[bangla_date] || [english_date]

নিজস্ব প্রতিবেদক *

দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী এবং সরকারি বাহিনীর সঙ্গে চলমান সংঘাত। গত শনিবার থেকে নতুন করে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরে শুরু হওয়া সংঘাত থামছেই না। দুই বাহিনীর গোলাগুলি ও মর্টারশেলের বিকট শব্দে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে সীমান্তজুড়ে।

চলমান পরিস্থিতিতে সীমান্তের ওপারে বসবাস করা মিয়ানমারের চাকমা জাতি এবং রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় জড়ো হচ্ছে বলে জানা গেছে। বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সীমান্তে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে তারা।

সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বিদ্রোহীদের অবস্থান লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া হচ্ছে গুলি ও মর্টার শেল। গুলির মুহুমুহু শব্দে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ঘর ছেড়েছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তিন গ্রামের মানুষ।

এরই মধ্যে দুপুরে মিয়ানমার থেকে ছুটে আসা একটি মর্টার শেলের আঘাতে নিহত হয়েছেন স্থানীয় জলপাইতলী গ্রামের গৃহবধু ও এক রোহিঙ্গা। এ সময় আহত হয়েছে এক শিশু। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান অস্থিরতায় টেকনাফ হোয়াইক্যং উলুবনিয়া সিমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় এক রোহিঙ্গা পরিবারকে আটক করেছে বিজিবি। এর আগে বিদ্রোহীদের গোলাগুলির মুখে টিকে থাকতে না পেরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৯৫ জন মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)-এর সদস্য। তাদের মধ্যে আহত ৯ জনকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে সীমান্তে মর্টার শেলে দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবাদ জানানোর কথা জানিয়েছেন রিজওয়ান কমন্ডার। সোমবার মর্টার শেলের আঘাতে নিহতরা হলেন, নাই্ক্ষ্যংছড়ির ধুমধুম তুমব্রু জলপাইতলী এলাকার বাসিন্দা হোসনে আরা (৫৫) এবং উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮/ই এর ডি ব্লকের বাসিন্দা মৃত ধলু হোছেনের ছেলে নবী হোছন (৬০)। আহত নুসরাত মনি (৬) স্থানীয় শহিদুল ইসলামের মেয়ে। নিহতরা চাষের জমিতে কাজ শেষে দুপুরের খাওয়ার জন্য বাড়িতে অবস্থান করছিলেন বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।

তথ্যমতে, মিয়ানমারের আরকান রাজ্য ‘স্বাধীনের’ জন্য সরকারি বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আসছে স্থানীয়দের সংগঠন আরাকান আর্মি। প্রতিদিন মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কোনো কোনো এলাকায় চলছে দুই বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ। ইতিমধ্যে আরকান রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল দখলেরও দাবি করেছে আরকান আর্মি। দুই পক্ষের চলমান সংঘর্ষে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুম ইউনিয়ন এবং উখিয়ার পালংখালী ও টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সীমান্তে বসবাসকারীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

গতকাল রবিবারের প্রচণ্ড সংঘর্ষের রেশ কাটতে না কাটতে সোমবার সকাল থেকে তুমব্রু সীমান্ত এবং টেকনাফের উলুবনিয়া এবং উখিয়ার পালংখালীর বটতলী সীমান্তে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। আকাশপথে হেলিকপ্টার থেকে বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হচ্ছে। এ পরিস্থিতে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশের জন্য হাজারো রোহিঙ্গা সীমান্তের ওপারে অবস্থান করছে। সোমবার সকালে অনুপ্রবেশের সময় উলুবনিয়া সীমান্ত থেকে এক রোহিঙ্গা পরিবারকে আটক করেছে বিজিবি। শুধু রোহিঙ্গা নয়, বিদ্রোহীদের ভয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)-এর সদস্যরা। ইতিমধ্যে তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে ৯৫ জন বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।

ধুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য দীল মোহাম্মদ জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সীমান্তে বসবাসকারীদের ব্যপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে গোলাগুলির আতঙ্কে ইউনিয়নের ৩ গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। সোমবার মর্টার শেলের আঘাতে দুইজন নিহত হওয়ার পর স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক আরও বেড়েছে বলে জানান তিনি।

মর্টার শেলের আঘাতে নিহতদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর মান্নান। তিনি বলেন, সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি চললেও আমার দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে সীমান্তে বসবাসকারীদের সরানোর বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন বলতে পারবেন।

টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া এলাকার জালাল আহমেদ বলেন, আজ সকাল সাড়ে দশটার দিকে মিয়ানমারের ওপারে ব্যাপক গোলাগুলি এবং বোমার শব্দ আমরা শোনতে পাচ্ছি। ভয়ে সীমান্ত থেকে লোকজন সরে যাচ্ছে। অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। ১১টার দিকে স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ বাংলাদেশে প্রবেশের সময় এক রোহিঙ্গা পরিবারকে আটক করেছে বিজিবি।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ওপার থেকে রোহিঙ্গা এবং বিজিপি সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে- এমন আশঙ্কায় সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। সাগরে কোস্টগার্ড সদস্যরাও রয়েছে। কোনো অবস্থায় আমরা রোহিঙ্গা কিংবা অন্য কাউকে ঢুকতে দেবো না। সকালে রোহিঙ্গা পরিবারের অনুপ্রবেশের বিষয়টি আমি এখনও অবগত নই।

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান বলেন, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির দুই সদস্যকে আহত অবস্থায় গেল রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে আনা হয়। আজ সকালে আরও সাতজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। আমরা তাদের সেবা দিচ্ছি। বিজিপির চিকিৎসাধীন ওই দুই সদস্য হলেন- রি লি থাইন (২২) ও জা নি মং (৩০)। বাকি সাতজনের নাম এখনও পাওয়া যায়নি।

টেকনাফ ২ বিজির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, সীমান্তে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।

৩৪ বিজিবি কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার লে. কর্ণেল আব্দুল্লাহ আল মাশরুকী বলেন, কোনো অবস্থায় মিয়ানমারের কোনো নাগরিককে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।

বিজিবি কক্সবাজার রিজিওয়নের কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোরশেদ আলম বলেন, মিয়ানমার অভ্যন্তরে চলা সংঘাতের কারণে আমরা সদর দপ্তরের অনুমতিক্রমে ৯৫ জন বিজিপির সদস্যকে আশ্রয় দিয়েছি। তাদের মিয়ানমার হস্তান্তর করার জন্য পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। যে ৭ জন আহত বিজিপি সদস্য রয়েছেন তাদেরকে আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। জলপাইতলীতে দু’জন সাধারণ নাগরিক নিহতের ঘটনাটি অত্যান্ত দুঃখজনক। আমরা এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছি মিয়ানমার সরকারকে।

কক্সবাজার রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উচিত আরকান রাজ্যে আটকেপড়া চাকমা ও রোহিঙ্গাদের সাহায্য করা। যুদ্ধক্ষেত্রে আন্তর্তজাতিক সংস্থাগুলোর- বিশেষ করে রেডক্রস, ডাব্লিউএইচও, ডাব্লিউএফওসহ সকল সাহায্য সংস্থাগুলো সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু মিয়ানমারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা না করে বাংলাদেশে স্থান দেওয়ার কথা বলে। অনেক সময় বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এটি অবান্তর। তারা চাইলে ‍রাখাইনে চলমান পরিস্থিতিতে আটকেপড়া মিয়ানমার নাগরিকদের খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা দিতে পারে আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ না করে।