নিজস্ব প্রতিবেদক *
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কারো কাছে হাত পেতে নয়, আমাদেরকে আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে হবে। একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা নত না করার। বিশ্ব দরবারে আত্মমর্যাদা নিয়ে আমরা মাথা উঁচু করে চলবো।
মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘একুশে পদক’ তুলে দিয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন ১৫ আগস্টের পর বাঙালি, বাংলাদেশ, বাঙালি সংস্কৃতি সবই থমকে গিয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকেও বঙ্গবন্ধুর অবদানকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্টেও উঠে এসেছিল সংগ্রাম পরিষদ গঠনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কথা। একুশে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ডাকার নির্দেশনা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু অনেকে বলে জেলে ছিলেন, কিন্তু জেলে ছিলেন কেন? ভাষা আন্দোলনের জন্যই তো ছিলেন। এদেশের প্রতিটি সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান রয়ে গেছে। আমাদের যা কিছু অর্জন, তা সব কিছুই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, বিজয় অর্জন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের ইতিহাস বিকৃত হওয়ার পালা শুরু হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিকৃতি ইতিহাস থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পেরেছি। আজকে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যেমন জেনেছে মানুষ, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও জেনেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন কানায় প্রবাসী বাংলাদেশি সালাম ও রফিক নামে দুজন তারা, কয়েকটি দেশে যারা মাতৃভাষায় জন্য সংগ্রাম করছে, মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেয়ার জন্য সংগ্রাম করছে তারা জাতিসংঘে একটা প্রস্তাব পাঠায় যে, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করতে। কিন্তু কোনো সংগঠন থেকে প্রস্তাব নেয় না জাতিসংঘ। সদস্য রাষ্ট্র থেকে প্রস্তাব যেতে হয় এ বিষয়ে। এ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং আমরা প্রস্তাব পাঠাই সেখানে। তারপর এটা গৃহীত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করতে পারছি, ইউনেস্কোর স্বীকৃত। এখন শুধু আমরা না, মাতৃভাষার জন্য রক্তদান করে আমাদের যারা ত্যাগ করে গেছেন নিজের জীবন, মহান আত্মত্যাগ করে গেছেন। তাদের সেই মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে মহৎ আত্মত্যাগ করতে পেরেছি। আজকে ২১ ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বের কাছে সমাদৃত এবং সবাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকার ও পালন করে।
শেখ হাসিনা বলেন, এবছর যারা একুশে পদক পেলেন আজ যাদের পুরস্কার দেয়া হয়েছে তাদেরকে আমি অভিনন্দন জানাই। আমরা সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করি। এখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজের জন্য অবদান রেখেছেন, তাদের সম্মাননা দিতে পেরে আমরা খুশি। তবে সবাইকে তো দেয়া সম্ভব না, তাই যতটুকু পারি সেটা দেয়া হচ্ছে। এ সময় দই বিক্রি করে স্কুল-পাঠাগার নির্মাণকারীর গল্প তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে আন্তরিক ধন্যবাদও জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, কারো কাছে হাত পেতে নয়, আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে হবে আমাদের। একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা উঁচু করে চলতে। বিজয়ী জাতি হিসেবে চলতে চাই। এই কথাটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। আজ আমরা এটুকু দাবি করতে পারি, বাঙালি এখন বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলতে পারে। সেই মর্যাদা আমরা ফিরিয়ে এনেছি। এই মর্যাদা সমুন্নত রেখে আগামী দিনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে দেশকে। কারো কাছে হাত পেতে নয়, ভিক্ষা করে নয়, বিশ্ব দরবারে আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে চলব আমরা। একুশ আমাদের শিখিয়েছে মাথা নত না করার।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এ বছর একুশে পদকের জন্য মনোনীত ২১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের নাম ঘোষণা করা হয়। এ বছর ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে দুইজন, শিল্পকলায় ১২ জন, সমাজসেবায় দুইজন, ভাষা ও সাহিত্যে চারজন এবং শিক্ষায় একজন বিশিষ্ট নাগরিক এ পুরস্কার পাচ্ছেন।
ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন মৌ. আশরাফুদ্দীন আহমদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হাতেম আলী মিয়া। শিল্পকলার বিভিন্ন শ্রেণিতে যারা একুশে পদক পেয়েছেন তারা হলেন- সংগীতে জালাল উদ্দীন খাঁ (মরণোত্তর), বীর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণী ঘোষ, বিদিত লাল দাস (মরণোত্তর), এন্ড্রু কিশোর (মরণোত্তর) ও শুভ্র দেব; অভিনয়ে ডলি জহর ও এমএ আলমগীর; আবৃত্তিতে খান মো. মুস্তাফা ওয়ালীদ (শিমুল মুস্তাফা) ও রূপা চক্রবর্তী; নৃত্যকলায় শিবলী মোহাম্মদ; চিত্রকলায় শাহজাহান আহমেদ বিকাশ; এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও আর্কাইভিংয়ে কাওসার চৌধুরী।
এ ছাড়া সমাজসেবায় মো. জিয়াউল হক ও আলহাজ রফিক আহামদ এবং শিক্ষায় অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু পেয়েছেন একুশে পদক। এ বছর ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক পেয়েছেন চারজন। তারা হলেন-মুহাম্মদ সামাদ, লুৎফর রহমান রিটন, মিনার মনসুর ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (মরণোত্তর)।
ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে ১৯৭৬ সাল থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য এ পদক দিয়ে আসছে সরকার। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণপদক, এককালীন চার লাখ টাকা ও একটি সম্মাননাপত্র দেওয়া হবে।
একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মন্ত্রীপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাসনা জাহান খানম। পরে একুশে পদকপ্রাপ্ত ও মরণোত্তর পদকে ভূষিতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গ্রুপ ফটোসেশনে অংশ নেন।