ডা. সাইফুল আলম *
ফেনীতে ট্রমা সেন্টারে বসে কয়েক দিন ধরে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, পাশের নোয়াখালী জেলার দর্শনীয় কোনো স্হান দেখার চিন্তা। ইউটিউব দেখে গান্ধী ট্রাস্ট আশ্রম ও বজরা শাহী মসজিদ দেখার আগ্রহ জন্মালো। নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলায় কাছাকাছি অবস্থানে হওয়ায় একসাথে দেখতে সুবিধাও হবে।
একাকী যাব ভাবতে ভাবতে ট্রমা সেন্টারে কর্মরত ডা. মো. রিদওয়ান ও ডা.ইসমাইল হোসেনকে বলতেই ওরা রাজী হয়ে যান। ইসমাইলের আবার নিজস্ব এলিয়ন কার আছে। রিদওয়ানের ঐ গাড়িতে যাবার প্রস্তাবে ইসমাইল সম্মতি জানাল।
গেল ৮ ফেব্রুয়ারি আউটডোরে রোগী দেখা শেষ করে আমরা রওনা দিলাম। শেষ মুহূর্তে আমাদের সঙ্গী হলেন ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সিনিয়র এরিয়া ম্যানেজার মো. এম ইউ ইউসুফ,যাকে আমরা মহিন হিসেবে চিনি।
শীতের রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। মনে নতুন কিছু দেখার অনুভূতি। রিদওয়ান, মহিন, ইসমাইল ও আমি-চার সফরসঙ্গী। ইসমাইল নিজেই চালক। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম, ইসমাইল ড্রাইভিংয়ে খুবই ভালো। গানের তালে তালে আমাদের যাত্রা জমে উঠলো।
জমিদারহাট বাজার, সেতুভাঙ্গা বাজার ও আরো অনেক বাজার পেরিয়ে আমরা চৌমুহনী পৌঁছে গেলাম। ফেনী রোড়স্হ আমানিয়া হোটেলে মুরগি-ভাতের সাথে তিন পদের ভর্তা-শিম, টমেটো ও মাছ মিলিয়ে খাওয়া শেষ করে পুনরায় রওনা দিলাম।
চৌরাস্তা মোড় থেকে ডানের রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি এগুতে থাকলো। চার লেনের সুন্দর রাস্তা। সোনাইমুড়ি উপজেলার জয়াগ আমাদের প্রথম গন্তব্য। জয়াগ বাজার থেকে ডান পাশের রাস্তা দিয়ে আমরা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে গান্ধী ট্রাস্ট আশ্রমে পৌঁছে যাই। জনপ্রতি বিশ টাকা করে টিকেট কেটে গান্ধী স্মৃতি জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই নজরে এলো-ডান হাতে লাঠিসহ দাঁড়িয়ে মহাত্মা গান্ধীর বিশাল এক মূর্তি। আমাদের এক ভ্রমণসঙ্গী বলেই বসলেন, মহাত্মা গান্ধী তো এতো বড় ছিলেন না!
ততক্ষণে একজনের সাথে পরিচয় হলো। মো. নুর নবী সাহেব, তিনি গান্ধী স্মৃতি জাদুঘরের ম্যানেজার। মূর্তির এক পাশে একটি গাছ দেখে বিষ্মিত হলাম-যার ফলগুলো অনেকটা ফুটবল সাইজের। নুর নবী জানালেন, নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় এই গাছের নাম ‘ফল বাহার’। গাছের গায়ে সাইনবোর্ডে লেখা পরিচয় থেকে জানতে পারি, এই বৃক্ষের নাম ‘ক্রিসেন্সিয়া কু’জেট’,এটি দক্ষিণ আমেরিকান একটি ছোট বৃক্ষ- যা সেখানে কালাবাস বৃক্ষ নামে পরিচিত। এর শ্বাস খুব বিষাক্ত। ফলটি শোভাবর্ধক বিধায় আঞ্চলিক ভাবে ফলবাহার নামেও পরিচিত।
গাছটির নিচে বসার ব্যবস্থা আছে। ইসমাইল বসে পোজ দিয়ে বেশ কটি ছবি তুললো।
এর পাশে একটি বিলবোর্ডে ‘এক নজরে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট’ শিরোনামে আশ্রমের কর্মসূচির কথা লেখা আছে। মূল কর্মসূচিগুলো হচ্ছে-
শিক্ষা, সাংগঠনিক ও সামাজিক আন্দোলিতকরণ কর্মসূচি, মানবাধিকার , সুশাসন , মানবিক উন্নয়ন এবং আয়বর্ধক কর্মসূচি।
যাদুঘরের মূল ভবনে ঢুকার মুখের ফলক থেকে মহাত্মা গান্ধীর জয়াগ আগমনের উদ্দেশ্য, কিভাবে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট ও গান্ধী স্মৃতি যাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হল- সবই জানা যায়।
১৯৪৬ সালের ১০-২০ অক্টোবর সময়কালে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ থানায় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিবারণ ও মানুষে মানুষে সম্প্রীতি স্হাপনের উদ্দেশ্যে মহাত্মা গান্ধী ৭ নভেম্বর,১৯৪৬ সালে চাঁদপুর হয়ে বেগমগঞ্জ থানার চৌমুহনী রেল স্টেশনে অবতরণ করেন। দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকা পরিভ্রমণকালে গান্ধীজি ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি জয়াগ গ্রামে আগমন করেন।
জয়াগ নিবাসী নোয়াখালী জেলার প্রথম ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষ ওনার স্হাবর,অস্হাবর সমস্ত সম্পত্তি তাঁর পিতা অম্বিকাচরণ ঘোষ এবং মাতা কালীগংগা চৌধুরানীর নামে একটি ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজ সেবামূলক কাজ করার জন্য মহাত্মা গান্ধীকে দান করেন।
১৯৭৫ সনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অম্বিকা কালীগংগা চেরিটেবল ট্রাস্ট ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নম্বর ৫১ বলে “গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট” সৃষ্টি করে। এই অধ্যাদেশ অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট গঠিত হয়।
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন জিনিসপত্র এবং বইপত্রাদি নিয়ে গান্ধী আশ্রমের মূল ভবনে একটি জাদুঘর স্হাপনের উদ্যোগ নেয়, যার মাধ্যমে একদিকে যেমন বাংলাদেশে মহাত্মা গান্ধীর অবস্থানের স্মৃতি ধরে রাখা হবে, অপর দিকে তাঁর অহিংসা ও মানব প্রেমের বাণী প্রচারে সহায়ক হবে।
মহাত্মা গান্ধীর ১৩১ তম জন্মবার্ষিকীতে তৎকালীন বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১২ অক্টোবর, ২০০০ খ্রিস্টাব্দে জাদুঘর উদ্বোধন করেন।
ফলকের পাশের একটি বৃক্ষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নাম-‘ নাগ লিঙ্গম’। এটি হাতির খুব প্রিয় খাবার। এর আরেক নাম ‘হাতির জোলাপ’। ভ্রমণে কত কিছু জানা যায়!
আমরা মূল জাদুঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে নুর নবী সাহেব এসে হাজির। স্বপ্রণোদিত হয়ে জাদুঘরে রক্ষিত ছবিগুলোর পটভূমিসহ বর্ণনা দিতে লাগলেন, সাথে একটি শর্ত দিলেন-এই সময় ছবি তোলা ও কথা বলা যাবে না। মহাত্মা গান্ধীর জন্ম, বেড়ে উঠা, পড়াশোনা থেকে জীবনের খুঁটিনাটি নুর নবী ধারাবাহিকভাবে এক রুম থেকে অন্য রুমে নিয়ে গিয়ে বর্ণনা করে গেলেন। আমরা চারজন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে শুনতে একতলা থেকে দুতলা হয়ে কখন যে শেষ প্রান্তে চলে এলাম টের পেলাম না। এবার নুর নবী আমার দিকে পরিদর্শন খাতা আগিয়ে দিলেন। আমি তো হতবাক! এতো সুন্দর ও তথ্যবহুল জাদুঘর দেখতে পাব – আমি আসার আগে ভাবি নি। সেই মুগ্ধতা নিয়ে কিছু লিখলাম। ইসমাইল আবার সেটি ছবিতে ধারণ করে নিল। আরো একটি ব্যাপার বুঝতে পারি, কেন নুর নবী শর্ত দিয়েছিলেন! আসলে বলার সময় কথা বললে কিংবা ছবি তুললে ভালোভাবে বলার ধারাবাহিকতায় বিঘ্ন ঘটে।
আমরা জাদুঘরে মহাত্মা গান্ধীর ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র, অধ্যয়ন কক্ষ, চিতা ভষ্ম দেখি।
একটি ছবি দেখে চমকে উঠলাম। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে মহাত্মা গান্ধী কুষ্ঠ রোগ জীবাণু দেখছেন। নুর নবী জানালেন, গান্ধীজি
কুষ্ঠ রোগ জীবাণু পরীক্ষা করে কুষ্ঠ রোগীদের সেবা দিতেন।
নোয়াখালীবাসী মহাত্মা গান্ধীর ছাগল জবাই করে খেয়ে ফেলা নিয়ে যে গল্প প্রচলিত আছে তারও ব্যাখ্যা দিলেন নুর নবী। মহাত্মা গান্ধী ছাগলের দুধ খুব পছন্দ করতেন। সেইজন্য তিনি যেখানে যেতেন ছাগল উপহার পেতেন। নোয়াখালীতে আসার পরও তিনি দুধ খাওয়ার জন্য ছাগল উপহার পান। কিন্তু একদিন চোর সেই ছাগল চুরি করে নিয়ে গেলে আর পাওয়া যায় নি। এই হলো আসল ঘটনা।
জাদুঘর থেকে বেরিয়ে আমরা গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় কেন্দ্র চরকা’তে ঢুকলাম। দুইজন বিক্রয়কর্মী-রত্নাপ্রভা মজুমদার ও মিরুফা ইয়াসমিন এর সাথে কথা বলে অনেক তথ্য পেলাম। চরকা দেখার কথা বলতেই মিরুফা ইয়াসমিন আমাদের পেছনের দরজা দিয়ে অন্য রুমে নিয়ে গেলেন। একজন প্রৌঢ় মহিলা চরকায় সুতা কাটছেন। আরেক রুমে কয়েকজন মহিলা তাঁত শিল্পের বিভিন্ন কাপড় বুননে ব্যস্ত। ওখান থেকে বেরিয়ে আমি একটি শাল কিনি। রিদওয়ান কিনলোএকটি তাঁতের শাড়ি।
এবার ফেরার পালা। আসার পথে বজরা শাহী মসজিদ দেখবো। গুগল ম্যাপ দেখে এগুতে থাকে ইসমাইল। সে আবার নিজেকে ‘গুগল ম্যাপ এক্সপার্ট’ বলে দাবি করেন। আমরা সোনাইমুড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পেছনের রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে বুঝলাম, রাস্তা ভুল হয়েছে। একজনকে জিজ্ঞেস করলে জানালেন, বজরা হাসপাতালের সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। তার মানে স্হানীয়রা সোনাইমুড়ি উপজেলা স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সকে এই নামে ডাকে। ঐ রাস্তা ধরে আমরা অল্প সময়ে বজরা গ্রামে অবস্থিত বজরা শাহী মসজিদে পৌঁছে গেলাম। মসজিদের গেট থেকে প্রতিষ্ঠাতার নাম- জমিদার আমানউল্লাহ্ ও প্রতিষ্ঠাকাল ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দ জেনে গেলাম। ভেতরে ঢুকে এই মোগল স্থাপত্য শৈলীতে বিমুগ্ধ হলাম! আমরা সবাই মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করলাম।
নোয়াখালীর দু’টো দর্শনীয় স্থান দেখে এবার ফেরার পালা। চৌমুহনীতে নাস্তার জন্য যাত্রা বিরতি। চৌমুহনী পৌরসভার পাশের মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিলাম সবাই। রাজমহল রেস্টুরেন্টে আমি ও ইসমাইল মুরগির চাপ, রিদওয়ান ও মহিন মুরগির টিক্কার অর্ডার দিলো, সাথে পরাটা। খাবার সুস্বাদু হলেও চা একদম বাজে।
নাস্তা সেরে ফেনী অভিমুখে রওনা হলাম। ইসমাইলের ড্রাইভিং আসলেই ভালো। গাড়ির ছন্দময়তার সাথে মিউজিক, অপূর্ব কম্বিনেশন। যাবার সময় ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ আর আসার সময় ‘ভাল্লাগে’ গানটি বেশি ফিলিংস আনলো। মনে হলো, দ্রুত ফেনী পৌঁছে গেলাম। আসার পথ সবসময় যাওয়ার পথ থেকে ছোট মনে হয়।