২০২৪ সালের ‘দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার’ পেয়েছেন তিন জন সাংবাদিক । বৃহস্পতিবার (৫ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিক সম্মেলন ও পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান থেকে এ পুরস্কার ঘোষণা করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)।
জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন ইংরেজি পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টারের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জায়মা ইসলাম। ডেইলি স্টারের ‘আলমস আলাদিনস ল্যাম্প’ শিরোনামে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য তিনি এ পুরস্কার পেয়েছেন।
টেলিভিশন বিভাগে (প্রতিবেদন) বিজয়ী হয়েছেন যমুনা টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আল-আমিন হক। যমুনা টেলিভিশনে ‘অনিয়মের খনি সুবিধাবঞ্চিত নারীদের আইজিএ প্রকল্প’ শিরোনামে প্রচারিত প্রতিবেদনের জন্য তিনি এ পুরস্কার পান।
টেলিভিশন (প্রামাণ্য অনুষ্ঠান) বিভাগে বিজয়ী হয়েছে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘তালাশ’। ‘গরিবের চাল-আটা খায় ডিলার ও কর্মকর্তায়’ শিরোনামে প্রচারিত প্রামাণ্য অনুষ্ঠানের জন্য তালাশ টিম এ বছর এই পুরস্কার পায়।
আঞ্চলিক সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন চট্টগ্রামের একুশে পত্রিকা ডটকমের প্রধান প্রতিবেদক শরীফুল ইসলাম। ‘চিকিৎসাসেবকদের লোভের বলি রোগী’ শিরোনামে প্রকাশিত ৩ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের জন্য তিনি এ পুরস্কার পেয়েছেন।
বিজয়ী প্রত্যেক সাংবাদিক ও তালাশ টিমকে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও দেড় লাখ টাকা করে পুরস্কার দেয়া হয়। ২০২৪ সালে টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কারের জন্য ৫৯টি প্রতিবেদন জমা হয়। এর মধ্যে আঞ্চলিক সংবাদপত্র বিভাগে ৭টি, জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে ৩৪টি, টেলিভিশন বিভাগে ৮টি এবং প্রামাণ্য অনুষ্ঠান বিভাগে ১০টি প্রতিবেদন জমা পড়ে।
“দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার ২০২৪” ঘোষণার আগে দুটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। “নতুন বাংলাদেশ: কেমন গণমাধ্যম চাই?” শীর্ষক প্যানেল আলোচনার শুরুতে টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের ডেপুটি কোঅর্ডিনেটর মাসুম বিল্লাহ গণমাধ্যম সংস্কারের জন্য টিআইবির সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঞ্চালনায় এ প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ, সিনিয়র সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ, নিউ এজ এর সম্পাদক নূরুল কবীর এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম।
আলোচনায় ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা সত্য যে, গণমাধ্যমের ওপর চাপ এখনো আছে। তবে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো যদি জনস্বার্থ, জনকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে না পারে, তাহলে এ পরিস্থিতি পরিবর্তন কখনোই হবে না। গণমাধ্যমের শীর্ষ নেতৃত্বকে সম্পাদকীয় নীতিমালাকে অক্ষুণ্ন রেখে কাজ করতে হবে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সেখানে যেন কোনো প্রভাব না ফেলে। আমরা দেখছি, বর্তমানে সাংবাদিকতার মান অবশ্যই বেড়েছে। তাই আমরা “নতুন বাংলাদেশে” সাংবাদিকতার ইতিবাচক সম্ভাবনার দিকে তাকাতে চাই, আমরা আশা হারাতে চাই না।’
নিউ এজ এর সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, ‘গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক ইতিহাস, সামাজিক ন্যায্যতার হিসেবে সমতা রাখতে হবে। একদিকে ভয় ও অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের আনুকূল্য প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা সেল্ফ-সেন্সরশিপের দিকে নিয়ে যায়। এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে হবে।’
পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, ‘অপতথ্য-ভুলতথ্য মোকাবিলার দায়িত্ব গণমাধ্যমেরই। সঠিক তথ্য-উপাত্ত, বিশ্লেষণের প্রবাহ নিশ্চিতের মাধ্যমে আমাদের তা করতে হবে।’
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে আমরা বরাবরই সম্পাদকীয় নীতিমালাকে উপেক্ষিত থাকতে দেখেছি। জনস্বার্থকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাবের বশবর্তী যাতে সামনের দিনে গণমাধ্যম না হয়, এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাধান্যের জায়গা হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। পরবর্তীতে কোনো রাজনৈতিক সরকার এসে যেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় “বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা” শীর্ষক আরেকটি প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সিনিয়র সাংবাদিক ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশনের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা, দৈনিক গ্রামের কাগজের সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন, অনুসন্ধানী সাংবাদিক মোহা.বদরুদ্দোজা এবং সিনিয়র সাংবাদিক কুররাতুল-আইন-তাহমিনা।
আলোচকরা বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পরও সেল্ফ সেন্সরশিপের চর্চা অব্যাহত রয়েছে। তবে আলোচকরা মনে করেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ কখনোই মসৃণ নয়, প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেই সঠিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে হবে। সাংবাদিক, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সরকারকে সুনির্দিষ্ট কাঠামোবদ্ধ উপায়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করে এমন পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানান বক্তারা। আলোচকরা বলেন, গণমাধ্যমকে নিজের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাংবাদিকের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।