১০ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ || ২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং ১৯৭২-এর সংবিধান শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সংবিধান প্রণেতা তাঁর অন্যান্য সহযোগী এবং ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন, ‘আজ আমাদের অত্যন্ত আনন্দের দিন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হয়েছে। যে দিবসটি দীর্ঘ ষোল বছর আমরা একা উদযাপন করতাম সেই ৪ নভেম্বর আজ সরকারিভাবে পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ৫০ বছর আগে এই দিনটিতে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান গণপরিষদে উপস্থাপনের সময় বলেছিলেন, ‘আজকে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন, সে আনন্দ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এই শাসনতন্ত্রের জন্য কত সংগ্রাম হয়েছে এই দেশে। আজকে আমার দল যে ওয়াদা করেছিল তার এক অংশ পালন করলো কিন্তু জনতার শাসনতন্ত্রের কোনো কিছু লেখা হয় না। তারা এটা গ্রহণ না করলে প্রবর্তন করা হবে না, ব্যবহার না করলে হবে না। ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক, শহীদের রক্তদান সার্থক’। বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন- এই সংবিধান শহীদের রক্তে লেখা হয়েছে।’

বক্তারা আরো বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের দর্পণ বাংলাদেশের আদি সংবিধানের মর্যাদা আমরা রাখিনি। সামরিক বাহিনীর দুই পাকিস্তানপ্রেমী জেনারেল ৩০ লাখ শহীদের রক্তে লেখা সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস মুছে ফেলে এর পাকিস্তানিকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ করেছিলেন, যে ক্ষত আজও আমরা নিরাময় করতে পারিনি। ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারকে অভিবাদন জানিয়ে আমরা বলতেই চাই- এখন সময় হয়েছে দুই পাকিস্তানপ্রেমী জেনারেলের দ্বারা কৃত বঙ্গবন্ধুর সংবিধানকে সাম্প্রদায়িকরণের কদর্যতা থেকে মুক্ত করা। সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে বঙ্গবন্ধু ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নির্বিঘ্ন ও অব্যাহত রাখার জন্য, ৩০ লাখ শহীদ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৩ নভেম্বরের শহীদদের আত্মদান চিরস্মরণীয় রাখার জন্য সরকারকে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ধর্মের নামে রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর সংবিধানে থাকতে পারে না।’

আজ শুক্রবার (৪ নভেম্বর) একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, চট্টগ্রাম জেলা আয়োজিত চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

সংগঠনের ৮ম জাতীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব, মহামান্য রাষ্ট্রপতি মরহুম মো. জিল্লুর রহমানের সাবেক পলিটিক্যাল এপিএস লেখক-সাংবাদিক শওকত বাঙালির সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। প্রধান আলোচক ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান। প্রধান বক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মফিজুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, যুদ্ধাপরাধী সাকার বিরুদ্ধে সাক্ষী-মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সন্তান দেবব্রত সরকার দেবু, বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী, প্রফেসর ড. আলাউদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা হাসান মনসুর, যুবলীগ নেতা হেলাল উদ্দিন যুব, আসাদুজ্জামান খান।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, চট্টগ্রাম জেলা আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলাম

জেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব মো. অলিদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন- ৮ম জাতীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য শ্রমিকনেত্রী রুকসানা পারভিন, সাবেক ছাত্রনেতা মিথুন মল্লিক, জেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য অধ্যাপক গোফরান উদ্দিন টিটু, হাবিবউল্যাহ চৌধুরী ভাস্কর, এ.কে.এম জাবেদুল আলম সুমন, আবু সাদাত মো. সায়েম, রাজীব চৌধুরী রাজু, সুচিত্রা চৌধুরী টুম্পা, হাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম, অ্যাডভোকেট মো. জয়নাল আবেদীন, অ্যাডভোকেট মো. সাহাব উদ্দিন, অসিত বরণ বিশ্বাস, মো. সাজ্জাদ উদ্দিন, আজমীরুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসেন তালুকদার, সাজ্জাদ বিন সাফা রিফাত, মো. শহিদুল ইসলাম, হেলাল উদ্দীন খোকন, এম হামিদ হোছাইন, অ্যাডভোকেট তশরিফুল ইসলাম, কাজী মো. গোলাম সরওয়ার, মো. এমরুল ইসলাম, মো. জাহেদুল আলম চৌধুরী, মো. মোকাররম হোসেন, মো. তাপসির চৌধুরী, আকতার হোসেন, মোহাম্মদ জাবেদ জাহাঙ্গীর টুটুল, খালেদ মারুফ, রাহুল দাশ, মো. নিজাম উদ্দিন,  মুহাম্মদ রিয়াদ, সজীব ইসলাম, মো. সোহেল, মাসুদ, মো. দেলোয়ার হোসেন, মো. জামশেদুল ইসলাম চৌধুরী, প্রণয় সিংহ, পংকজ বিশ্বাস, কানিজ ফাতেমা লিমা, মুক্তা হাওলাদার, নাছিমা আকতার, রুজি আকতার, রাবেয়া খানম, রিনা, জয়া সিংহ, রোকসানা আক্তার দিতি, শারমিন আকতার, রিয়া, সাজ্জাদ হোসেন, রাশেদুল করিম রাজু প্রমুখ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জননেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনের পরও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’-এর জায়গাটি পরিবর্তন হয়নি।’

‘বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ২৩ বছরের লড়াই সংগ্রামের পর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করেন সেখানে তিনি তাঁর সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সন্নিবেশিত করেন। কারণ ভণ্ড শাসকরা বিভিন্ন সময় ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বার বার আঘাত করেছে। তাই বঙ্গবন্ধু ধর্মকে সংবিধান থেকে দূরে রেখেছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীন বাংলাদেশের অধিকাংশ সময়ই স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদীরা সাম্প্রদায়িক শক্তির মাধ্যমে দেশ শাসন করেছে। যার কারণে মৌলবাদীরা নিজেদের ইচ্ছেমত সংবিধানের পরিবর্তন করেছে। তারা দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার ফলে তাদের শেকড় সমাজের গভীর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।’

ডা. মাহফুজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যে ৩০ ভাগ মানুষ বাংলাদেশের বিরোধীতা করেছিল, সে সংখ্যা নিশ্চয় এখন কমে যায়নি। স্বাধীনতাবিরোধীরা সবসময় বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক সংবিধানকে অপদস্ত করার চেষ্টারত। সংবিধান সম্পর্কে আমাদের মনোজগত, চেতনা ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডেও পরিবর্তন আনতে হবে।’

নির্মূল কমিটির দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ৪ নভেম্বরকে সংবিধান দিবস হিসেবে ঘোষণা করায় জননেতা মফিজুর রহমান সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি দীর্ঘদিন ধরে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে অবিচল থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষে আমরা যেন ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে পারি- সেই প্রত্যাশাই রাখি।’

প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর তৈরি করা সংবিধানকে সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্ক থেকে যে কোনোভাবে মুক্ত করতে হবে। বঙ্গবন্ধু মনে করতেন, ধর্ম কখনো সমাজ-সংস্কৃতি, জাতীয়তা থেকে বড় হতে পারে না। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু সংবিধানে ধর্মকে গৌণ করে জাতীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক সংবিধান রচনা করেছিলেন।’

সভাপতির বক্তব্যে শওকত বাঙালি পাঠ্যপুস্তকে সংবিধানের পাঠ অন্তর্ভুক্ত করে নিয়মিত চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি বিনীত অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ’৭২-এর সংবিধান আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়, আমার সবচেয়ে বড় রক্ষক।

তিনি বলেন, ‘অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া ও ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দেয়া হয় না বরং বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার সকল চর্চা করে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তদারকি করার কেউ নেই। সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের সমাজকে প্রভাবিত করছে। সমাজের স্তরে স্তরে ধর্মান্ধতা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী অপশক্তি আমাদের সমাজে এমন প্রভাব বিস্তার করেছে যে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে চায় না। ভয় পায়। কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেন না যে আমার স্কুলে, কলেজে, প্রতিষ্ঠানে রাজাকার-আলবদর ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বংশধরদের পড়তে দিব না; চাকরী দিব না। সমাজ ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হলে সকল সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে হবে।’