১৮ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ || ৩রা অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

মোহাম্মদ ইউসুফ *

গরীব রোগীরা যাতে বিনাচিকিৎসায় মারা না যায়,স্বল্পমূল্যে পায় চিকিৎসাসেবা- সেই মহৎ উদ্দেশে চট্টগ্রাম শহরে খুলশি’র জাকির হোসেন রোডে সরকারি জায়গায় স্থাপিত হয় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল। কিন্তু বাস্তবে উদ্দেশ্য ও নীতি-আদর্শের বিপরীতে হাঁটছে হাসপাতালটি। বিগত একদশক ধরে এটি বাণিজ্যিক হাসপাতাল হিসেবে চলছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমনই যে, ডায়াবেটিক হাসপাতালটি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত; অবস্থা সঙ্গীন,ইন্সুলিন নিতে হচ্ছে। রোগীসেবার নামে বিভিন্ন তরফ থেকে কোটি কোটি টাকা আসলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না ডায়াবেটিস-রোগীরা। এখানে আইসিইউ/সিসিইউ/এইচডিইউ বিভাগ আছে কিন্তু কোনো  বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। এ হাসপাতালের পরিচালক চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি হলেও চিকিৎসালয়টির মা-বাপ মূলত একজনই।সমিতি থাকলেও তা কাগজে কলমে,পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যক্তিবিশেষের হাতে কুক্ষিগত;বাকিরা সব তারই আজ্ঞাবাহী ইয়েসম্যান। প্রতিষ্ঠার পর কিছুদিন ঠিকঠাক চললেও কালক্রমে প্রতিষ্ঠানটির সবকিছু সেই একজনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। হাসপাতালটির স্বঘোষিত মা-বাপ, হর্তাকর্তা-বিধাতা ও দুর্নীতির বরপুত্র হলেন, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির বিতর্কিত সভাপতি প্রফেসর জাহাঙ্গীর চৌধুরী।তার লাগামহীন দুর্নীতির ডালপালা এতই বিস্তার লাভ করেছে যে,পরিণতিতে তা সমাজসেবা অধিদপ্তর, দুর্নীতি দমন অফিস ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পর্যন্ত গড়িয়েছে। সরকারি-বেসরকারি দান-অনুদান ও যাকাত-ফিতরার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ,স্বজনদের হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ ও  বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এখানে ওপেন-সিক্রেট। বলা যায়,দুর্নীতির মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল।

জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ পাওয়ার পর গত ২১জুলাই ২০২২ সমাজসেবা অধিদপ্তর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- সমাজসেবা অফিসার মো. আশরাফ উদ্দিন ও মো. সোহানুর মোস্তফা শাহরিয়ার। কমিটি গঠনের দুমাস পর ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ তদন্তকাজ শুরু করে ইতোমধ্যে তা শেষ করা করেছে।তদন্ত প্রতিবেদনগত  ১ডিসেম্বর ২০২২ সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক  কাজী নাজিমুল ইসলাম বরাবরে জমা দেয়া হয়েছে। এছাড়া জাহাঙ্গীর চৌধুরীর অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে  চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক সাখাওয়াত উল্লাহ বরাবরে  চলতি বছরের আগস্ট  মাসে  ভুক্তভোগিরা অভিযোগ করলে তিনি চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীকে আহবায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।তবে ব্যস্ততার অজুহাতে এখনও তদন্ত শুরু হয়নি। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে অতীতে দফায় দফায় অর্থ কেলেঙ্কারির বিষয়টি প্রকাশ্যে ওঠে আসায় মানববন্ধন থেকে শুরু করে একাধিকবার তদন্ত হয়। কিন্তু বরাবরের মতো তিনি নানা ফন্দিফিকির অবলম্বন করে আইনের ফাঁকফোকর দিয়েবেরিয়ে আসেন।

কয়েক সপ্তাহ ধরে চাটগাঁর বাণী অনুসন্ধান চালিয়ে এবং সমাজসেবা ও দুর্নীতি দমন বিভাগে দেয়া অভিয়োগপত্রে থেকে জানা যায়, জাহাঙ্গীর চৌধুরী ২০০১ সালে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব জাহাঙ্গীর উদ্দিনকে বিনা কারণে অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে হটিয়ে ওই পদে আসীন হন। সেই তখন থেকেই এখন পর্যন্ত প্রভাব খাটিয়ে গঠনতন্ত্রকে নিজের সুবিধামতো সংশোধনী এনে সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে সভাপতিপদে বহাল আছেন।ডায়াবেটিক হাসপাতালে প্রতিদিন ৯/১০ লাখ টাকা আয় হলেও হাসপাতালের নামে কোনো আয়-ব্যয়ের রেজিস্ট্রার বই নেই। আয়-ব্যয়ে নেই কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। গঠনতন্ত্রের ১২ (ঘ) ধারা মোতাবেক ব্যাংক হিসাব- যা সমিতির নামে কোষাধ্যক্ষ সমিতির যাবতীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ করার কথা।১৭ (গ) ধারা অনুযায়ী ব্যাংক হিসাব- যা সমিতির নামে কোষাধ্যক্ষ নিজে এবং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে যে-কোনো একজনসহ দুজনের যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হওয়ার নিয়ম থাকলেও তা অনুসরণ করা হয় না। এখানে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ এর সব দায়িত্ব পালন করেন সভাপতি নিজেই। মূলত সভাপতি-ই হাসপাতালের সর্বেসর্বা। কোষাধ্যক্ষের বাসায় গিয়ে ‘ব্ল্যাংক চেক’-এ স্বাক্ষর নিয়ে আসেন জনসংযোগ কর্মকর্তা শিবু প্রসাদ চৌধুরী।

অভিযোগপত্র থেকে আরও জানা যায়, গত ২৮জুন ২০২১ জনতা ব্যাংক লিমিটেড ও ইউসিবিএল, খাতুনগঞ্জ শাখা কর্তৃক দায়েরকৃত অর্থঋণ মামলায় চট্টগ্রামের চকবাজার থানা পুলিশ জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে গ্রেফতার করে। থানা থেকে নিজেকে ছাড়ানোর কথা বলে একইদিনে হাসপাতালের হিসাব থেকে ৩৯লাখ টাকা উত্তোলন করে নেয়- যা এখনও পরিশোধ করেননি।গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষের যৌথ স্বাক্ষরে চেক পাশ হওয়ার কথা থাকলেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে। যেখানে সাধারণ সম্পাদক ইহজগতে নেই, সভাপতি জেলে থাকাকালীন সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষের স্বাক্ষরে কীভাবে চেক পাশ হয়ে যায়- এমন প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই।

এদিকে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড,আন্দরকিল্লা শাখায় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের নামে হিসাব খুলে জাহাঙ্গীর চৌধুরী নিজেই পরিচালনা করেন- যা সংগঠনের গঠনতন্ত্রীপরিপন্থী ও বেআইনী। এ  হিসেবে নামে-বেনামে হাসপাতালের অনুকূলে যত টাকা আসে, সব টাকা তিনি উত্তোলন করে নেন। ২০১৫ সালে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারের জন্যে হাসপাতাল হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করে তা আর পরিশোধ করেননি। ২০১৮ সাল থেকে সরকার চট্টগ্রাম জেনারেল ডায়বেটিক হাসপাতালের জন্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যে টাকা অনুদান হিসেবে পাঠায়, তা-ও জাহাঙ্গীর চৌধুরী আত্মসাৎ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার থেকে আবারও ৫০লাখ টাকার চেক এসেছে (স্মারক নম্বর- ৪৫.০০.০০০০.১৬২.৯৯.০০৭.২১.৭৫ চডাস/২০২২/১১৮ তারিখঃ ০২.০৩.২০২২ খ্রিস্টাব্দ)। বিভিন্ন পরামর্শকদের নামে ঋণ দেখিয়ে তিনি হিসাব মিলিয়ে রাখেন। অথচ যাদের নামে ঋণ দেখানো হয়, সেসব চিকিৎসক নিজেরা-ই জানেন না- তারা ঋণ নিয়েছেন। চিকিৎসকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করেন পিআরও শিবু প্রসাদ চৌধুরী। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর। তিনি এ বি ব্যাংক লিমিটেড এর খুলশী শাখায় কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা বেআইনিভাবে উত্তোলন করে কমার্স ব্যাংক থেকে নেয়া তার ব্যক্তিগত ঋণ পরিশোধে ব্যয় করেন- যা এখনো পরিশোধ করেননি। ২০১৯-২০ রোটারিবর্ষে রোটারি ক্লাব অব চিটাগং ইস্ট থেকে জাহাঙ্গীর চৌধুরী রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮২ এর গভর্নর পদে নির্বাচন করার সময় হাসপাতাল ফান্ড থেকে অবৈধভাবে প্রায় ২কোটি.৫০লাখ টাকা ব্যয় করেন- যা এখনও ফেরত দেননি। অন্যদিকে তিনি বায়ো-ট্রেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে অবৈধ লেনদেনে লিপ্ত হয়ে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের টাকা লোপাট করে চলেছেন। হাসপাতালের টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ইটিটি মেশিন কেনার নামে হাসপাতাল তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উত্তোলন করা হলেও মেশিন কেনা হয়নি; চালু করা হয়নি ইটিটি বিভাগ।  কমিটির সভাপতি  জাহাঙ্গীর চৌধুরী এলইডি টিভি ও ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা-সফটওয়্যার বাণিজ্যও করছেন।শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম আইন কলেজের অধ্যক্ষ পদ পাকাপোক্ত করতে তিনি হাসপাতাল তহবিলের টাকায় আইন কলেজের শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্যে ট্রাস্ট সীট করে দেন।তিনি বহু বছর থেকে ব্যক্তিগত গাড়ির চালক আজিজ, বাসাবাড়ির কাজের ছেলে মিজান ও রকির বেতন হাসপাতাল তহবিল থেকে পরিশোধ করে আসছেন।চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের বন্দরটিলা শাখা স্থানান্তরের অজুহাত দেখিয়ে  সহ-সভাপতি  এস এম শওকত  হোসেন ও প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমান উল্লাহ আমানের সহযোগিতায় ২০লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে সভাপতির বিরুদ্ধে। হাসপাতালটিতে কেনাকাটা থেকে শুরু করে আর্থিক লেনদেনসংক্রান্তকোনো কাজে দরপত্র কিংবা আইনকানুন পালন করা হয় না। হাসপাতালের একটি ৬তলা ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সহ-সভাপতি এস এম শওকত হোসেনকে এ নির্মাণ প্রকল্পের প্রধান করে বহুতল ভবন তৈরির কাজ শুরু করা হয়। সিডিএ’র অনুমতি না নিয়ে  ৫তলার নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে ৬তলা ঢালাইয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি সিডিএ’র সংশ্লিষ্ট বিভাগ অবহিত হয়ে গত ১৯নভেম্বর ২০২২ নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছে।

হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স এর অপব্যবহার-

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালে এস এইচ আর শিপিং কোম্পানি ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক দানকৃত দুটি অ্যাম্বুলেন্স আছে। অ্যাম্বুলেন্স দুটি হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিরা ব্যবহার করেন। হাসপাতালের “মা-বাপ” জাহাঙ্গীর চৌধুরী, প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা  আমান উল্লাহ আমান ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শিবু প্রসাদ চৌধুরী মূলত হাসপাতালে আসা-যাওয়া ও ব্যক্তিগত কাজে অ্যাম্বুলেন্স দুটি  হরহামেশাই ব্যবহার করেন। এ তিনজনের বাসার সামনে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এ হাসপাতালে রোগীদের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারের তেমনএকটা রেকর্ড নেই।

স্বজনপ্রীতিঃ  বিগত ২০বছরে (২০০২-২০২০) জাহাঙ্গীর চৌধুরী অবৈধভাবে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে তার ৪৬জন আত্মীয়স্বজনকে হাসপাতালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেন। তার ভাতিজা প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমান উল্লাহ আমান, আত্মীয় অডিট অফিসার মো. ইয়াছিন, অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. আনোয়ার, মো. নাসিমুল গণি, মো. মোজাম্মেল, মো. রবিউল, আইটি অফিসার মো. নোমান, আপন ভাগনি সিনিয়র মেডিকেল অফিসার(গাইনী) ফারিয়া বিনতে আলী, সহ-সভাপতি শওকতের শ্যালিকা সনোলজিস্ট ডা. শেহরিন সামিহা ইসলাম (এনায়েত বাজার শাখায় কর্মরত), যুগ্ম সম্পাদক শাহনেওয়াজ এর মেয়ে ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. রিজওয়ানা, এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য শহীদুল্লাহ’র শ্যালক ইনডোর সুপারভাইজার মো. মাজহার ইসলামসহ আরও অনেকে।

পিয়ন থেকে প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর চৌধুরীর ভাতিজা আমান উল্লাহ আমান বর্তমানে হাসপাতালের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। পিয়ন থেকে ক্যাশিয়ার, অতঃপর জনসংযাগ কর্মকর্তা  ও প্রশাসনিক বিভাগের ক্লার্ক এবং অবশেষে বর্তমান পদে আসীন হন আমান। জাহাঙ্গীর চৌধুরীর পক্ষে  আমান তার বিশেষ “কামান ” ব্যবহার করে হাসপাতালের হিসাব-নিকাশ, স্টোর, প্রিন্টিং, কেনা-কাটা থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। স্টোরের সমস্ত মালামাল আমান তার মনোনীত দোকান ও কোম্পানি থেকে কেনেন। হাসপাতালে ব্যবহারের সকল যন্ত্রপাতি কেনা ও ল্যাবরেটরির বিভিন্ন মালামাল ও রিএজেন্ট কেনার দায়িত্বও আমানের। কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্য করে আমান জিরো থেকে এখন হিরো; কোটি কোটি টাকার মালিক । বিএস এন্টারপ্রাইজ ও গ্রাফিয়া নামে দুটি প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠান আছে তার।রোগীর হাজার হাজার গাইডবইসহ যাবতীয় প্রিন্টিংয়ের কাজ এখানে করা হয়। দুটি প্ল্যাট বাড়ি, ৮টি সিএনটি অটোরিক্সা, জমিজমা কিনেঅঢেল সম্পদের মালিক আমান।

ব্যক্তিস্বার্থে হাসপাতালের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন-

দীর্ঘ দেড়যুগ ধরে জাহাঙ্গীর চৌধুরী সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়ে এবং গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ-১৫ এর ধারা (কোরাম পূরণের জন্যে এক-তৃতীয়াংশ অথবা কমপক্ষে ৫১জন সদস্যের উপস্থিতি থাকা বাধ্যতামূলক) ভঙ্গ করে এ ধারার নিয়ম কোনোদিনও না-মেনে শুধুমাত্র নিজস্বার্থে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে আসছেন। গঠনতন্ত্রের যেসব ধারা বেআইনি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়-

১. কর্মচারিদের মধ্য থেকে আজীবন সদস্য হিসেবে যারা ভোটার তাদের ভোটাধিকার বিলুপ্ত করা হয়। কারণ-বেশিরভাগ কর্মচারি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর দুর্ব্যবহার, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে তাকে পছন্দ করতো না এবং নির্বাচনে ভোট দিতো না। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো- প্রতিবার এজিএম-এ কোরাম পূরণের লক্ষ্যে একই কর্মচারিদের জোরপূর্বক উপস্থিত থাকতে বলা হয় এবং যেসব কর্মচারি উপস্থিত থাকতো না, বিভিন্ন কলাকৌশলের মাধ্যমে তার আজ্ঞাবাহী কর্মচারি শিবু প্রসাদ চৌধুরীকে দিয়ে রেজিস্টার খাতায় স্বাক্ষর নেয়।

২. নির্বাহী কমিটিতে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠগুলোকে দমিয়ে রাখা ও বিরুদ্ধ প্যানেলকে দুর্বল করার জন্যে আবার গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করা হয়। এর মূল লক্ষ্য- নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন কেউ চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালে আর চাকরি করতে পারবে না। অথচ বর্তমানে তার নিজের-ই ৪৬জন আত্মীয়স্বজন হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে কর্মরত আছেন।

৩. ২০০২ থেকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর চৌধুরী সাধারণ সম্পাদকের পদে বহাল থেকে নিজের একক সিদ্ধান্তে সকল কাজ পরিচালনা করতেন। তৎকালীন সভাপতির মৃত্যুজনিত কারণে পদটি খালি হওয়ায় তিনি লোভের বশবর্তী হয়ে বেআইনি প্রক্রিয়ায় এ ‘শূন্য সভাপতি’ পদ দখল করে নেন। সভাপতির পদ দখল করে তিনি ক্ষান্ত হননি, সেই সাথে হাসপাতালের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে সকল ক্ষমতা সাধারণ সম্পাদকের ছিল, তা পরিবর্তন করে সভাপতির কাছে নিয়ে আসে- যা এখনও পর্যন্ত সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত হয়নি। ২০১৫ সাল থেকে অনুমোদনহীন কমিটি দিয়ে এ হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে।

৪. ২৯মার্চ ২০২২ খ্রিস্টাব্দে প্রহসনের এজিএম-এ (এ এজিএম-এ কোনো আজীবন সদস্যকে বার্তাপ্রেরণের প্রয়োজনবোধও করেনি) চতুর্থ পরিবর্তনের লক্ষ্যে অত্যন্ত হাস্যকর ও ন্যাক্কারজনকভাবে যুক্তি সাজালো যে, কোনোকালে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালে চাকরি করেছেন কিন্তু আজীবন সদস্য এবং তিনি যদি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন অথবা অবসরে যান তবে তিনি কখনো হাসপাতালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। অর্থাৎ তার ইচ্ছেমাফিক, জোরপূর্বক ও বেআইনিভাবে পরিবর্তনকৃত প্রথম ও চতুর্থ নিয়ম অনুসারে হাসপাতালে চাকরিচ্যুত কোনো ব্যক্তি ‘নির্বাহী নির্বাচনে’ ভোট দিতে পারবে না কিংবা অব্যাহতি নিলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তার এসব হাস্যকর নিয়মও সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুমোদন পায়নি। দেশে কোনো সামাজিক ও সেবামূলক সংগঠনের মেয়াদ ৪বছর আছে বলে মনে হয়না। কিন্তু জাহাঙ্গীর চৌধুরী নিজের স্বার্থে সেই কাজটি করেছেন। সংশোধিত গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ-১৩ এর ১(ক) –এ  কমিটির মেয়াদ ৪বছর করা হয়েছে- যা আগে ছিল তিনবছর।

জাহাঙ্গীর চৌধুরীর অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে যারা-ই উচ্চবাচ্য করেছেন তাদের চাকরি খোয়াতে হয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০২২ পর্যন্তযে ৪৩জন কর্মকর্তা-কর্মচারিকে জোরপূর্বক পদত্যাগে ও বেআইনিভাবে চাকরি থেকে অবসরে যেতে বাধ্য করেছেন তাঁরা হলেন- ১. ডা. মাসুদ আহমদ ২.  হাসপাতাল পরিচালক ডা. নওশাদ আহমেদ খান ৩.স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নার্গিস রোজেলা ৪. ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ ডা. আবসার ৫. ডা. ফাহাদ গণি ৬. বিশেষজ্ঞ ডা. মেহেদী ৭. বিশেষজ্ঞ ডা. মোমেন ৮.এনেস্থেসিয়া ডা. ইমরান ৯. ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ শিরিন ১০. ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ ডা. শাহেদ ১১. মো. নাজমুল (প্রশাসন) ১২. হাসপাতাল পরিচালক ডা. মজুমদার ১৩. প্রধান পুষ্টিবিদ ও উপপরিচালক হাসিনা আক্তার লিপি ১৪. নাসরিন ১৫. দন্ত বিশেষজ্ঞ ডা. উত্তম কুমার তালুকদার ১৬. পারভিন ১৭. ডা. টিটু বিশ্বাস ১৮. চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজামান মনসুন খান ১৯. চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রুমি ২০. অর্থোপেডিক্স ডা. হিমাদ্রী ২১. মেডিকেল বিভাগীয় প্রধান ডা. মাহবুবা আক্তার ২২. সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. ইসতেয়াক আজিজ খান ২৩. মেডিকেল অফিসার ডা. শারমিন আফরোজ ২৪. মেডিকেল অফিসার ডা. গুলশান আরা বেগম ২৫. মেডিকেল অফিসার ডা. হাসান আল মামুন ২৬. প্রশাসনিক প্রধান মো. মজনুন চৌধুরী ২৭. প্রশাসনিক অফিসার মো. বোরহান উদ্দিন ২৮. পার্সোনাল অফিসার আবদুল্লাহ মিয়া ২৯. প্রজেক্ট অফিসার আনিসুর রহমান ৩০. প্রধান বায়োকেমিস্ট অফিসার মো. কামরুল হাসান ৩১. নিরাপত্তা অফিসার মো. শাহাবুদ্দিন ৩২. সিনিয়র সমাজকল্যাণ অফিসার আঞ্জুমান আরা বেগম ৩৩. সিনিয়র সমাজকল্যাণ অফিসার জলি বড়ুয়া ৩৪. পুষ্টি অফিসার আয়েশা বেগম ৩৫. ফার্মেসী বিভাগ সহকারীশামীম আরা বেগম ৩৬. ফার্মেসী বিভাগ সহকারী শাহনাজ পারভিন ৩৭. দন্ত বিভাগ সহকারী জয়া ভট্টাচার্য ৩৮. ইলেকট্রিশিয়ান মো. মেহেদী হাসান ৩৯. সেনিটারি ও প্লাম্বার মো. শহিদুল্লাহ ৪০. অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার মো. রিপন মিয়া ৪১. অফিস সহকারী মো. বেলাল হোসেন ৪২. মালি মো. মাকসুদ উল্লা ও৪৩. মালি মো. ইব্রাহীম মিয়া। ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রাপ্ত গ্র্যাচুইটি/প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশে এদের বেআইনিভাবে জোরপূর্বক পদত্যাগ ও চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য করেন। এখন পর্যন্ত চাকরিচ্যুতদের কারো টাকা পরিশোধ করা হয়নি।প্রতিষ্ঠার পর থেকে হাতেগোণা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি ছাড়া চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের স্বাভাবিকভাবে অবসরে যাওয়া ও তাদের পিএফ ফান্ডের টাকা পাওয়ার কোনো রেকর্ড নেই। কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারি অবসরে যাওয়ার আগে তার বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ তৈরি করে এমন এক পরিস্থিতি করা হয় যে, ওই কর্মকর্তা-কর্মচারিকে হয় টারমিনেট নয়তো পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এ অমানবিক পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে যারা চাকরি হারিয়েছেন তারা কেউ পিএফ এর টাকা পায়নি। এ নিষ্ঠুর ও অমানবিক পন্থা অবলম্বন করে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে পিএফ ফান্ডের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। আগে পিএফ ফান্ড এর টাকা আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে জমা হতো, এখন জমা হয় না। কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কাছ থেকে যথারীতি পিএফ ফাণ্ডের বিপরীতে টাকা কেটে নিলেও তা কোথায় জমা হয়- তা কেউ জানেন না।মাসে ৩কোটি টাকার ওপরে আয় হলেও এফডিআর নেই এখানে।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হাসপাতালের জন্যে যেকোনো যন্ত্রপাতি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে পত্রিকার মাধ্যমে দরপত্র আহবানের নিয়ম থাকলেও জাহাঙ্গীর চৌধুরী একক সিদ্ধান্তে ক্রয়-বিক্রয় করে আসছেন এবং কেনা-বেচার বিল-ভাউচার তিনি কখনও স্টক রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করেননি। পরে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে দেয় চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার বেলাল উদ্দিন। সংগঠনের অনুচ্ছেদ-১৭ খ অনুযায়ী “সদস্য অন্তর্ভুক্তি ফি, এককালীন অনুদানসহ বিভিন্ন দান-অনুদান, সরকারি-বেসরকারি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সসংস্থার সাহায্য, সমিতির নির্দিষ্ট কোনো প্রজেক্ট থেকে অর্জিত অর্থ, সমিতির আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রম থেকে প্রাপ্ত অর্থ, সমিতির বিভিন্ন রোগীসেবা থেকে প্রাপ্ত অর্থ, সেবামূলক অন্যান্য বৈধ উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে সমিতির তহবিল গঠন করা হবে। তহবিলসহ সকল সম্পত্তি সমিতির নামে অর্জিত, স্বীকৃত ও পরিচালিত হবে। সকলপ্রকার অর্থ-আয় সমিতির নির্ধারিত রশিদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা যাবে এবং প্রাপ্ত আয় সমিতির নামে নির্ধারিত ব্যাংক হিসেবে জমা হবে। জাহাঙ্গীর চৌধুরী এসব নিয়ম-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে সমিতি উপার্জিত যাবতীয় আয়ের কোটি কোটি টাকা সমিতির নামে নির্ধারিত ব্যাংকে না রেখে নিজ করায়ত্বে রেখে যাচ্ছেতাইভাবে হরিলুট করে আসছেন। রোগীস্বার্থ পদদলিত করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা হচ্ছে, জাহাঙ্গীর চৌধুরী ঢাকা বারডেম হাসপাতাল ও অন্যান্য দাতাসংস্থা থেকে প্রাপ্ত জীবন রক্ষাকারী ইনসুলিন নিজের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ ও বিভিন্ন ফার্মেসীতে বিক্রি করে দেন- এমন অভিযোগ সকলের মুখে মুখে।Novo Nordisk কোম্পানি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ হাসপাতালের রোগীদেরHbA1cটেস্ট করতে প্রতিমাসে ৭/৮লাখ টাকাঅনুদান দিত। অনুদানের এ টাকা রোগীদের জন্যে ব্যয় না করে পুরোটাই আত্মসাৎ করার খবর পেযে এই কোম্পানি চলতি বছরের(২০২২) জুনমাস থেকে টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়।  হাসপাতালের ফার্মেসীতে ন্যায্যমূল্যের বদলে চড়াদামে ওষুধ বিক্রি হয় বলে রোগীদের অভিযোগ।চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল নামে দাতব্য হাসপাতাল হলেও প্রাইভেট হাসপাতালের মতো গলাকাটা রেটে এখান থেকে রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিতে হয়। গরীব ও অসহায় রোগীদের এখানে চিকিৎসা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ এ হাসপাতালের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে গরীব-দুঃখীদের সহযোগিতা করার কথা থাকলেও কোনোরকম সহযোগিতা না করে জাহাঙ্গীর চৌধুরী বছরে ৭৬-৮৪লাখ টাকা নিজস্বার্থে একক সিদ্ধান্তে পছন্দমতো লোকদের ডিসকাউন্ট সুবিধা দিয়ে থাকেন। রোগীসেবার জন্যে চড়ামুল্য নেয়া হলেও এখানে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই, সকলেই এমবিবিএস ডিগ্রিধারী।আইসিইউ/সিসিইউ/এইচডিইউ বিভাগে কোনো  বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না থাকলেও এভারকেয়ার হাসপাতালে কর্মরত বিশেষজ্ঞ ডা. অধ্যাপক এ এ এম রাইহান উদ্দিন চৌধুরীর নামফলক প্রদর্শন করে রোগীদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে।এ নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশের পর ডা. রাইহানের নামফলক সরিয়ে ফেলা হয়। এ ব্যাপারে ডা. রাইয়ানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “ একসময় আমি চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালে চাকরি করলেও বর্তমানে এভারকেয়ার  হাসপাতালে কর্মরত।”

হাসপাতালের আজীবন সদস্য করার ক্ষেত্রে রয়েছে লুকোচুরি। সমাজসেবা অধিদপ্তরে ৩৫০০ জন আজীবন সদস্যের রেকর্ড থাকলেও এখানে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি আজীবন সদস্য রয়েছে। আজীবন সদস্য হওয়া বন্ধ ঘোষণা থাকলেও জাহাঙ্গীর চৌধুরী ভোটব্যাংক সমৃদ্ধ করতে নিজের মতো করে আজীবন সদস্য করে আসছেন। হাসপাতালের প্রতিষ্ঠালগ্নে আজীবন সদস্য ফি ছিল ৫শ টাকা এরপর পর্যায়ক্রমে ১হাজার, ২হাজার, আড়াই হাজার, ৫হাজার, ১০হাজার ও সর্বশেষ ১৫হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সহজ পদ্ধতিতে আজীবন সদস্য করা হলে আজীবন সদস্যের সংখ্যা দ্বিগুণ হতো বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এতে করে হাসপাতাল লাভবান হতো। আজীবন সদস্য ফি বাবদ যে টাকা হাসপাতাল তহবিলে আসার কথা, তা যাচ্ছে ব্যক্তিবিশেষের পকেটে।

আজীবন সদস্যরা যা বলেন-

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের আজীবন সদস্য মওলানা হাসানুল করিম, বেলাল হোসেন, বদিউল আলম, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী,আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার বদরুদৌজা, খসরু চৌধুরী, শহিদুল্লাহ, মোহাম্মদ হাসান, ইঞ্জিনিয়ার আনিসুর রহমান, জসিম উদ্দিন চৌধুরী, হাসানুল করিম চৌধুরীসহ বেশকজনের সাথে চাটগাঁর বাণী’র কথা হয়। হাসপাতাল সম্পর্কে সকলের মন্তব্য নেতিবাচক। সকলের অভিযোগের আঙ্গুল জাহাঙ্গীর চৌধুরীর দিকে। সর্বজনীন এ প্রতিষ্ঠানকে তিনি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। বার্ষিক সাধারণ সভায় তারা নিমন্ত্রণ পান না। সভা অনুষ্ঠানের পরেই তারা জানতে পারেন এজিএম অনুষ্ঠানের কথা। অনুগত ও ঘনিষ্ঠজনেরাই কেবল এজিএম এর দাওয়াত পান। প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরী সব সদস্যকে নিমন্ত্রণ করেন না। এজিএম এর কোরাম পুরণ করা হয় হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারি ও আত্মীয়স্বজনের স্বাক্ষর নিয়ে।আজীবন সদস্য শাহাবুদ্দিন চৌধুরী চাটগাঁর বাণীকে মুঠোফোনে বলেন, “ ডায়াবেটিক হাসপাতালটি একজনের আখের গোছানোর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। একবার  হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের ভোট দিতে গিয়ে দেখি আমার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। প্রতিবাদ করলে কিছু লোক আমার দিকে তেড়ে আসে। সেই থেকে আর ডায়াবেটিক হাসপাতালে যাওয়া হয়নি।”

আজীবন সদস্য হাসানুল করিম বলেন, “ নিয়ম-নীতি বলতে এ হাসপাতালে কিছুই নেই দুর্নীতিই এখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। সকলে মিলে এ হাসাপাতালকে বাঁচানো দরকার।”

জাহাঙ্গীর চৌধুরীর অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সকল অপকর্মের সহযোগীরা হলেন- চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির নির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি এস এম শওকত হোসেন, কোষাধ্যক্ষ এ এস এম জাফর, সদস্য মো. আলী চৌধুরী, সদস্য মোহাম্মদ হাসান মুরাদ, সদস্য অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার তালুকদার, সদস্য মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ, অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর ডা. নওশাদ আজগর চৌধুরী, চিফ এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মো. আমানউল্লাহ আমান, চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. বেলাল উদ্দিন ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শিবু প্রসাদ চৌধুরী। এসব উপকারভোগীকে নিয়ে জাহাঙ্গীর চৌধুরী গড়ে তুলেছেন একটি চক্র। হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সকলেই জাহাঙ্গীর চৌধুরীর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও  অন্ধ ঘনিষ্ঠজন। নির্বাহী পর্ষদের প্রায় সকলের সাথে কথা হয় চাটগাঁর বাণীর।কিছু সদস্য হাসপাতালে কি হচ্ছে তার কিছুই জানেন না। তাদের অন্ধকারে রেখে সুবিধাভোগীরা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে যে সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক তদন্ত হয়েছে, অবৈধভাবে ভবন নির্মাণের কারণে যে সিডিএ ভবননির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে- এসব কিছুই জানেন না বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরিচালনা পরিষদের সদস্য।

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরী দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে যারা চট্টগ্রাম দুর্নীতি দমন কমিশন, চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বরাবরে আবেদন করেছেন তারা হাসপাতালটিকে মহাদুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে বাঁচাতে ৫টি প্রস্তাব রেখেছেন, তা হলো-

১.যেহেতু ২০১৫সাল থেকে বর্তমান  হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির কোনো বৈধতা নেই সেহেতু এ কমিটির সকল কার্যকলাপ অবৈধ ঘোষণা করে কমিটি বাতিল করা হোক।

২. এডহক কমিটি নিয়োগ দিয়ে সকলের অংশগ্রহণে পরিচ্ছন্ন একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক।

৩. সৎ ও যোগ্য লোক দিয়ে আজীবন সদস্যদের তালিকা যাছাই করে হালনাগাদ করা হোক।

৪. অডিট কমিটি নিয়োগ করে হাসপাতালের যাবতীয় হিসাব অডিট করা হোক। ৫. যারা অন্যায় কাজের সাথে জড়িত তাদের সকলকে আইনের আওতায় আনা হোক।

অনিয়ম-দুর্নীতি সম্পর্কে জানতে  হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে মুঠোফোনে কয়েকবার কল করে অবশেষে পাওয়া গেলেও সাংবাদিক পরিচয় দেয়ায় তিনি মিটিং-এ আছেন, ব্যস্ত আছেন, কলব্যাক করবেন ইত্যাদি অজুহাতে সংবাদমাধ্যমকে পরিহার করেন। বহু চেষ্টা করেও তাঁর প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

হাসপাতালের চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার আমান উল্লাহ আমানকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করে চাটগাঁর বাণীকে মুঠোফোনে বলেন, “ আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, তার কোনো ভিত্তি নেই, সবই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। ফ্ল্যাটবাড়িসহ  বিভিন্ন সম্পদঅর্জন নিয়ে বাজি ধরে আমান উল্লাহ চাটগাঁর বাণীকে বলেন, এসবের প্রমাণ দিতে পারলে দুই কোটি টাকা দেবো।”

অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা শিবুপ্রসাদ চৌধুরী মুঠোফোনে চাটগাঁর বাণীকে মুঠোফোনে বলেন,“আমি যাকিছু করছি, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই করছি।”

হাসপাতালের দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কে মুঠোফোনে কথা বলেন চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার বেলাল হোসেন। তিনি চাটগাঁর বাণীকে বলেন, “ আমি যা কিছু করেছি, হাসপাতাল কমিটির সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা অনুযায়ী করেছি।” অবশ্য ইতোমধ্যে বেলাল হোসেনকে ওএসডি করা হয়েছে। এখন হিসাব বিভাগের সকল দায়িত্ব পালন করছেন জাহাঙ্গীর চৌধুরীর পরম আত্মীয়  হাসপাতালের অর্ন্তবর্তী নিরীক্ষক মোহাম্মদ ইয়াছিন।

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পরিচালক মাহমুদ হাসান চাটগাঁর বাণীকে মুঠোফোনে বলেন, “ আমরা  চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসাপাতাল নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছি এবং তা যাচাই-বাছাই করছি। সদরদপ্তরের অনুমতি নিয়ে সহসা তদন্ত শুরু করবো।”

জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে  জানতে প্রশ্ন করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. শাখাওয়াত উল্লা  চাটগাঁর বাণীকে মুঠোফোনে বলেন, সিভিল সার্জন  নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন  দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত আছেন।তাঁর সাথে এ ব্যাপারে দেখা করবো। মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রোগ্রামের কারণে এখন কিছু করতে পারবেন না; পরেই শুরু করতে হবে।”

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শুরু করতে দেরি হচ্ছে কেন-জানতে চাইলে  তদন্ত কমিটির আহবায়ক চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী চাটগাঁর বাণীকে মুঠোফোনে বলেন,অফিসের মূল কাজে ভীষণ ব্যস্ত আছি।কাজের ফাঁকেই তো এসব করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর চট্টগ্রাম সফরের পরেই তদন্তের বিষয়টি নিয়ে ভাববো।”

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অন্যায়ভাবে ডাক্তারদের চাকরিচ্যুতির ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ডা. মুজিবুর রহমান চাটগাঁর বাণীককে মুঠোফোনে বলেন, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের দুর্নীতির বিষয়টি আমরা জেনেছি। তবে চট্টগ্রাম বিএমএ কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি সমর্থন করবে না,এর একটি বিহীত হওয়া দরকার।”

চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজ এর কো- চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আসা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “ দুর্নীতির সকল অভিযোগ সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা উচিত।”

চট্টগ্রাম গণঅধিকার চর্চাকেন্দ্রের মহাসচিব মশিউর রহমান খান চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালকে ঘিরে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে চাটগাঁর বাণীকে বলেন,“ মানবদেহের চিকিৎসার বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে এটিকে নিয়ে বাণিজ্য করা তুলনামূলকভাবে সহজ বলে ব্যঙেরছাতার মতো যেখানে সেখানে চিকিৎসা ও রোগনির্ণয় কেন্দ্র গড়ে ওঠছে। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালও এর ব্যতিক্রম নয়। সেবার নামে এখানে চলছে বাণিজ্য। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও বিত্তশালীদের কাছ থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা দান-অনুদান পাওয়ার পরও সেবাধর্মী এ  দাতব্য হাসপাতালটিতে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না ডায়বেটিস রোগীরা। ইনডোর চিকিৎসাসেবা নিম্নমানের। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকলেও প্রাইভেট হাসপাতালের মতো মাত্রাতিরিক্ত ফি আদায় করা হয়। দীর্ঘদিন হাসপাতাল পরিচালনা পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে না। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি হাসপাতাল পরিচালনা করছে।হাসপাতালের আজীবন সদস্যদের এব্যাপারে সোচ্চার হওয়া উচিত। আমি মনে করি , সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন কমিটি আসলে চলমান সমস্যার সমাধান হবে।”

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রাক্তন জাসদ ফোরাম নেতা সোলায়মান খান বলেন, “স্বাস্থ্যসেবার নামে জনগণের টাকা হরিলুটের অধিকার কারো নেই। তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে তাদের  বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে।”

জনমুক্তি ইউনিয়ন এর চট্টগ্রাম জেলা আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজা মিয়া চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে যেয়ে চাটগাঁর বাণীকে মুঠো বলেন, “ সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিত্তবানদের দান-অনুদান ও যাকাত-ফিতরার টাকা ডায়াবেটিক রোগীদের কল্যাণে ব্যয় না হয়ে ব্যক্তিবিশেষের পকেটে যাবে- তা হতে পারে না। যে বা যারা-ই এ দুর্নীতিতে জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।”

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা বাসদ (মার্কসবাদী) এর  সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট শফি উদ্দিন কবির আবিদ বলেন, “ চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা হলেও , বর্তমানে এ হাসপাতালকে কেন্দ্র করে চিকিৎসা বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাৎসহ দুর্নীতির যে অভিযোগ ওঠেছে তার নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সমাজসেবা অধিদপ্তর দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও অন্য সরকারি সংস্থাগুলো এখনও তদন্ত শুরু করতে পারিনি। এছাড়া সিডিএ’র অনুমোদন না নিয়ে হাসপাতালের নতুন ৬তলা ভবন নির্মাণের যে তৎপরতা চালাচ্ছে, তা রোগীদের জীবনঝুঁকিতে ফেলবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এ ধবনের স্বেচ্ছাচারি কাজের বিরুদ্ধে কঠোর  আইনি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।”

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা নারীমুক্তি কেন্দ্র এর সভাপতি  আসমা আক্তার চাটগাঁর বাণীকে মুঠোফোনে বলেন,“সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে সমিতির নামে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল চলছে। স্বাস্ব্য অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন নেই।সরকারি নজরদারি না থাকায় জনগণের টাকায় পরিচালিত এ হাসপাতালে দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম হয়েছে। দুর্নীতির যে তদন্ত চলছে তার রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে দোষীদের । নিশ্চিত করতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। মানুষের স্বাস্থ্যচিকিৎসা একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এটিকে পুঁজি করে কাউকে বাণিজ্য করতে দেয়া যায় না। এর বিরুদ্ধে দল-মত-নির্বিশেষে সকলকে সোচ্চার ও প্রতিবাদমুখর হতে হবে।”

“চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান।এখানে স্বল্পমূল্যে সাধারণ মানুষ চিকিৎসাসেবা পাওয়ার কথা। অথচ মহৎ উদ্দেশ্যক সামনে রেখে পরিচালিত না হয়ে তার ঘোষিত নীতির বিপরীতে চলছে এ দাতব্য  চিকিৎসালয়টি।ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে হাসপাতালটির সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের খবর এসেছে।সমাজসেবা অধিদপ্তর দুর্নীতির তদন্ত শেষ করলেও দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তদন্ত শুরুই করতে পারেনি- যা উদ্বেগজনক। এ পরিস্থিতিতে একজন নাগরিক হিসেবে অবশ্যই এর সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি।” চট্টগ্রাম ডায়বেটিক হাসপাতালের দুর্নীতি নিয়ে এসব কথা বলেন বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অপু দাশগুপ্ত।

গণসংহতি আন্দোলন নেতা হাসান মারুফ রুমীর কাছে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অতীতে  বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ডায়াবেটিক হাসপাতালের দুর্নীতির খবর দেখেছি।জনগণের টাকায় পরিচালিত একটি দাতব্য হাসপাতালে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি চলতে দেয়া যায় না। দেশে এখন চিকিৎসাব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমান মুদ্রাস্ফীতিকালে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও খাবার কিনতে মানুষ রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। ফলে অনেকেই প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়া বাদ দিয়েছে ও দিচ্ছে। এরকম দুর্নীতি হলে মানুষের যা ন্যুনতম অধিকার আছে ,সেটা থেকেও বঞ্চিত হবে।দুর্নীতি যদি দ্রুত রোধ করা না যায়, তাহলে ডায়াবেটিস রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই এ অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি না খেলে তা মানুষের দৌরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে।”

সিআরবি রক্ষা মঞ্চ এর পাহাড়তলী রেলওয়ে অঞ্চলের আহবায়ক মঈন উদ্দিন চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের দুর্নীতি সম্পর্কে বলেন, “ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্তে প্রফেসর জাহাঙ্গীর চৌধুরী দোষী প্রমাণিত হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। কোনো ব্যক্তির দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে পারে না। এ ব্যাপারে আমি নতুন জেলাপ্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”

প্রীতিলতা স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সদস্যসচিব চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগনেতা লিটন চৌধুরী রিংকু চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলেন, “পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল পরিচালনা পরিষদের সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে- তা সত্যিই উদ্বেগজনক। জনগণের টাকায় পরিচালিত একটি দাতব্য হাসপাতালে কোটি কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। প্রয়োজনে এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।”

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা হয় স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল অনুবিভাগ) নাজমুল হক খানের সাথে। চাটগাঁর বাণীকে তিনি মুঠোফোনে বলেন, “চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের দুর্নীতির ব্যাপারে আমরা লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেলে অবশ্যই আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।”

উল্লেখ্য, ‘শৃঙ্খলাই জীবন’- এ স্লোগানকে সামনে রেখে ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা থেকে নিবন্ধন নেয়।নিবন্ধনের তিনবছর আগে থেকে চট্টগ্রাম শহরের কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্রে ডায়াবেটিক হাসপাতালের বর্হিবিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়।অতঃপর সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ১৯৭৮ সাল থেকে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে, ১৯৮১ সাল থেকে মেহেদিবাগে এবং ১৯৮৮ সাল থেকে এনায়েতবাজারে একটি পরিত্যক্ত ভবনে চিকিৎসা কার্যক্রম চলে। ২০০১ সালের মার্চ মাসে খুলশী থানাধীন জাকির হোসেন রোডে রেলওয়ের দেয়া প্রায় একএকর জায়গার ওপর নির্মিত নিজস্ব ভবনে হাসপাতালটি স্থানান্তরিত হয়। ২০০৮ সালের মার্চ মাসে চালু হয় অন্তর্বিভাগ কার্যক্রম। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালটির নামকরণ হয় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে এ হাসপাতালের ৪টি শাখা আছে। শাখাগুলো- এনায়েতবাজার শাখা, বন্দরটিলা শাখা, অক্সিজেন শাখা ও বহদ্দারহাট শাখা।

লেখক- প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম