[bangla_date] || [english_date]

ড. মনওয়ার সাগর *

একটি দেশের জাতীয় মূল্যবোধ তথা জাতিসত্তা এবং সে দেশের অভ্যন্তরে বিদ্যমান সামগ্রিক সংস্কৃতির চেতনা থেকে উৎসারিত হয় সে দেশের জাতীয় সঙ্গীত।

জাতীয় সংগীত  আমাদের পরাণের অথৈ গহিনে নাড়া দেয়। আবেগ সঞ্চার করে।

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত একটি অনন্য সৃষ্টি, যা আমাদের মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করে। এটাই দেশ প্রেম।কোরান ও হাদীসে দেশপ্রেম সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

জাতীয় সংগীতে – স্রষ্টার সৃষ্টি, প্রকৃতির সৌন্দর্য ও অসীম আকাশের স্নিগ্ধ প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।পবিত্র কোরান এর  আলহামদুলিল্লাহ শব্দের ব্যাখ্যায় এসেছে- দুনিয়াতে যেকোনো স্থানে যেকোনো বস্তুর প্রশংসা করা হয়, বাস্তবে তা আল্লাহরই প্রশংসা।

সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কবি জাতীয় সংগীতে দেশপ্রেম ও স্রষ্টার সৃষ্টির সৌন্দর্যের যে প্রশংসা করেছেন,তাতে স্রষ্টার বন্দনায় করা হয়েছে। এ নিয়ে নীচে বিস্তারিত আলোচনা আছে।এখন প্রাসঙ্গিক বিষয়েই আলোচনা করি।

অতি সম্প্রতি (৩ সেপ্টেম্বর/২০২৪) এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী সংবিধানের পাশাপাশি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানান। ইতোপূর্বেও অনেকবার রাজনৈতিকভাবেই প্রস্তাব আনা হয়েছিল জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের।যারা বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংগীত এর পরিবর্তন চেয়েছেন তারা কেউ এ দেশের মূলধারার রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে না।

তাই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে রবিঠাকুরের বিরোধিতা থেকে উৎসারিত জাতীয় সংগীত বদলের দাবিকে বার বার জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।

সকল বিষয়েই আমি বিস্তারিত আলোচনা করবো। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে খুশী বা অখুশী করার জন্য আলোচনা করবো এমনটা নয়।আমি জাস্ট  – বিতর্কিত এই বিষয়টির বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করবো।এর পক্ষে বিপক্ষে মতামত থাকতেই পারে।তবে সেই মতামত যেনো যৌক্তিক ও শালীন হয়।ভালো মতামতের মাধ্যমে পাঠকের জানার জগতও সমৃদ্ধ হবে।

আমি চেষ্টা করবো এর যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার।

এ কথা ঠিক যে, একমাত্র আসমানী কিতাব ছাড়া সবকিছুই পরিবর্তন করা যায়।সংবিধান পরিবর্তন করা যায়,দেশের নাম পরিবর্তন করা যায়,ধর্মান্তরিত হয়ে ধর্ম পরিবর্তন করা যায়,স্বামী স্ত্রী পরষ্পরকে ভালো না লাগলে সেটাও পরিবর্তন করা যায়।পরিবর্তন করা যায়না – এমন কিছু পৃথিবীতে নাই।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে – পরিবর্তন করা গেলোও কেন আমরা পরিবর্তন করবো কিংবা আদৌ পরিবর্তন করা ঠিক হবে কিনা?এর পিছনে শক্তিশালী যুক্তি কি? জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন থেকে আমাদের প্রাপ্তি বা অর্জন  কি হবে? এর মাধ্যমে আমরা কোন চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই? নাকী রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন বলেই – এটা মানা যাবেনা? নাকী ভারতীয় ছিলেন বলেই কেউ কেউ নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথকে মানতে পারছেন না? তাহলেতো প্রশ্ন এসে যাবে কবি কাজী নজরুল ইসলামও ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন। এসব নানা রকম প্রশ্ন সামনে  এসে যাবে।

আবার জামাত এর সাবেক আমীর এর সন্তান বলেছেন বলেই এটা পরিবর্তন করতে হবে? কিংবা পরিবর্তিত সরকার  এসেছেন বলেই সংষ্কারের অংশ হিসেবে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে হবে?

আচ্ছা – যদি প্রশ্ন করা হয় -আজ পর্য্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে ছোঁয়ার  মতো কোন বাঙালি জন্মগ্রহন করেনি, তাই তিনিই এক ও অদ্বিতীয়। বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নোবেল বিজয়ী।এখনও পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সমকক্ষ কেউ নেই।তাহলে কি বলবেন? পারবেন একজন নোবেলবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ দেখাতে?

আপনারা কি জানেন – শুধু বাংলাদেশ ও ভারত নয় শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতও রবীন্দ্রনাথের লেখা ও সুর। ওরা তা পরম শ্রদ্ধা ভরে হৃদয়ে ধারণ করে।

ওনাকে শ্রদ্ধা ও  সন্মান দেওয়ার যোগ্যতা আমরা অর্জন করতে পারিনি। পৃথিবীর সভ্য মানুষ রবীন্দ্রনাথের নাম শুনলেই শ্রদ্বায় মাথা নত করে।

রবীন্দ্রনাথকে অসন্মান করতে হলেও যোগ্যতা লাগবে।

আপনারা কি জানেন-

বিবিসির শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সেরা বাংলা গান হয়েছে ‘আমার সোনার বাংলা’। শুধু আমরা নই, বিশ্ববাসীও এর স্বীকৃতি দিয়েছে। অলিম্পিকে বাজানো সব দেশের জাতীয় সংগীতের একটা র্যাংকিং করা হয়েছিল, যেখানে ‘আমার সোনার বাংলা’ পৃথিবীর তাবত জাতীয সংগীতকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে।

মোট কথা -জাতীয় সংগীত আমাদের আবেগের জায়গা। এটি পরিবর্তন করার দাবি কিসের ভিত্তিতে তিনি তুললেন?

রবীন্দ্র বিরোধীতা এমন এক পর্যায়ে গেছে যে, অনেকেই বলছেন – রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও বিরোধীতা করেছেন।এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির বর্তমান মহা পরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক,রবীন্দ্র গবেষক  জনাব মোহাম্মদ আযম তার সাক্ষাতকারে বলেছেন-

“রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এক কোটি আলাপের বিকল্প বাদ দিয়ে যারা শুধু তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন কিনা– এ বিষয়ে আলাপ তোলে, তারা এক অর্থে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তাদের জন্য আমার আফসোস হয় এই ভেবে, তারা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার রস আস্বাদনে চিরবঞ্চিত।”

এ কথা অনস্বীকার্যযে, কিছু কট্টর মুসলিম – হিন্দু বলেই রবীন্দ্রনাথকে মানতে পারছেন না।কিন্তু তারা কি জানেন বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআনের প্রথম অনুবাদক ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। তবে কেউ কেউ এ বিষয়ে ভিন্নমতও পোষণ করেন।

ইদানিং অবশ্য বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে!বিতর্ক যাই থাকুকনা কেন,বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক যে একজন অমুসলিম মনীষী তথা ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’— এটি একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয়।

কারও কারও মতে -বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রথমেই যার নামটি উচ্চারিত হয় তিনি হলেন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতনামা কবি—শাহ মুহম্মদ সগীর। তবে তিনি সম্পূর্ণ কুরআনের অনুবাদ করেননি, শুধুমাত্র ‘সূরা ইউসুফ’-এর অনুবাদ করেছিলেন এবং এটি ছিল কাব্যছন্দে রচিত। তাই তাঁকে বাংলায় কুরআন অনুবাদের পথিকৃৎ বলা হয়।

এরপর ১৮০৮ সালে মধ্যযুগ পেরিয়ে সুদীর্ঘ সময় অতিক্রমের পর ঊনিশ শতকের প্রথম ভাগে রংপুরের মটুকপুর নিবাসী আমির উদ্দীন বসুনিয়া পবিত্র কুরআনের শেষ পারা অর্থাৎ আমপারার কাব্যানুবাদ করেন। এছাড়াও মওলানা নইমুদ্দীন ও মওলানা আব্বাছ আলীর নামও কেউ কেউ বলে থাকেন।

মওলানা নইমুদ্দীন ও মওলানা আব্বাছ আলীর আগেই ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন শুধুমাত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেই ক্ষান্ত হননি, হাদিসগ্রন্থ মিশকাতুল মাসাবিহরও প্রথম বাংলা অনুবাদক তিনি, এমনকি বাংলা গদ্যে লেখা মহানবী (সা.)-এর প্রথম জীবনী রচয়িতাও এই জ্ঞানতাপস!

এছাড়া নবী-রাসূলদের জীবনী, চার খলিফার জীবনী, ইমাম হাসান-হোসেনের জীবনী, ওলি-আউলিয়ার জীবনবৃত্তান্ত (তাপসমালা), শেখ সাদীর গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ’র অনুবাদ (হিতোপাখ্যানমালা), মওলানা রূমীর মসনবীর অনুবাদ (তত্ত্বরত্নমালা) প্রভৃতি মূল্যবান গ্রন্থ বাংলাভাষাভাষীদের উপহার দিয়েছেন গিরিশ চন্দ্র সেন।

সমস্ত গবেষকদের তথ্য উপাত্ত থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে,মূলত: পূর্ণাঙ্গ কোরানের অনুবাদক গিরিশচন্দ্র সেন এটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য।একাধিক মুসলিম পি এইচ ডি গবেষক এর লেখায় এটাই প্রমাণিত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে গিরিস চন্দ্র সেনতো আরবী পারেন না,অনুবাদ কি করে করবেন? এর উত্তর হচ্ছে

সংস্কৃত, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় সুপণ্ডিত গিরিশচন্দ্র সেন পবিত্র কুরআন অনুবাদের লক্ষ্যে আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য প্রায় ৪২ বছর বয়সে লখনৌ গমন করেন।

সেখানে গিয়ে ৭৫ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ মৌলভী এহসান আলীর কাছে আরবী ভাষা শেখা শুরু করেন। তিনি তাঁর কাছে প্রায় এক বছর আরবী ব্যাকরণ ও দিওয়ান-ই-হাফিজ অধ্যয়ন করেন। এরপর কলকাতার একজন মৌলভী ও ঢাকার নলগোলার মৌলভীর কাছে তিনি আরবী সাহিত্য ও আরব ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করেন।

১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি পবিত্র কুরআন অনুবাদের কাজ শুরু করেন এবং ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তা শেষ করেন। প্রায় চার বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণ কুরআনের অনুবাদ, মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজ অত্যন্ত সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন এই কর্মবীর এবং ইতিহাসের পাতায় চিরতরে ঠাঁই করে নেন।

আমি প্রথমে কোরান ও হাদীসের আলোকে জাতীয় সংগীতকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।অর্থাৎ কোরান ও হাদীসে দেশ প্রেম ও প্রকৃতি প্রেম সম্পর্কে কি বলা হয়েছে।জাতীয় সংগীতে সেই দেশ প্রেম ও প্রকৃতি প্রেম আছে কিনা সেটা একটু গভীরভাবে অনুধাবন করুন।

তাহলেই বুঝতে পারবেন এই রচনায় কবি সৃষ্টিকর্তার বন্দনা করেছেন।

আমরা প্রত্যেক কথায় বলে থাকি আলহামদুলিল্লাহ (সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার)। অর্থাৎ দুনিয়াতে যেকোনো স্থানে যেকোনো বস্তুর প্রশংসা করা হয়, বাস্তবে তা আল্লাহরই প্রশংসা। কেননা এ বিশ্ব চরাচরে অসংখ্য মনোরম দৃশ্য, অসংখ্য মনোমুগ্ধকর সৃষ্টি আর সীমাহীন উপকারী বস্তুসমূহ সর্বদাই মানবমনকে আল্লাহ তায়ালার প্রতি আকৃষ্ট করতে থাকে।কবি এখানে আল্লাহর সৃষ্টির প্রশংসা করেছেন।

আরবী ভাষায় হামদ অর্থ নির্মল ও সম্ভ্রমপূর্ণ প্রশংসা। গুণ ও সিফাত সাধারণতঃ দুই প্রকার হয়ে থাকে। তা ভালও হয় আবার মন্দও হয়। কিন্তু হামদ শব্দটি কেবলমাত্র ভাল গুণ প্রকাশ করে। অর্থাৎ বিশ্ব জাহানের যা কিছু এবং যতকিছু ভাল, সৌন্দর্য-মাধুর্য, পূর্ণতা মাহাত্ম দান ও অনুগ্রহ রয়েছে তা যেখানেই এবং যে কোন রূপে ও যে কোন অবস্থায়ই থাকুক না কেন, তা সবই একমাত্র আল্লাহ তা’আলারই জন্য নির্দিষ্ট, একমাত্র তিনিই-তার মহান সত্তাই সে সব পাওয়ার অধিকারী। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্যই এর যোগ্য হতে পারে না। কেননা সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনিই এবং তার সব সৃষ্টিই অতীব সুন্দর। এর অধিক সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। তার সৃষ্টি, লালন-পালন-সংরক্ষণ-প্রবৃদ্ধি সাধনের সৌন্দর্য তুলনাহীন। তাই এর দরুন মানব মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে উঠা প্রশংসা ও ইচ্ছামূলক প্রশংসাকে হামদ বলা হয়।

এই হামদ বা প্রশংসায় – অর্থাৎ স্রষ্টার সৃষ্টির প্রশংসা,গুন গান করা হয়েছে জাতীয় সংগীতে।

কোরআনের ছয় হাজারেরও অধিক আয়াতের মধ্যে ৫০০ আয়াতে কোনো না কোনোভাবে প্রকৃতির কথা আছে। সৃষ্টিজগৎ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সৃষ্টিজগতের মধ্যে গাছ, পাহাড়, সাগর, পাখি, তারকারাজি, সূর্য, চন্দ্র এবং আমাদের হূদয়ও অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম বিবিধ উদ্ভিদরাজি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ। (সূরা কাফ, আয়াত ৭-৮)।

একটু লক্ষ্য  করলেই দেখবেন আমাদের জাতীয় সংগীত অন্য রকম এক প্রেমময় সুর ও ভাষায় রচিত! এতে প্রকৃতির বন্দনা করা হয়েছে।প্রকৃতির বন্দনা মানেইতো আল্লাহর প্রশংসা।কিভাবে আল্লাহর প্রশংসা সে ব্যাখ্যাটিও আমি কোরান ও হাদীসের আলোকে ব্যাখ্যা করেছি।

এতে কোনো  শাসকের মহত্ব বন্দনা করা হয়নি ! কোনো  রাজা ও রাজন্যবর্গের শৌর্যবীর্যের কথা , যুদ্ধ জয়ের কথা বলা হয়নি! কেন শাসকের শক্তি, রণ কৌশল, সাম্রাজ্য বিস্তার বা রাজা- রাজধিরাজ ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে নিখুঁত বাণী নয়, আধিপত্যের জয়গান নয়! কেন সহজ সরল গভীর দার্শনিক বোধে ঋদ্ধ এ সংগীত প্রেম ও ভালবাসা রসে ভরপুর!এ প্রেম প্রকৃতির প্রেম। ভিন্ন অর্থে মাতৃ প্রেম। দেশ মাতৃস্বরূপা তাই মাতৃবন্দনা গানটির প্রাণ। প্রকৃতির খেয়ালে জন্ম নেয়া মানুষ প্রকৃতি থেকে তার বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করে। হোক সে শারীরিক ক্ষুধার অথবা মানসিক ক্ষুধার খাদ্য। তাই প্রকৃতি মাতৃস্বরূপ।

যে বাতাস তাকে বাঁচিয়ে রাখে, যে আকাশ তাকে স্বপ্নচারী করে, সে আকাশ-বাতাস মানবের হৃদয়ে প্রাণে প্রেম ভালবাসা সুরেলা বাঁশি বাজায়।

ছয় ঋতুর বাংলাদেশে অঘ্রাণের সোনালী ধানের অপূর্ব শোভা যে চিত্রময়তা বাঙালির মানসপটে এঁকে দেয়, মধুমাসে যে সুমিষ্ট ঘ্রাণে প্রাণ ভরে যায়, রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি মায়াবী ঘোর লাগিয়ে দেয়, আবার নদীর কূল যেন মায়ের মমতা ভরা আঁচল এবং সেই মা’র কষ্টে আমরা সন্তানরা নয়ন জলে ভাসি।

পুরো সংগীতেই প্রকৃতির বন্দনার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ আল্লাহর প্রশংসা করা হয়েছে।

এ সঙ্গীত কবির অবিশ্বাস্য রচনা। প্রকৃতিকে মাতৃজ্ঞান করে একটি দেশের জাতীয় সংগীত হতে পারে তাতো আমাদের কল্পনাতীত। শক্তি আধিপত্য বা ঘৃণা নয়, ভালবাসা প্রেম ও প্রকৃতির সাথে মানবের আত্মিক সম্পর্ক আমাদের জাতীয় সংগীতের মূল সুর। আমরা এরকম একটি জাতীয় সংগীতের জন্য গৌরববোধ করি।

পুরো গানটি পরিপূর্ণ,মায়ের প্রতি সন্তানের ভালবাসার নিবেদনে। আমরাতো প্রকৃতির সন্তান । বাংলা মা আমাদের মাতৃস্বরূপা । তাই মায়ের প্রতি সন্তানের আবেগ মথিত ভালোবাসা প্রকাশিত এই সঙ্গীতে।ভক্তিরসে জারিত এই অপূর্ব সঙ্গীতটি।

প্রেম ভালবাসার অসাধারণ সাবলাইম-টি এই গানটিকে পৃথিবীর অন্য সব দেশের জাতীয় সঙ্গীত থেকে আলাদা করেছে। এটি তুলনাহীন একটি জাতীয় সঙ্গীত।

মহানবি আরও বলেন, জাহান্নামের আগুন দুটি চোখকে কখনোই স্পর্শ করবে না, যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে এবং যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় সীমানা পাহারায় বিনিদ্র রাত কাটায় (তিরমিজি)।

সূরা ইবরাহিমের ৪ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি।’

এই দুটি হাদীসেই দেশ প্রেম, দেশের সার্বভৌমত্ব ও মাতৃভাষার কথা বলা হয়েছে।

জাতীয় সংগীত এর  প্রথম লাইনটি ছিল- ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’

যা আমাদের মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করে।- এটা কি দেশ প্রেম নয়?

গানের মধ্যে সোনার বাংলা শব্দটি বাঙালির মূল্যবোধ প্রকাশ করতে পারে বা ফসল তোলার আগে ধানক্ষেতের রঙের তুলনা বোঝানো হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পচিন্তা ও চেতনায় প্রকৃতি অন্যতম এক অনুষঙ্গ। নানা কথামালায় তিনি বলেছেন প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা। দীর্ঘ জীবনপ্রবাহে আর লেখনীতে তাই প্রকৃতির প্রতি মমত্ববোধ আর দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেছেন।

জাতীয় সংগীতের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে আমাদের জানা উচিত মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। জানা উচিত মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে দেশের সূর্য সন্তানদের কী অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এই গান। মাথায় রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুলদের হাত ধরে এই দেশ ও জাতীয় সংগীত। তাই জাতীয় সংগীতকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানে হলো তাঁদের বুদ্ধি, প্রজ্ঞা আর সাহসের দিকে আঙুল তোলা, তাঁদের আবেগ, ভালোবাসা আর দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

আচ্ছা – কেউ যদি দাবী তোলে যে, বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করতে হবে তখন কি করবেন? দেশের নাম যে পরিবর্তন হয়েছে এমন অনেক ইতিহাসও আছে।

যেমন ধরুন-

অতীতে বেশ কয়েকটি দেশ নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।  কেউ ভাবমূর্তি পরিবর্তনের জন্য, কেউ আবার সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে,রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক কারণে, কিংবা  ব্র্যান্ডিং করার জন্য তাদের দেশের নাম পরিবর্তন করেছে।

যেমন ধরুন-

২০২২ সালে টার্কি বা তুরষ্কের নাম পরিবর্তন করে হয়েছে তুর্কিয়ে,

১৯৮৯ সালে সেনাকর্তারা বার্মার নাম বদলে ‘মিয়ানমার’ করেন।

হল্যান্ডের নাম হয়েছে ন্যাদারলেন্ড,

২০১৯ সালে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ রিপাবলিক অফ ম্যাসিডোনিয়ার নাম বদলে রাখা হয় ‘রিপাবলিক অফ নর্থ ম্যাসিডোনিয়া’।

২০১৮ সালে আফ্রিকার দক্ষিণের দেশ কিংডম অফ সোয়াজিল্যান্ডের নাম হয় কিংডম এসওয়াতিনি।

ইরানএক কালে পারস্য (পার্সিয়া) নামে পরিচিত ছিল। ১৯৩৫ সালে ক্ষমতায় আসেন সম্রাট রেজা শাহ। তখনই দেশের নাম বদলে ‘ইরান’ রাখা হয়।

চেক প্রজাতন্ত্রকে  পরিবর্তন করে হয়েছে-  চেকিয়া

ফ্রেঞ্চ রিপাবলি এর নাম সংক্ষেপ করে হয়েছে –  ফ্রান্স,

ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হবার পর  সিলোন নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে-  শ্রীলঙ্কা ।২০১১ সালে সরকারি নথিপত্রেও ‘সিলোন’ নামটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়।

আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপদেশটির অ্যাংলো নাম কেপ ভের্দে। সেটি পরিবর্তন করে ‘কাবো ভের্দেতে’ নাম করা হয়েছে। এ নামের অর্থ হলো সবুজ অন্তরীপ।

কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হওয়ার পর কাম্পুচিয়ার নাম বদলে সরকারিভাবে ‘কম্বোডিয়া’ রাখা হয়।

‘ইন্ডিয়া থেকে বদলে ‘ভারত’ করার প্রস্তাব করতে পারে মোদী সরকার।

আবার কেউ যদি ব্যক্তির নামেও দেশের নাম করতে প্রস্তাব  করে তখন কি করবেন? ব্যক্তির

ব্যক্তির নামেও দেশের নাম হওয়ার বহু উদাহরণ আছে।যেমন-

* আজারবাইজান – অ্যাট্রোপেটস (প্রাথমিকভাবে প্রাচীন গ্রিক ভাষায় অ্যাট্রোপেটেন , নামটি ফার্সি ভাষায় আজারবাইজানে বিবর্তিত হয়েছিল)

* বলিভিয়া-  সিমন বলিভার

* কলম্বিয়া -ক্রিস্টোফার কলম্বাস

*ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র – সেন্ট ডমিনিক

* এসওয়াতিনি (সোয়াজিল্যান্ড)- রাজা মস্বতী দ্বিতীয়

*জর্জিয়া (দেশ) -সেন্ট জর্জ

* কিরিবাতি টমাস গিলবার্ট -(“কিরিবাতি” হল “গিলবার্টস” এর গিলবার্টিজ প্রতিদান)

* মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ -জন মার্শাল

* মরিশাস -নাসাউর মরিস, কমলার রাজকুমার

* মোজাম্বিক -মুসা বিন বিক

*নিকারাগুয়া- নিকারাও

* পেরু বিরু,- একজন স্থানীয় শাসক যিনি 16 শতকের গোড়ার দিকে পানামা সিটির সান মিগুয়েল উপসাগরের কাছে বাস করতেন।

* ফিলিপাইন স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ

* সেন্ট কিটস এবং নেভিস সেন্ট ক্রিস্টোফার

*সেন্ট লুসিয়া -সেন্ট লুসি

*সেন্ট ভিনসেন্ট এবং গ্রেনাডাইনস সারাগোসার- সেন্ট ভিনসেন্ট

*সান মারিনো- সেন্ট মারিনাস

* সাও টোমে এবং প্রিন্সিপ সেন্ট থমাস , এবং পর্তুগালের যুবরাজ যাকে দ্বীপের চিনির ফসলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল

*সৌদি আরব – সৌদ বিন মুহাম্মদ

*সেশেলস জিন -মোরেউ ডি সেচেলস

* মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- আমেরিগো ভেসপুচি ( আমেরিকার নামকরণ দেখুন )

*উজবেকিস্তান  -ওজ বেগ খান

* ভেনেজুয়েলা (বলিভারিয়ান প্রজাতন্ত্র) -সিমন বলিভার (“বলিভারিয়ান রিপাবলিক” অংশের জন্য), ভেনেজুয়েলা নামটি ভেনিস থেকে এসেছে ।

আচ্ছা কেউ কোনো দাবী তুললেই কি – সবকিছু পরিবর্তন করা যায়? যায়না। কারণ এর সাথে আমাদের চেতনার সম্পর্ক।ভালোবাসার সম্পর্ক।

কিভাবে চেতনার সম্পর্ক সে ইতিহাস জানতে চান?

তাহলে পড়তে থাকুন-

আমার সোনার বাংলা’ গানটি  ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী রাজনীতিক, স্বদেশী কর্মী ও বিপ্লবীরা বাঙালি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যম হিসেবে এই গান প্রচার করেন।

১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চিরসবুজ সিনেমা ‘জীবন থেকে নেওয়া’-তে এই গান ব্যবহৃত হয়। এটি কোনো সিনেমায় এই গানের প্রথম ব্যবহার। জহির রায়হান নির্মিত এই সিনেমায় তৎকালীন বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন বাস্তবতায় এই গানটি নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রতিভাত হয়েছিল সব যোদ্ধার প্রাণে প্রাণে। সাহসী ও অনুপ্রাণিত করেছিল যুদ্ধের ময়দানে অংশগ্রহণকারী, আত্মদানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের। শক্তি, চেতনা ও অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে লোকজ বাঊল সুরের এই গানটি বাংলার সব বর্তমানে সমসাময়িক হয়ে একই রকম আবেদন নিয়ে প্রাণ সঞ্চার করেছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অতীত প্রেক্ষাপটে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে গানটির পুনরুজ্জীবন ঘটে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আয়োজিত এক জনসভায় গানটি গাওয়া হয়।

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের আগেও গানটি গাওয়া হয়েছিল। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্যারেডেও গানটি গাওয়া হয়।

মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এই গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটির বর্তমানে প্রচলিত যন্ত্রসুর করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন হলে এর ৪.১ অনুচ্ছেদে ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম ১০ চরণ (মোট চরণ ২৫ চরণ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।

গানের প্রথম ১০ ছত্র কণ্ঠসংগীত এবং প্রথম ৪ ছত্র যন্ত্রসংগীত ও সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয়।

প্রথমেই বলেছি মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী সংবিধানের পাশাপাশি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানান। এরপরই এই প্রসঙ্গটি জোরালো হয়ে উঠে।

সম্প্রতি -জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি। এতে স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।’

আমান আযমী বলেন, ‘১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই?

তিনি আরও বলেন, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশে থাকতে চাই। এই জাতীয় সংগীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা হোক।’

আমান আযমীর এই মন্তব্য, দাবি ও মন্তব্য বিক্ষুব্ধ করেছে দেশবাসীকে। অনেকেই প্রতিবাদী হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। টাইমলাইন-টাইমলাইনে শোভা পাচ্ছে জাতীয় সংগীতের লাইনগুলো, জাতীয় সংগীতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদের ফটোকার্ডে সয়লাব সামাজিক মাধ্যম।

তার ব্যাখ্যা সঠিক নয়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সারর্বভৌম রাষ্ট্র। সুতারাং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।প্রয়োজনে

পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের অঙ্গীভূত হতে পারে।যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ সার্বভৌম কোনো রাষ্ট্র নয়।

এই গানটি ছিল মূলত:জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার। শুধু যে, এবারই প্রথম দাবী ওঠেছে তা নয়।

ইতোপূর্বেও অনেকবার রাজনৈতিকভাবেই প্রস্তাব আনা হয়েছিল জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা জোর গলায় বলছেন, জাতীয় সংগীত প্রথম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকার।

৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্রপতির আসনে বসানো হয় খন্দকার মোশতাক আহমেদকে। ক্ষমতায় বসেই মোশতাক জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে ওই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। কমিটিকে বলা হয় এক মাসের মধ্যে নতুন কোনো সংগীতকে ‘জাতীয় সংগীত’ হিসেবে প্রস্তাব করতে।

রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঐতিহাসিকরা বলছেন, দ্বীন মুহাম্মদ কমিটি এ বিষয়ে তিনটি বৈঠক করে। সে কমিটি দুটো গানের একটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেয়। গান দুটো হলো, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতা। কিন্তু ক্যু পাল্টা ক্যুতে ওই প্রস্তাবের হালে আর পানি পড়েনি।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দ্বিতীয় উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিলে। সে সময় ‘আমার সোনার বাংলা’ কে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করা হয়।

সে সময় ক্ষমতায় ছিলেন জিয়াউর রহমান। ওই সময়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে লেখেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমার সোনার বাংলা গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থি বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’

ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ কে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করেন শাহ আজিজুর রহমান।

প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনাও জারি করে।

এসময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের নিহত হলে সেই উদ্যোগ থেমে যায়। পাথরে চাপা পড়ে সেই নিদের্শনা।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে।

২০০২ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেন।

স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই অনুরোধপত্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হক বিষয়টি অতি গুরত্বপূর্ণ বলে সচিবের কাছে প্রেরণ করেন।

সচিব জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় বলে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করে। একই বছরের ১৯ আগস্ট প্রস্তাবটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

কিন্তু সেই সরকারের আমলেই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। এরপর এ সম্পর্কে আর কোনো তৎপরতা নথিতে পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গে, সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে সংবাদকর্মী মোহসীন কবীর বলেন, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহংকার- এই গানটি আমার কাছে জাতীয় সংগীত হিসেবে সর্বোত্তম মনে হয়। এর কথাগুলো যেন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক। গানটি লিখেছেনও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি যুদ্ধের ময়দানে বসেই এটি রচনা করেছেন। এর গীতিকার জাতীয় এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু। গানটি গেয়েছেন বাংলাদেশের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি কোকিলকণ্ঠী গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন। গানটিতে বাংলাদেশ নামটিও রয়েছে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার লেখা গানইতো হওয়া উচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। আর হ্যাঁ, সংবিধান পরিবর্তন কিংবা পরিমার্জন করা গেলে জাতীয় সঙ্গীতও পরিবর্তন করা যায়। দেশের প্রয়োজনে সবই করা যায়।’

কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ কফিল আহমেদের বরাতে আন্তর্জাতিক মানের ফটোসাংবাদিক অ্যান্ড্রু বিরাজ বর্তমান জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসির পক্ষ নিয়ে বলেন, খেয়াল করেছো কি না– পৃথিবীতে বেশিরভাগ দেশের জাতীয় সংগীতের মেজাজ কিন্তু সামরিক, আধাসামরিক এবং গির্জা প্রভাবিত! তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।

আর গানের সুরে রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় গির্জাতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের বাউল সুরকে ধারন করা  হয়েছে।

বাংলার বাউলসুরের এই জাতীয় সংগীতটিকে উপলব্ধি করতে পারলে কিন্তু এদেশের আকাশ-বাতাস এতোটা বিষময় হতো না, বদনখানি এতোটা বদ, এতোটা মলিন হতো না।’

জাতীয় সংগীত প্রতিটি দেশের জাতীয় পরিচয় ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এটি সেই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং মূল্যবোধকেও তুলে ধরে বিশ্বের সামনে। তবে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন এনেছে। এমন পরিবর্তনগুলো সাধারণত জাতীয় উন্নতি, লিঙ্গ সমতা, বা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য করা হয়।

তাছাড়া জাতীয় সংগীত অপরিবর্তনীয় বলে কোনো আইন নেই। বিভিন্ন দেশে জাতীয় সংগীত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হওয়ার উদাহরণও রয়েছে।

প্রসঙ্গত, জাতীয় সংগীত অপরিবর্তনীয় বলে কোনো আইন নেই। বিভিন্ন দেশে জাতীয় সংগীত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হওয়ার উদাহরণও রয়েছে।

আসুন জেনে নেয়া যাক বিশ্বের কিছু দেশ সম্পর্কে, যারা বিভিন্ন কারণে তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন এনেছে।

সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনের বরাতে এবার একনজরে দেখে নেয়া যাক এসব সব দেশগুলো কোন প্রেক্ষিতে এবং কীভাবে তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন এনেছে।

অস্ট্রেলিয়া:

অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীতে সাম্প্রতিককালে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অস্ট্রেলিয়ায় জাতীয় সংগীতের ‘ইয়াং অ্যান্ড ফ্রি’ শব্দগুচ্ছটি পরিবর্তন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ঘোষণা দেন, আদিবাসীদের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সম্মান জানাতে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন জাতীয় সংগীতটি দেশের বহুজাতিক এবং আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করে।

জার্মানি:

জার্মানিতে লিঙ্গ সমতা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে চলেছে, যার একটি প্রতিফলন দেখা যায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাবে। জার্মানির সমতা বিষয়ক কমিশনার ক্রিস্টিন রোজে-ম্যোরিং প্রস্তাব করেন যে, ‘ফাটারল্যান্ড’ (পিতৃভূমি) শব্দটি পরিবর্তন করে ‘হাইমাট’ (জন্মভূমি) শব্দটি ব্যবহার করা হোক, যাতে জাতীয় সংগীতে লিঙ্গ সমতা প্রতিফলিত হয়। যদিও এই প্রস্তাবটি বিতর্কিত ছিল এবং চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলসহ অনেকে এর বিরোধিতা করেন, তবু এটি জার্মানির সামাজিক উন্নতির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে ধরা যায়।

অস্ট্রিয়া:

অস্ট্রিয়ায় ২০১২ সালে জাতীয় সংগীতে লিঙ্গ সমতা আনতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। ‘ছেলেরা’র জায়গায় ‘মেয়েরা এবং ছেলেরা’ শব্দটি সংযোজন করা হয়। এটি দেশের ঐতিহ্যগত চিন্তাধারার পরিবর্তন এবং নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়।

কানাডা:

কানাডাও লিঙ্গ নিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করেছে। সংগীতের দ্বিতীয় লাইনে ‘তোমার সব ছেলেরা’র পরিবর্তে ‘আমরা সবাই’ শব্দগুচ্ছটি সংযোজন করা হয়। এই পরিবর্তনটি দেশটির সাম্প্রতিক লিঙ্গ সমতা প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।

নেপাল:

নেপালের ইতিহাসে ২০০৮ সাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর, কারণ এই বছরে দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়। এর প্রেক্ষিতে, ২০০৭ সালে নেপাল তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন আনে। পূর্বের জাতীয় সংগীতটি রাজতন্ত্রের প্রশংসায় পূর্ণ ছিল, যা নতুন গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল। নতুন জাতীয় সংগীতটি দেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে।

আফগানিস্তান:

আফগানিস্তানের জাতীয় সংগীতে একাধিকবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। তালেবান শাসনামলে দেশটিতে কোনো জাতীয় সংগীতই ছিল না। পরে ২০০২ সালে পুরনো জাতীয় সংগীত ফিরিয়ে আনা হয়, যা ১৯৭৮ সালে গৃহীত হয়েছিল। এরপর ২০০৬ সালে, তৎকালীন কারজাই সরকার জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন এনে একটি নতুন সংগীত গ্রহণ করে, যা নতুন আফগানিস্তানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

রুয়ান্ডা:

রুয়ান্ডা ১৯৯৪ সালে ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয়। গণহত্যার পরবর্তী সময়ে দেশটির ভাবমূর্তি গড়ে তোলার প্রয়াসে ২০০১ সালে একটি নতুন জাতীয় সংগীত বেছে নেয়া হয়। এই নতুন সংগীতটি দেশের ঐতিহ্য এবং নতুন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকা:

দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৭ সালে তাদের জাতীয় সংগীতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। আগের দুটি জাতীয় সংগীতের কিছু অংশ নিয়ে একটি নতুন জাতীয় সংগীত রচনা করা হয়, যা আফ্রিকান এবং ইংরেজি ভাষায় লেখা। এই নতুন সংগীতটি বর্ণবাদ-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকার রিকনসিলিয়েটরি মনোভাবের প্রতীক।

রাশিয়া:

রাশিয়ার জাতীয় সংগীতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে ২০০০ সালে, যখন ভ্লাদিমির পুটিন রুশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ১৯৯০ সালের আগে ব্যবহৃত জাতীয় সংগীত ফিরিয়ে আনেন, তবে গানের কথায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তনটি ছিল দেশের পুরোনো ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা।

জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন একটি দেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই পরিবর্তনগুলো শুধু সংগীতের কথা বা সুরে নয়, বরং দেশের মানুষের মনোভাব, আকাঙ্ক্ষা ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটায়। জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন শুধু সুর বা শব্দের পরিবর্তন নয়, এটি একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতিফলন। জাতির পরিবর্তিত মূল্যবোধ এবং নতুন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।

কিন্তু আমাদের জাতীয় সংগীত এর যে আবেদন,যে সৌন্দর্য, বিশ্ব দরবারে যে অবস্থান তাতে জাতীয় সংগীত এর পরিবর্তন করা মানে আমাদের চেতনাকে অনুভূতিহীন করে  দেয়া।তাছাড়া আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা একজন বিশ্ববরেন্য নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক।মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নিশ্চই বুঝবেন একজন নোবেল বিজয়ীর সন্মান কতোটা গগনচুম্বি।

পরিশেষে বলবো-

যেকোনো দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচয়বাহক জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত যতটা না ধর্মের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক সংস্কৃতির সঙ্গে। কেননা, একটি দেশের জাতিসত্তার সঙ্গে তার সংস্কৃতি যত বেশি সম্পৃক্ত, পৃথকভাবে ধর্মীয় অনুভূতির সম্পৃক্ততা এত বেশি পরিলক্ষিত হয় না। এর অন্তর্নিহিত বড় একটি কারণ হলো, একটি দেশের সংস্কৃতি একাধিক ধর্মকে আশ্রয় দিতে পারে। সব ধর্মই সংস্কৃতিতে আশ্রিত হয়ে একটি দেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ফলে একটি দেশে একাধিক ধর্মের মানুষ একই রকম অধিকার নিয়ে, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে, নাগরিকত্ব নিয়ে স্বচ্ছন্দে বাস করতে পারে।

আপনাদের নিশ্চই মনে আছে-বাংলাদেশের ৪৩তম স্বাধীনতাবার্ষিকীতে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রায় তিন লাখ মানুষের সমবেত হয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, এতে দেশবাসীর আবেগময় অনুভূতিরও প্রকাশ ঘটেছে।

ছাত্র-তরুণ-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাবেশস্থলটি হয়ে উঠেছিল নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতীক। সবার হাতে ছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আর মুখে সেই জাতীয় সংগীতের অমর সুরলহরি।

সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার এই ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থানকে আরও অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছে।

এর মাধ্যমে লাখো প্রাণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের প্রতি দেশবাসীর গভীর আবেগ ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে। মূর্ত হয়ে উঠেছে আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি তথা জাতীয় সংগীতের প্রতি আমাদের গাঢ় শ্রদ্ধাবোধ।

কেবল জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডেই নয়, দেশের সর্বত্র, যে যেখানে ছিলেন, সেখান থেকেই জাতীয় সংগীত গেয়ে তাঁরা নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান যে সংগীত, তার প্রমাণ আমরা পাই ইতিহাসের পরতে পরতে।

সেদিন কথা ছিল আনুষ্ঠানিকতার বৃত্ত থেকে বের হয়ে এই কালজয়ী সংগীতের মর্মবাণীকে ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে।

এই গানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করে তার অঘ্রানের ভরা খেত দেখে যেমন মুখে হাসি ফোটানোর কথা বলেছেন, তেমনি তার বদনখানি মলিন হলে নয়ন জলে ভাসার বেদনাও প্রকাশ করেছেন।

জাতীয় সংগীতের মর্মবাণী হৃদয়ে ধারণ করে মা-রূপ দেশের মুখে যেন সর্বদা হাসি ফুটে থাকে, যেন কখনো তার মুখ মলিন না হয়, সেই কথাগুলোই বলা হয়েছে।   লেখক – কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক