলী যাকেরের অভিনয় আর আসাদুজ্জামান নূরের আবৃত্তি আমরা মনে করি, স্বাধীন বাংলাদশে শিল্প সাফল্যের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ।

সাধারণ মানুষের মাঝে তিনিও অতি সাধারণ। গ্রামীণ মানুষেরও হৃদয় ছুঁয়ে যায় তাঁর কন্ঠস্বর, আবৃত্তি ও বক্তৃতা শুনে ।

আসাদুজ্জামান নূর

আসাদুজ্জামান নূর ব্যস্ততম এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। জীবন উৎসর্গ করেছেন নাট্যচর্চায়। নাগরিক এর তিনি প্রধান প্রাণপুরুষ। মঞ্চ নাটক অনুবাদও করেছেন অনেকগুলো। বিজ্ঞাপনী ব্যবসায় তারা সূচনালগ্নের পথিক। আবৃত্তির জন্য  শ্রম দিয়ে গেছেন শেষ পর্যন্ত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতি। দেশের প্রান্ত-প্রত্যন্ত এলাকার সংস্কৃতিকর্মী নেতাদের সুখ-দুঃখের তিনি অংশীদার। আসাদুজ্জামান নূরকে কখনো সংস্কৃতিকর্মীরা দূরের মানুষ ভাবেন না। তিনি সকলের বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ আছেন।

আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান, মৌলিক মানুষটির নাম আসাদুজ্জামান নূর।

অনেক রকম আলো ফেলে আমরা নূর ভাইকে শ্রদ্ধা করি। মঞ্চের নূর ভাই আর টেলিভিশন নাটকের নূর ভাই, চলচ্চিত্রের নূর ভাই, অভিনেতা নূর ভাই এখন কিংবদন্তীর পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন। তিনি অদ্বিতীয় অভিনেতা। শিল্পী সংস্কৃতির প্রতীক তিনি। দেওয়ান গাজীর কিসসা, কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, নূরলদীনের সারাজীবন, মুখোশ, অচলায়তন, মোহনগরী, গডোর, প্রতীক্ষায়, এসব নাটকে তাঁর অভিনয় আমাদের স্মৃতিতে ইতিহাস হয়ে আছে। অনুবাদ, অভিনয় ও পরিচালনায় তাঁর দক্ষতা সকলেই জানেন। তাঁর প্রতিভা ও ক্ষমতার মূল্যায়ন করার মতো ব্যক্তিও আমাদের সমাজে বিরল।

নূর ভাইয়ের জাদুকরী কণ্ঠের কি তুলনা হয়? ভারী কিন্তু নরম ও মিষ্টি। খুব তীব্রতা আছে। তাঁর কণ্ঠধ্বনি গমগম করে তরঙ্গমালার আকারে কাছে থেকে দূরে ছড়িয়ে পড়ে। তার শারীরিক ও বাচিক অভিনয় যখন একই সঙ্গে সাঙ্গীতিক মূর্ছনায় জ্বলে ওঠে তখন এক আশ্চর্য অনুভূতির জগতে আমরা পৌঁছে যাই।

নূর ভাই সত্যি একজন জাদুকর। ঘোর লাগা আচ্ছন্নের মধ্যে তিনি আমাদের নিয়ে যান। তাঁর অভিনয় বারবার দেখি। বারবার নবনব উপলব্ধি হয় আমাদের।

নূর ভাইকে প্যান্ট শার্ট পরা অবস্থায় সাংস্কৃতিক কোনো অনুষ্ঠানে শেষ কবে দেখা গেছে বলতে পারবে না কেউ। আমরা দেখিনি। মনেও পড়ে না। নূর ভাই ম্যান অব স্টাইল। ফ্যাশন নয়, তিনি স্টাইলের পক্ষপাতী।

শ্মশ্রুমন্ডিত চেহারা। গভীর আয়ত লোচন। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। অনেক মমতাময়।

নূর ভাই মানুষের জন্য কাজ করেন। তাই তিনি রাজনীতিতে অনেক সক্রিয় ছিলেন। তিনি সংসদ সদস্য। তিনি মন্ত্রীও ছিলেন।

এসব পোশাকি পরিচয়ের বাইরে তিনি শুধুই একজন সংস্কৃতি কর্মী। সংস্কৃতির সেবক। আমি আরও অনেক কারণে নূর ভাইয়ের ভক্ত।

নূর ভাই যেকোনো বৈঠকি আড্ডায় অতি আকাঙ্ক্ষিত এক ব্যক্তি। নূর ভাই অসাধারণ হয়েও খুব সাধারণ থাকতে পারেন। প্রয়াত সৈয়দ হক কিংবা হুমায়ূন আহমেদের তিনি অতি সজ্জন ও প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন।

নূর ভাই পেইন্টিংয়ের সমঝদার। চিত্রকলা বিষয়ে তিনি আত্মমগ্ন এক ব্যক্তি। রীতিমতো বিশাল সংগ্রহশালা তাঁর। অনেক দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য চিত্র তাঁর সংগ্রহে আছে। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীরা তাঁর নিকটজন। তাঁদের সঙ্গে তাঁর সখ্য ও বন্ধুত্ব। যেকোনো চিত্রপ্রদর্শনীতে নূর ভাইয়ের উপস্থিতি অনিবার্য।

বাংলাদেশের চিত্রকলা ও আসাদুজ্জামান নূর প্রায় সমার্থক। সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসেবে চিত্রশিল্পীদের স্বার্থ সংরক্ষণে তিনি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। পেইন্টিয়ের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসা সর্বজনবিদিত।

চিত্রকলা ছাড়াও নূর ভাই বাংলা কবিতার আকণ্ঠ নিমজ্জিত পাঠক। তিনি কবিতায় মগ্ন। নূর ভাই সিরিয়াস সাহিত্য পাঠক। বিশ্বসেরা নাটক গভীর মনোযোগ দিয়ে তিনি করেছেন। সাম্প্রতিক সাহিত্য ও লিটল ম্যাগ বিষয়েও তিনি বিস্তর খোঁজ-খবর রাখেন।

শুনেছি ভিন্ন ধরনের ডিজাইন ও আরামদায়ক কাপড়ের পাঞ্জাবি সংগ্রহ করা নূর ভাইয়ের শখ। কারো পরম্পরায় শুনেছি, নূর ভাই সহজপ্রাপ্য নয় এমন সোমরসের সংগ্রাহক।

আর নূর ভাইয়ের বয়স আমরা কেউ জানতে চাই না। গত ত্রিশ বছর ধরে নূর ভাইকে একই রকম দেখছি। তাঁর গঠনের কোনো পরিবর্তন নাই,শুধু দাড়িটা একটু শ্বেত শুভ্র হয়েছে। খ্যাতি বারবার বাঁক বদল করেছে। মানুষ হিসেবে একবারও বদলাননি,আগের মতই আছেন। আমরা মনে করি, নূর ভাইয়ের বয়স কখনো পঞ্চাশের অধিক হতে পারে না। নূর ভাই চির যুবক। চির তারুণ্য তাঁর বৈশিষ্ট্য। নূর ভাই সময়ের অগ্রগামী নায়ক। তিনি নটরাজ।

নূর ভাইয়ের প্রতিভার কাছে আমরা সমর্পিত। আমরা চ্যানেল আইতে অনেকবার বন্যাদির গান আর নূর ভাইয়ের আবৃত্তির মেলবন্ধনে অনুষ্ঠান দেখেছি। সেসব স্মরণীয় অনুষ্ঠান শেষে অনেককে নূর ভাইয়ের পদধূলি নিতে দেখেছি। তাঁর কণ্ঠের জাদুতে হতবিহ্বল হয়েছি।

নূর ভাই জাদুকরী চরিত্র। আমি সৌভাগ্যবান যে, আমি এই উচ্চমাপের একজন ব্যক্তিত্বের সামান্যতম সান্নিধ্য পেয়েছি। হুমায়ূন আহমেদ এর সাথে সম্পর্কের কারণে আরও গভীরভাবে পেয়েছি।সমুদ্র বিলাস নাটক করার সময় এক ডজন অভিনেতাসহ হুমায়ূন আহমদ আমার সীতাকুণ্ডের বাসায় এসেছিল।নূর ভাইও ছিল।আমি নূর ভাইকে নিয়ে বাঁশবাড়ীয়া সমুদ্র সৈকতে গিয়েছি।

নূর ভাই, একজ  মৃত্তিকা সংলগ্ন মানুষ। আমার প্রিয় মানুষ,শ্রদ্ধার মানুষ।

মাননীয় উপদেষ্টা ড.আসিফ নজরুলও  একজন সংস্কৃতি কর্মী ছিলেন,সংবাদ কর্মী ছিলেন, এখনও লেখক আছেন।তিনি একজন শিক্ষাবিদও বটে।অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন  উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশার জায়গাটাও একটু বেশী।শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গাতে তিনি ঊর্ধ্বে হলেও আমাদের শীলার স্বামী হিসেবে,হুমায়ূন আহমেদ এর জামাতা হিসেবে  তাঁকে আমিও জামাতার চোখে দেখি।

আশা করি আসাদুজ্জামান নূর এর বিষয়টি আইন উপদেষ্টা হিসেবে তিনি  আন্তরিকভাবে দেখবেন।এভাবে চলতে থাকলে সরকারের ভাবমূর্তি তলানীতে যাবে।অন্তত নূর ভাইয়ের বিষয়টি এ দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক,সংস্কৃতি কর্মী,দর্শক স্রোতা কেউ ভালোভাবে নিচ্ছেনা।অবস্থার পরিস্থিতিতে মানুষ প্রকাশ করতে না পারলেও এটাই সত্য কথা।এভাবে গণহারে  মামলা ও গ্রেপ্তারের মহোৎসবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সৌন্দর্যও বিনষ্ট হবে বলে আমার ধারণা।

পরিশেষে বলবো- শিল্পীর সম্মান, মর্যাদা ও আদর্শের পুনর্জাগরণ ঘটাতে না পারলে,কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী সংস্কৃতি কর্মীরাও  দাসের মত মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়বে।অভিনয়শিল্পীদের এক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

একজন শিল্পীর সুমহান মর্যাদা সমুন্নত থাকুক  অনন্তকাল।নূর ভাই দ্রুতই ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে, আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় দীর্ঘজীবন লাভ করবেন নূর ভাই – এটাই কামনা।

লেখকঃ ড.মনওয়ার সাগর, কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক ।