শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রাজা আসে রাজা যায় , বদলায় না সীতাকুণ্ডবাসীর ভাগ্য

মোহাম্মদ ইউসুফ

শোষণ-নির্য়াতন, বঞ্চনা আর নানান হয়রানি সীতাকুণ্ডবাসীর নিত্যসঙ্গী। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে সীতাকুণ্ডের হতভাগ্য জনগণ। জলাবদ্ধতা, যাতায়াত , কৃষি, শিক্ষা, বেকারত্ব, পাহাড়কাটা, পরিবেশদূষণ, মদ-গাঁজা ও ইয়াবাসেবীদের উৎপাতসহ নানান সামাজিক সমস্যায় ক্ষতবিক্ষত শিল্পাঞ্চল সীতাকুণ্ডের অবহেলিত মানুষগুলো। রাজনীতি-অর্থনীতি-কোনো ক্ষেত্রেই উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি নেই। জনদুর্ভোগ নিয়ে জোরালো কোনো তৎপরতা ছিল না জনপ্রতিনিধিদের। দখলে-দূষণে অস্তিত্ব সঙ্কটে রয়েছে এ জনপদ।

স্বাধীনতা অর্জনের চারযুগ গত হলেও যোগ্য ও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সম্ভার,অমিত সম্ভাবনাময় রূপসি সীতাকুণ্ডের কাঙ্খিত উন্নয়ন হয়নি। জনপ্রতিনিধিরা জনসমস্যা সমাধানের চেয়ে  নিজেদের ভাগ্যউন্নয়নে ছিলেন বেশি ব্যস্ত। কালক্রমে জনপ্রতিনিধিরা জনআতঙ্কে পরিণত হয়।bsrm

ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যে অনন্যা প্রকৃতিকন্যা সীতাকুণ্ড দেশের এক ব্যতিক্রমী উপজেলা। গিরি-সৈকতের ছায়াতলে অবস্থিত ‍শিল্পাঞ্চল সীতাকুণ্ড জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অর্থ যোগানদাতা জনপদ। বন্দরশহর চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার, হিন্দুসম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান, সম্ভাবনাময় সীতাকুণ্ড সার্বিকভাবে পিছিয়ে আছে। জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সীতাকুণ্ডের উল্লেখযোগ্য কেউ নেই। কেন্দ্রীয় রাজনীতি ও প্রশাসনে প্রভাব রাখতে পারেন সীতাকুণ্ডের এমন কোনো জাতীয় নেতা নেই। স্বাধীন-বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী এম আর সিদ্দিকী ও সাবেক মন্ত্রী এল কে সিদ্দিকীর পর সীতাকুণ্ড থেকে জাতীয় পর্যায়ে আর কোনো নেতা সরকারের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি। সচিব-অতিরিক্ত সচিব যারা ছিলেন তাঁরা প্রায় সকলেই অবসরে। আগামী প্রজন্মের কাঙ্ক্ষিত সীতাকুণ্ড বিনির্মাণের জন্যে সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা কিংবা রূপকল্প অদ্যাবধি কেউ হাতে নেয়নি। রাজা আসে রাজা যায় কিন্তু সীতাকুণ্ডের ভাগ্য বদলায় না।

শিক্ষা

সার্বিক বিবেচনায় শিক্ষাদীক্ষায় সীতাকুণ্ড এখনও অনেক পিছিয়ে। এ উপজেলার শিক্ষার মান-মর্যাদা তেমনএকটা সুখকর ও সন্তোষজনক নয়। বর্তমানে গর্ব করার মতো সীতাকুণ্ড উপজেলায় কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। আশপাশের উপজেলা থেকে সীতাকুণ্ডের শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে কম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও লেখাপড়ার মানোন্নয়ন হয়নি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকের পদ খালি বছরের বছর। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকায় লেখাপড়ায় দারুণ বিঘ্ন ঘটছে। অনভিজ্ঞ অতিথিশিক্ষক দ্বারা জোড়াতালি দিয়ে চলছে পড়াশোনার কাজ।ads din

স্বশিক্ষিত,অর্ধশিক্ষিত লোকজন-যাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে সম্যক ধারণা নেই, এমন ব্যক্তিরা বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় শিক্ষাকার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আছে,যেগুলো ব্যক্তিবিশেষের প্রেসক্রিপশন ও নিয়ন্ত্রণে চলছে। অনুগতদের দিয়ে গঠিত হয় পরিচালনা কমিটি। বছরের পর বছর প্রধানশিক্ষক ও সহকারি প্রধানশিক্ষক নেই।পরিচালনা কমিটি নিয়ে চলছে চরদখলের লড়াই-যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অনিয়ম-দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে অনেক উচ্চবিদ্যালয়ে। বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ,প্রধানশিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) পুতুল সর্বস্ব,কোনো ক্ষমতা নেই,সকল ক্ষমতা (আর্থিকসহ) একজনের হাতে,একজনের ইশারারায় চলছে সবকিছুই-এমন উচ্চবিদ্যালয়ও সীতাকুণ্ডে আছে। এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত করেছে কেউ কেউ । এমন সভাপতি ও সদস্য ছিলেন,যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা ভোগ করেছেন। এ যদি হয় অবস্থা- তাহলে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা থাকার কথা নয়। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়,সঠিকভাবে সীতাকুণ্ডের স্কুল-কলেজগুলোর চাকা ঘুরছে না।

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাপরিস্থিতিঃ

সীতাকুণ্ড উপজেলা হাসপাতালে ১৬/১৭ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পদায়ন থাকলেও তারা নিয়মিত আসেন না,প্রাইভেট প্যাকটিস নিয়ে বেশি ব্যস্ত। অন্যদিকে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শন নেই, নেই পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা । সব ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণকেন্দ্র-ভবন থাকলেও ভাটিয়ারিতে নেই। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেশকিছু বেসরকারি হাসপাতাল ও বিভিন্ন ক্যাটাগরির ডায়াগনস্টিক সেন্টার এখানে গড়ে ওঠেছে- যার বেশিরভাগের মান নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা প্রশ্ন তোলেন। ল্যাব না বলে এগুলোকে কালেকশন সেন্টার বলা বাঞ্চনীয়। উপজেলাসদরের ল্যাব ও হাসপাতালে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালিত হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের ফার্মেসিগুলোতেও তেমনএকটা নজরদারি নেই। ল্যাব/ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্যাথলজিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক হলেও ইউনিয়ন পর্যায়ে তা নেই।

ক্রীড়া ও সংস্কৃতি

সীতাকুণ্ডের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অতীত গৌরবময় ঐতিহ্য থাকলেও কালক্রমে তা ম্রিয়মান হয়ে গেছে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা হারিয়ে যেতে বসেছে। বিশেষকরে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিরাজ করছে একধরনের স্থবিরতা। শিশুপার্ক নেই, চিত্তবিনোদনের স্থায়ী কেন্দ্র নেই। খেলাধুলার জন্যে ভালো কোনো খেলারমাঠ নেই। নেই কোনো স্টেডিয়াম। উল্লেখযোগ্য ক্রীড়া সংগঠক নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো সামজিক সংগঠনের উদ্যোগে কিংবা ব্যক্তিবিশেষের নামে ফুটবল/ক্রিকেট টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। তবে জাতীয় কোনো বিশেষ দিবসে ছাড়া ক্রীড়া ও সংস্কৃতির ধারাবাহিক চর্চা নেই। সীতাকুণ্ড উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা থাকলেও খেলাধুলার ক্ষেত্রে সংগঠনটির ভূমিকা হতাশাব্যাঞ্জক।

শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত বৈর্জ্য খাল দিয়ে প্রতিনিয়ত যাচ্ছে সাগরে।

বেকারত্ব

ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে দেড়শতাধিক শিল্পকারখানা ও অর্ধশতাধিক শিপব্রেকিং ইয়ার্ড থাকার পরও শিল্পাঞ্চল সীতাকুণ্ডে বেকার সমস্যা প্রকট। রাষ্ট্রায়ত্ব ৪টি পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকারের মিছিল আরও দীর্ঘ হয়েছে। হতাশার অন্ধকারে হতাশজীবন অতিবাহিত করছে হাজার হাজার শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার যুবক। অথচ ৫ শতাংশ লোকের চাকরি হলেও সীতাকুণ্ডে বেকার থাকার কথা নয়। শিল্পমালিকেরা স্থানীয় লোককে চাকরি দিতে একেবারেই নারাজ। এক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। তা হলো-সীতাকুণ্ডের  বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের মান্দারিটোলা গ্রামে সাম্প্রতিককালে ৫টি এলপিজি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলেও ১০/১৫জন দারোয়ান-বাবুর্চি ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারি পদে একজন লোকেরও চাকরি হয়নি। সব শিল্পকারখানার চিত্র প্রায় একই। দেশের অন্যান্য শিল্পাঞ্চলে নির্দিষ্ট কোটায় স্থানীয় লোকদের চাকরি দেয়া হলেও সীতাকুণ্ডে তা দেয়া হয় না। চাকরি দেয়ার ব্যাপারে শিল্পকারখানার মালিকেরা তেমন কোনো চাপে নেই। সকল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা যদি আন্তরিকভাবে সোচ্চার হতেন তাহলে শিল্পপতিরা স্থানীয় লোকজনকে চাকরি দিতে বাধ্য হতেন।

জলাবদ্ধতা

সীতাকুণ্ডের অন্যতম জনসমস্যা জলাবদ্ধতা। খাল-ছরা ভরাট হয়ে গেলেও সংস্কার ও খননের নাম নেই। পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই সীতাকুণ্ডের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে যায়। বর্ষাকালে সৈয়দপুর,বারৈয়াঢালা, মুরাদপুর ইউনিয়ন ও সীতাকুণ্ড পৌরসভার বেশিরভাগ আবাদীজমি ও মাঠঘাট পানিতে তলিয়ে যায়।বসতবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ে, জনজীবন হয় বিপর্যস্ত। জলবদ্ধতার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। খাল-ছরা খনন ও সংস্কারের উদ্যোগ কেন নেয়া হয় না- তা বোধগম্য নয়।সমুদ্রোপকূলীয় বেড়িবাঁধের স্লুইচগেটগুলো সংস্কার জরুরি হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। দীর্ঘকাল আগে বসরতনগরে অপরিকল্পিতভাবে গড়েওঠা রাবারড্যাম্প (স্লুইচগেট) এলাকার পানি নিষ্কাশনের বদলে পানিচলাচলে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৈয়দপুর,মুরাদপুর ও সীতাকুণ্ড পৌরসভার “দুঃখ”এ রাবারড্যাম্পটি সরানোর জনদাবী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমলে নিচ্ছে না।

কমছে কৃষিজমি

সীতাকুণ্ডের তিনফসলী জমিগুলোতে শিল্পপতিদের একেরপরএক সাইনবোর্ড, কৃষকেরা দিশেহারা

সীতাকুণ্ডে কৃষিজমি কমছে আশংকাজনকহারে। একসময় এ উপজেলায় প্রায় ৩৭হাজার একর কৃষিজমি ছিল। কালক্রমে তা দাঁড়িয়েছে ২৪৭০০ একর-এ। পতিত জমির পরিমাণ ২৩ একর ও অকৃষি জমি আছে ৯৪৮১১.৭৬ একর। ফসলের সেই বিস্তীর্ণ আবাদী জমির মাঠ এখন চোখে পড়ে না। অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র গড়ে ওঠেছে বাড়িঘর, খনন করা হয়েছে পুকুর ও জলাশয়। যেদিকে চোখ যায় শুধু জমিক্রেতাদের সাইনবোর্ড। দেশের বড়বড় বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ কৃষিজমি কেনা অব্যাহত রেখেছে। কৃষিজমিতে শিল্পকারখানা না করার সরকারি ঘোষণা থাকলে কেউ তা মানছে না।পরিস্থিতি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, অভাবী কৃষকেরা তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। উপযুক্ত মূল্য পাছে না অনেকেই। সুবিধা ভোগ করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকার চিহ্নিত দালালেরা।

হুমকিতে প্রাকৃতিক পরিবেশ

অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও কলকারখানার নিঃসরিত কালো ধোঁয়া ও ময়লা-আবর্জনায় সীতাকুণ্ডের পরিবেশ-প্রতিবেশ হুমকির মুখে।দক্ষিণ সীতাকুণ্ডে লোকালয়ে কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠায় প্রাকৃতিক পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে আছে। কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে খাল-ছরার পানি লাল হয়ে গেছে, এসব বিষাক্ত পানি  গিয়ে  মিশে যাচ্ছে সন্দ্বীপ চ্যানেলে – যা মৎস্যসম্পদ দিন দিন  বিলুপ্ত হওয়ার পথে। দক্ষিণ সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন কলকারখানার বিষাক্ত গ্যাসে বিবর্ণ হয়ে গেছে গাছপালার পাতা। জীববৈচিত্র্য সঙ্কটাপন্ন। জাহাজভাঙ্গাশিল্পের নেতিবাচক প্রভাব তো আছেই।২/৪টি শিপইয়ার্ডকে গ্রিন শিপইয়ার্ড এর  আওতায় আনা হলেও (পরিপূর্ণ গ্রিন শিপইয়ার্ড নয়) বাকি ইয়ার্ডগুলোতে আদিম পদ্ধতিতে চলছে জাহাজভাঙ্গার কাজ-যার ধকল সইতে হয় শিপইয়ার্ডশ্রমিক ও এলাকাবাসীকে। খালবিল, জলাভূমি দখল-দূষণরোধসহ শিল্পকারখানার যাবতীয় বর্জ্য শতভাগ রি-সাইক্লিন ও এফ্লুয়েন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) করেনি মিলমালিকেরা।

সেচসঙ্কট ও পানীয়জলের অভাব

সীতাকুণ্ডে ভূগর্ভে পানির স্তর না থাকায় গভীর নলকূপ বসানোর সুযোগ নেই। তাই, এখানে পানীয়জলের অভাব ও সেচসঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সেচসঙ্কটের কারণে তৃতীয় ফসল বোরোচাষ করতে পারছে না কৃষকেরা। সাবেকমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার এল কে সিদ্দিকী সীতাকুণ্ডের কৃষিক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে- এমন তিনটি সেচপ্রকল্প (নোনাছড়া,গুপ্তাখালী ও বোয়ালিয়া সেচপ্রকল্প) হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনদশক ধরে এ তিনটি প্রকল্প পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে থাকলেও তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। প্রস্তাবিত এ তিনটি সেচপ্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মাছচাষের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে ত্রি-ফসলের আবাদ ও নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হতো।

হিমাগার সঙ্কট

সীতাকুণ্ড “সবজিজোন” হলেও পচনশীল শাকসবজি সংরক্ষণের জন্যে কোনো কোল্ডস্টোরেজ (হিমাগার) গড়ে ওঠেনি। সরকারিভাবে না হলেও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে হলেও সীতাকুণ্ডসদরে একটি হিমাগার স্থাপন করা কঠিন কোনো বিষয় নয়, প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের। তীব্র প্রয়োজনীয়তা থাকার পরও হিমাগার নিয়ে কেউ তৎপর হয়নি। অতীতে এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় কম লেখালেখি হয়নি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! হিমাগারের অভাবে এখানের কৃষকেরা ও জেলে সম্প্রদায় তাদের শাকসবজি (শিম,টমেটো,ঢেড়শ ইত্যাদি) ,মাছসহ পচনশীল জিনিসের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় ক্রেতাদের মনগড়ামূল্যে (পানিরদরে)কষ্টার্জিত তরিতরকারি ও মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। করোনাকালে ৩৭০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত টমেটো কৃষকের খেতেই পচেগলে নষ্ট হয়ে যায়। হিমাগার থাকলে কৃষকেরা কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হতো না।

পৌরবাসীর বঞ্চনা ও দুর্ভোগঃ

পৌরভবন ও সীতাকুণ্ড মডেল হাইস্কুল সংলগ্ন দীর্ঘদিনের ঝরাজীর্ণ সড়কটি প্রথমবারের মতো এলজিইডির উদ্যোগে পিচঢালাই হলেও ৩/৪ মাসের মধ্যেই সড়কের ভাঙ্গন শুরু হয়ে গেছে।

 

৩ নম্বর সীতাকুণ্ড সদর ইউনিয়নকে পৌরসভা করা হলেও পৌরবাসী নাগরিক সুবিধা পাচ্ছেন না। প্রথম শ্রেণির এ পৌরসভার বাসিন্দারা বর্ষাকালে পানিতে ডুবে থাকে। ময়লা-আবর্জনার উৎপাত তো আছেই। পৌরসদরে ঢুকলে শুধু পৌরবাসী নয়,বাইরে থেকে আগত লোকজন ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনের যাত্রীরাও দুর্গন্ধের ছোঁবল থেকে রেহাই পান না। বছরের পর বছর শেখপাড়া এলাকার মহাসড়কের পাশের ময়লার ডিপো থেকে নিঃসরিত দুর্গন্ধে পরিবেশ বিষিয়ে থাকলেও পরিত্রাণের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। বিল্ডিং কোড না মেনেই রাস্তার গা ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে ভবনগুলো- যা জলাবদ্ধতার কারণ। অপরিকল্পিত এ পৌরশহরে বেশিরভাগ পরিবারের গ্যাসসুবিধা নেই,সুপেয় পানীয় জল নেই। শিশুপার্ক নেই,চিত্তবিনোদনের সুযোগ নেই, নেই কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। আছে মাস্তানী ও চাঁদাবাজি। বিচারপ্রাপ্তিতে ছিল নানান হয়রানি। পৌরসভা ‘ আদালতে’ টাকাছাড়া শালিস-বিচার হয় না- এমন জনশ্রুতি রয়েছে। নিজের জায়গায় ভবননির্মাণ করতেও পোহাতে হয় বিভিন্ন হয়রানি। স্থানীয় কাউন্সিলরের গ্রিনসিগ্যানাল ছাড়া জমি বিক্রি করা যায় না।

সীতাকুণ্ড পৌরসভার প্রাণকেন্দ্র  পৌরভবন ও সীতাকুণ্ড মডেল হাইস্কুল সংলগ্ন দীর্ঘদিনের ঝরাজীর্ণ সড়কটি প্রথমবারের মতো  সাবেক এমপি দিদারুল আলমের শেষ সময়ে এলজিইডির উদ্যোগে পিচঢালাই করা হলেও পৌরপ্রশাসক ও স্থানীয় কাউন্সিলরদের কোনো তদারকি ছাড়া দিঘির পাশে প্যালাসাইটিং  না দিয়ে  নিম্নমানের কাজ করায় ৩/৪ মাস পরই  সড়কের ভাঙ্গন শুরু হয়ে গেছে।  পৌরবাসীর যাতায়াতের আরেক চরম দুর্ভোগের করুণ দশা সীতাকুণ্ড রেল স্টেশন থেকে উপজেলা খাদ্য গুদাম হয়ে  সীতাকুণ্ড কলেজরোড পর্যন্ত  সড়কটির। আলোর নীচে যেন অন্ধকার। জনঅধ্যূষিত পৌরএলাকার প্রতিদিন হাজারো  মানুষের চলাচল থাকলেও  বিগত ৪০বছরেও পৌর মেয়র ও  কাউন্সিলররা এ সড়ক নিয়েমিাথা ঘামায়নি। । তাই  সড়কটির  দুরাবস্থা স্থায়ী রূপ নিয়েছে।

এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে বখাটে যুবকদের জটলা ও ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটে হরহামেশাই। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ত্রিপুরাপল্লী থেকে শুরু করে ব্যাসকুণ্ড আস্তানবাড়ি, সীতাকুণ্ড রেলস্টেশনসহ পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায়,মদ-গাঁজা ও ইয়াবাসেবীদের উৎপাত লেগেই আছে।

যাতায়াত ও যানজট

যাতায়াতের দুর্ভোগ ও হয়রানি সীতকুণ্ডবাসীর নিত্যদিনের অনুসঙ্গ। সীতাকুণ্ড সদর থেকে যারা নিয়মিত চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াত করেন তাদের জন্যে আলাদা কোনো আরামদায়ক বাসসার্ভিস নেই। অতীতে এ নিয়ে বহু সভা-সেমিনার করা হলেও কোনো কাজ হয়নি। লোকাল বাসে ওঠলে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছতে একঘণ্টার জায়গায় দুঘণ্টা লেগে যায়। অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সাথে বাহনসহকারির ঝগড়াবিবাদ তো লেগেই আছে। চাকরিজীবীদের আন্তঃজেলা বাসে কোনোমতে ওঠার সৌভাগ্য হলেও দাঁড়িয়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে কর্মস্থলে যেতে হয়। সীতাকুণ্ড চট্টগ্রাম রুটে আসা-যাওয়ার ট্রেনসুবিধা নেই বললে চলে। বাস-টেম্পো-টেক্সির সুনির্দিষ্ট স্টপেজ ও স্ট্যান্ড নেই। মহাসড়কে সিএনজি অটৈারিক্সা সরকারিভাবে বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষকে কেমন সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। সীতাকুণ্ড সদরে বাইপাস রোডে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা দূরপাল্লার বাস-কাউন্টারগুলোর সামনে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামার ফলে যাত্রী পারাপার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে,প্রায়শ ঘটে দুর্ঘটনা।পরিবহন ক্ষেত্রে সীতাকুণ্ডের মহাসড়কে এখানে কোনো শৃঙ্খলা নেই; চাঁদাবাজিতো আছেই। সীতাকুণ্ডবাসীর যাতায়াত ও যানজট সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্যে সমন্বিত উদ্যোগ নেই। এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক

ছোট্ট জনপথ সীতাকুণ্ডের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্যস্ততম ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশেই অপরিকল্পিতভাবে ভারি শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার কারণে প্রায়সময়ই লেগে থাকে যানজট

ফোরলেন হওয়ার পরও যানজট থেকে মুক্তি মেলছে না সীতাকুণ্ডবাসীর। অব্যবস্থাপনা ও হাইওয়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে মহাসড়কের দক্ষিণ সীতাকুণ্ডে যানজট লেগেই আছে। এ যানজটের মূল কারণ মহাসড়কের পূর্বপাশে গড়েওঠা কন্টেইনার ডিপোগুলো। ডিপো থেকে মালবাহী কন্টেইনার বের হওয়া ও ঢোকার সময় তৈরি হয় যানজট। এছাড়া মহাসসড়কের দুপাশে যত্রতত্র কারখানা ও ডিপোর গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকলেও দেখার কেউ নেই। এছাড়া মহাসড়কে অপরিকল্পিত ইউটার্নের কারণে জনদুর্ভোগ নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে।সীতাকুণ্ড সদর রেলস্টেশনে আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতির ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

কাঁচাবাজার পাকা হয় না

প্রতিবছর মোটাঅঙ্কের হাটবাজার ইজারা হলেও ৫৩বছরেও সীতাকুণ্ড মোহান্তেরহাট কাঁচাবাজারের কোনো উন্নয়ন হয়নি। ক্রেতাদের রীতিমতো “রণপ্রস্তুতি” নিয়ে এ বাজারে ঢুকতে হয়।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর বিমানহামলায় এ বাজারে ১৭জন নিহত ও বেশ কজন ক্রেতা-বিক্রেতা নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এ বাজারে বহুতলভবনবিশিষ্ট একটি কাঁচাবাজার গড়ে ওঠেনি- এটি ভাবতেই অবাক লাগে। শুধু মোহান্তেরহাট নয়,সীতাকুণ্ড উপজেলার কোনো কাঁচাবাজারেই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি।

মাদক-ইয়াবা ও কিশোরগ্যাং

মাদক ও ইয়াবার জোয়ারে ভাসছে সীতাকুণ্ডের গিরি-সৈকত এলাকার ওঠতিবয়সী তরুণেরা। কিশোর-গ্যাংয়ের অপতৎপরতা তো আছেই। সীতাকুণ্ডের নয় ইউনিয়ন ও এক পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে মদ-গাঁজা ও ইয়ারাসেবীদের উৎপাতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ মানুষ। উপজেলার সৈয়দপুর থেকে সলিমপুর,বাঁশবাড়িয়া থেকে কলাবাড়িয়া ও সমুদ্রোপকূলীয় বেড়িবাঁধের নিরিবিলি স্থানে বসে মদ-গাঁজা ও ইয়াবার আসর। ভাটিয়ারি বিজয় স্মরণী কলেজের সামনের একটি জায়গা সন্ধ্যারাতে মাদক-ইয়াবাসেবীদের দখলে চলে যায়।

পর্যটনশিল্প

গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত

সীতাকুণ্ডের অত্যন্ত সম্ভাবনায় খাত হচ্ছে পর্যটনশিল্প। পুরো সীতাকুণ্ডকেই পর্যটনশিল্পের আওতায় আনার মতো সম্ভাব্য প্রাকৃতিক উপাদান বিদ্যমান। অন্যকিছুর প্রয়োজন নেই, শুধু পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নের মাধ্যমে সীতাকুণ্ড হয়ে হঠতে পারে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এক জনপদ। প্রয়োজন শুধু সরকারি সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার দেশজুড়ে আলোচিত সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সী-বিচ (সমুদ্রসৈকত)কে সরকার পর্যটন সংরক্ষিত এলাকা ঘোঘণা করেছে। সরকারি ঘোষণা যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে সীতাকুণ্ডের জনগণ অর্থনৈতিকভাবে যে উপকৃত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে পর্যটন নিয়ে সরকারি ঘোষণার ব্যাপারে সীতাকুণ্ডবাসীর অতীত অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। দু’দশক আগে সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথধাম এলাকাকে পর্যটন সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এবারের গুলিয়াখালী সী-বিচকে পর্যটন সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে পর্যটন মন্ত্রণালয় যে ঘোষণা দিয়েছে, তা আলোর মুখ দেখবে- সেটাই এলাকাবাসীর প্রত্যাশা।পর্যটনকেন্দ্রটিকে পর্যটকবান্ধব করার জন্যে যোগাযোগব্যবস্থাসহ সার্বিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একনেক এর মাধ্যমে বড় প্রকল্প হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।পর্যটকদের জন্যে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তাসহ সম্ভাব্য সবকিছুর আয়োজন করতে হবে।

দক্ষিণ সীতাকুণ্ডে বেড়িবাঁধ ও পর্যাপ্তসংখ্যক সাইক্লোন শেল্টার নেই। সোনাইছড়ি, ভাটিয়ারি ও সলিমপুর ইউনিয়নের সুবিধাজনক স্থানে ফায়ারসার্ভিস স্থাপন করা জরুরি হলেও কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

লেখক- মোহাম্মদ ইউসুফ, প্রধান-সম্পাদক,সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম

সমতল থেকে ১২শফুট উচু সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়। দেশ-বিদেশের সনাতনধর্মালম্বী ছাড়াও সবধরনের নারী -পুরুষের ভিড় সারাবছরই।

 

সর্বশেষ

ফুল ফুটুক আর না ফুটুক, আজ বসন্ত

এই বিভাগের আরও