চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রতিটি ধাপে অসংগতি, কার্যকর আইন-বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ঘাটতি, অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে সৃষ্ট সুশাসনের অভাবে নাগরিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ প্রতিনিয়ত মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। “চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আজ মঙ্গলবার এ মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের ঘাটতি দূরীকরণে ১১ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির রিসার্চ ফেলো মো. নেওয়াজুল মওলা ও গবেষণা সহযোগী মো. সহিদুল ইসলাম।
গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন আইনি দুর্বলতার পাশাপাশি চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি ও অনিয়ম-দুর্নীতি বিদ্যমান। চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী বর্জ্য সংরক্ষণের জন্য ৬টি নির্দিষ্ট রঙের পাত্র রাখার নির্দেশনা থাকলেও জরিপকৃত হাসপাতালের ৬০ শতাংশে তা নেই। এসব হাসপাতালের অভ্যন্তরে যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে বর্জ্যকর্মী সব ধরনের বর্জ্য একত্রে বালতি/গামলায় সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে। ৬৬ শতাংশ হাসপাতালে বর্জ্য মজুদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ নেই। বর্জ্য মজুতকরণের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ না থাকায় উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য ফেলে রাখা হয়। বিধি অনুযায়ী বর্জ্য পরিশোধনে জন্য অটোক্লেভ যন্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও ৪৯ শতাংশ হাসপাতালের অটোক্লেভ যন্ত্র নেই। ফলে এসব হাসপাতালে চিকিৎসা উপকরণ পরিশোধন না করেই পুনঃব্যবহার করা হয়। এমনকি, ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর বর্জ্য ও সাধারণ চিকিৎসা বর্জ্য একত্রে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়।
অন্যদিকে, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ অনুযায়ী ‘‘লাল’’ শ্রেণিভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে হাসপাতালে তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) থাকা বাধ্যতামূলক হলেও ৮৩ শতাংশ হাসপাতালে ইটিপি নেই। আবার, বিধি অনুযায়ী চিকিৎসা বর্জ্য শোধন ও অপসারণের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ ও অবকাঠামো তৈরির নির্দেশনা থাকলেও জরিপের আওতাভুক্ত বেশিরভাগ (৮০ শতাংশ) সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভাতে চিকিৎসা বর্জ্য শোধনাগার নেই। মাত্র ৮টি সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভাতে শোধনাগার আছে, এর মধ্যে ৫টিতেই চিকিৎসা বর্জ্য পরিশোধন করা হয় না। জরিপকৃত সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভার ১৪ শতাংশে চিকিৎসা বর্জ্য অপসারণ করার জন্য কোনো ল্যান্ডফিল নেই। গবেষণার আওতাভুক্ত এলাকার মাত্র একটি সিটি কর্পোরেশনে স্যানিটারি ল্যান্ডফিল আছে। পুনঃচক্রয়াণ ও পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন থাকলেও সে অনুসারে বিধিমালায় পুনঃব্যবহার (reuse) ও পুনঃচক্রয়াণযোগ্য (recycle) বর্জ্যরে আলাদা শ্রেণি তৈরি করা হয়নি। এ ছাড়া বিধিতে পুনঃব্যবহার ও পুনঃচক্রয়াণযোগ্য চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। ফলে পুনঃব্যবহার ও পুনঃচক্রয়াণযোগ্য বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনাও হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে হাসপাতালের অভ্যন্তরে বর্জ্য পরিবহণের জন্য বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী ট্রলিতে পৃথক কালার কোড ও লেবেল থাকার নির্দেশনা বিধিতে অনুপস্থিত। যার ফলে সকল ধরনের বর্জ্য একই ট্রলিতে পরিবহণ করায় সংক্রমণ ও পরিবেশগত ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে গত ১৪ বছরেও চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা, ২০০৮ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অন্যতম অংশীজন হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতাল ও সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভার কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্টজন বিদ্যমান আইনিকাঠামো ও দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত না এবং অংশীজনদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই।
একই সঙ্গে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সমন্বয় এবং অংশীজনের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করায় ঘাটতি রয়েছে। অধিকাংশ হাসপাতালে অভ্যন্তরীণ বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। হাসপাতাল ও বহির্বিভাগীয় ব্যবস্থাপনাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, বাজেট, আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের ঘাটতি বিদ্যমান। এ ছাড়া, চিকিৎসা বর্জ্যকর্মী নিয়োগে ২ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বিধিবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন, অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটেছে। বর্জ্যকর্মীর নিয়োগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তি ও বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ-সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি ও অনিয়ম রয়েছে। অন্যদিকে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে অবহেলা ও বিবিধ অনিয়ম-দুর্নীতি থাকলেও তা প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সংক্রমণসহ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অপরিসীম গুরুত্বের উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত আইনি ও বিধিমালা কাঠামো কাগজে কলমে থাকলেও, তার কার্যকর বাস্তবায়ন কিংবা জবাবদিহিতা কোনোটিই নেই। সুশাসনের যে সাতটি নির্দেশকের ভিত্তিকে এই গবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে, তার সকল ক্ষেত্রেই উদ্বেগজনক ঘাটতি আছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০০৮ সালে প্রণয়নের পর ১৪ বছর পার হয়েছে, কিন্তু এখনও বিধি অনুযায়ী “কর্তৃপক্ষ” গঠিত হয়নি; কেনো হলো না, তার জবাবদিহি নেই। রয়েছে দায়িত্ব পালনে অবহেলা, সমন্বয়হীনতা ও দুর্নীতি-অনিয়মসহ সার্বিক অরাজকতা। চিকিৎসা সেবার এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি ও দুর্নীতির কারণে রোগ প্রতিরোধের পরিবর্তে রোগের সংক্রমণ এবং পরিবেশ বিনষ্টের ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে প্রতিটি পর্যায়ে।’
জুন ২০২১ থেকে নভেম্বর ২০২২ সময়কালে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করে মিশ্র পদ্ধতিতে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ তথ্যের ক্ষেত্রে প্রথমে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে ৪৫টি জেলা নির্বাচন করে জেলাগুলোর অন্তর্ভুক্ত ৪৭টি সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা এলাকাকে গবেষণা এলাকা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। এরপর গবেষণা এলাকার মোট ২৩১টি প্রতিষ্ঠান (১৮১টি হাসপাতাল, ৩৮টি সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা কর্তৃপক্ষ এবং ১২টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান) এবং এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যকর্মীদের মধ্য থেকে সমানুপাতিক নমুনায়ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত ৯৩ জনের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করা হয়। পাশাপাশি গবেষণার জন্য পরোক্ষ উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আধেয় বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা হয়েছে।
চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের ঘাটতি দূরীকরণে টিআইবির পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়, তদারকি ও তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে ‘‘কর্তৃপক্ষ’’ গঠন করা এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি গঠন করা; আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা, ২০০৮ সংশোধন করা; পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর সংশ্লিষ্ট ধারায় সুস্পষ্টভাবে চিকিৎসা বর্জ্যকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা এবং চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, হাসপাতাল, সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সাথে সমন্বয় করে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা ইত্যাদি।