[bangla_date] || [english_date]

দেশমাতৃকার স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে যেসব বীরসেনানী মরণপণ লড়াই করে আমাদের একটি স্বাধীন দেশ, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত এনে দিয়েছেন,তাঁদেরই একজন তেজদীপ্ত,দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত অকতোভয় বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম মন্টু। চট্টগ্রাম সেক্টর কমান্ডার ফোরাম সভাপতি আলম মন্টু মনে-প্রাণে একজন বাঙালি,বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট চার জাতীয় মূলনীতিতে বিশ্বাসী, রণাঙ্গণের সাহসী এ মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে অধ্যয়নকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম অবিভক্ত জেলা ছাত্রলীগের সদস্য। ১৯৬৭-৬৯ পর্যন্ত সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ১৯৬৭ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি স্বাধীনবাংলা নিউক্লিয়ার্স এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ফলে ১৯৬৬ সালের ৬দফা আন্দোলন,৬৯এর গণঅভ্যূত্থান,একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনোটা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেননি।যুদ্ধের সময় তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন, যা তাঁকে এখনো ভোগায়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সৃষ্টি হলে তিনি এ সংগঠনের চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।স্বৈরাচার এরশাদ ও খালেদা জিয়ার দুঃশাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম মন্টু

বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের পনেরোবছরের শাসনের মূল্যায়ন করতে বলা হলে বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম মন্টু চাটগাঁর বাণীকে বলেন, “বিগত ১৫বছরে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর দুরদর্শী নেতৃত্বে অবকাঠামো,স্বাস্থ্য,শিক্ষা,নারীর ক্ষমতায়ন,আন্তর্জাতিক সম্পর্কউন্নয়ন,শান্তিচুক্তি,সমুদ্রবিজয়,নাগরিকসেবার মান ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, হাতে হাতে মোবাইল ফোন ও দেশজুড়ে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় পাল্টে গেছে জনগণের জীবনধারা। সরকারের মেগাপ্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। উড়ালসেতু,পদ্ধাসেতু,মেট্রোরেল,কর্ণফুলী টানেল,এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পগুলোতে ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারসহ প্রায় সকল খুনের বিচার করে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করা হয়েছে। তবে হতাশার বিষয়- যে লক্ষ্য-আদর্শ নিয়ে ৩০লাখ শহিদ আত্মাহুতি দিয়েছে,২লাখ ৬৯হাজার মা-বোন তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছে ৫দশক পরেও তা পূরণ হয়নি। রাজনীতিবিদদের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ নেই বললে চলে। জাতীয় সংসদ পরিণত হয়েছে চেম্বার হাউজে। সংবিধানকে বিভিন্ন সময়ে কাটাছেঁড়া করা হলেও এখনও তা যুগোপযোগী হয়ে ওঠেনি। আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশেষ সিন্ডিকেটের কবব্জায় চলে গেছে। দ্রব্যমূল্যের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশে অভাবিত উন্নয়ন হলেও সুশাসনের সঙ্কট চলছে।

সপরিবারে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম মন্টু

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নুরুল আলম মন্টু বলেন, “একাত্তরের ৯মাসের মুক্তিসংগ্রামের অনেক স্মৃতি রয়েছে। তবে একটি মুক্তিযুদ্ধস্মৃতি আমাকে সবসময় নাড়া দেয়। একাত্তরের অক্টোবর মাস, তখন আমরা চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান করে বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি।চট্টগ্রাম শহরে বিএলএফ এর ৪টি  ও এফএফ এর ৩-৪টি গ্রুপ ছিল; প্রত্যেক গ্রুপে ১১জনের বেশি নয়। তবে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেশকিছু শিক্ষিত যুবক সম্পৃক্ত হয়ে লোকাল ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ছোটখাটো অপারেশন বা রেকির জন্যে তৈরি করা হয়। গেরিলাযুদ্ধের কৌশলে প্রথম মেটেরিয়াল তারপর মানুষ অপারেশন। পাকিস্তানের অর্থনীতির চাকা অচল করে দেয়ার উদ্দেশে পাথরঘাটার সেন্টপ্লাসিড স্কুলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কেথলিক ক্লাবের ৫০গজের মধ্যে (ত্রিকোণ আকৃতির) রাস্তার মধ্যবর্তী স্থলে ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেখানকার ক্লাবে অবস্থারত ২০-৩০জন পাকআর্মি ও মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য বেরিয়ে আসলে তাৎক্ষণিকভাবে গুলি করে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়। তবে স্থানটা খুব কঠিন ও জটিল বিধায় স্থানীয় কারো সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া অপারেশন করা দুরূহ ছিল।সৌভাগ্যবশত ত্রি-কোণ আকৃতির দুই রাস্তার মধ্যবর্তী স্থলে একটি দোতলা বাড়ি ছিল। এ বাড়িসংলগ্ন বড় ড্রেনটি ফিরিঙ্গিবাজার হয়ে কর্ণফুলীতে পড়েছে। দোতলা ভবনের ওপর তলায় একজন খ্রিস্টান শিক্ষিকা বসবাস করতো। এ ভবনের গাঘেঁষে ছিল ট্রান্সফরমারটির অবস্থান। আমাদের গ্রুপে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নেয়া একজন খ্রিস্টান ছেলে ছিল, নাম পল রবিনস প্রকাশ বাবলা। ছেলেটি পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে দুলহাজারা খ্রিস্টান হাসপাতালের চিকিৎসক হন। তাকে বলার পর সে ওই মহিলার সাথে যোগাযোগ করে আমার সাথে বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়। এ বিধবা মহিলার দুই কন্যাসন্তান ছিল। একজন কলেজে অন্যজন স্কুলে পড়তো। অপারেশনের পর এ পরিবারের ভবিষ্যত নিয়ে আমাদের মানসিক অস্থিরতা দেখে ওই মহিলা আমাদের বললেন, আমার প্রথম সন্তানের বয়স তোমাদের মতোই। একটি দুর্ঘটনায় কিছুদিন আগে তার মৃত্যু হয়। সে বেঁচে থাকলে হয়তো তোমাদের মতো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতো। সে যদি সিদ্ধান্ত নিতো আমার ঘরের সামনে অপারেশন করতে হবে- আমি কী নিষেধ করতে পারতাম। মহিলার এ কথা শুনে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আরও ২/৩বার রেকি করে বাসার দোতলা থেকে ট্রান্সফরমার প্যাডে টিএনটি স্ল্যাব বসিয়ে বাসা থেকে সেফটি কর্ডের মাধ্যমে চার্জ করা হয় এবং বাড়ির বাইরে তিনজন সশস্ত্র যোদ্ধা মোতায়েন করা হয়, যাতে ক্লাব থেকে পাকসেনা বা মিলিশিয়াবাহিনীর সদস্যরা বের হলে গুলি চালানো যায়।রাত দুটো নাগাদ অপারেশন শুরু হয়। অপারেশনের পর পর সমস্ত এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জ্বিত হয় এবং পাকসেনারা ভয়ে ক্লাব থেকে বের হয়নি।আমরা নিরাপদে ড্রেন দিয়ে ফিরিঙ্গিবাজার পৌঁছি।এ ঘটনায় একজন বিধবা বাঙালি মহিলার সাহস এবং ত্যাগ কোনোভাবেই ভুলার নয়।২/৩দিনের মধ্যে বিধবা মহলিা বাসা ছেড়ে চলে যান, আমাদের ঠিকানাও দিয়ে যায়নি। স্বাধীনতার পর অনেক খোঁজেছি তাঁকে ‍কিন্তু কোনো সন্ধান পায়নি। তিনি কিন্তু আমাদের ও দেশকে ঋণি করে গেলেন।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ কী জিজ্ঞেস করলে নুরুল আলম মন্টু বলেন,“বাংলাদেশের মানুষের মন-মানসিকতা অবক্ষয়ের পথে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও এর ছাপ রয়েছে। স্বাধীন-বাংলার আকাশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করলেও ঘুষ-দুর্নীতির মাত্রাও সমানতালে বেড়েছে। সৎ,ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা “অযোগ্য” প্রমাণিত হচ্ছেন। অন্যদিকে সাধারণ জনগণ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছে। এ সংস্কৃতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ রূপ নেবে। অপসংস্কৃতি ও অপরাজনীতির পথ ধরে অপশক্তি ক্ষমতায়ন হয়-অতীত ইতিহাস তা-ই বলে।

আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন কতোটা ঘটেছে- এমন এক প্রশ্ন করা হলে নুরুল আলম মন্টু বলেন, “জয়বাংলা স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা ১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছি। ৩০লাখ শহিদ ও দুলাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ( ৭৫-৯৫) এবং ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭বছর পাকিস্তানী প্রেতাত্মাদের অপশাসনকালে জয়বাংলা স্লোগান হারিয়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে জয়বাংলা স্লোগান উচ্চারিত হলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ৭২ এর সংবিধান অনুযায়ী গণমুখি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বিশেষকরে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন ও একমুখি শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়নি। নেই কোনো স্থায়ী নির্বাচন পদ্ধতি।”

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন চাটগাঁর বাণীর প্রধান-সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফ।