মোহাম্মদ ইউসুফ *
সমাজের প্রতিটি মানুষ তার কাজের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি চায়, চায় প্রশংসা ও অনুপ্রেরণা। রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চকিদার পর্যন্ত সমাজের প্রতিটি মানুষ প্রশংসার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকে। প্রচলিত একটি কথা আছে, যে সমাজ গুণিজনদের সমাদর করে না, সেখানে গুণিজনের জন্ম হয় না। এলাকার পরলোকগত ও জীবিত গুণিসন্তানদের কীভাবে সম্মান ও মূল্যায়ন করতে হয়- তা বাড়বকুণ্ডের মান্দারিটোলা ঈদগাহ কমিটি সকলকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সীতাকুণ্ডের শিক্ষার ইতিহাসের প্রবাদপুরুষ, সীতাকুণ্ড আলীয়া মাদ্রাসা, সীতাকুণ্ড সরকারি মডেল হাইস্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব, মহামানব মওলানা ওবায়দুল হকসহ বহু গুণী-জ্ঞানী মানুষের জন্মস্থান এ মান্দারিটোলা গ্রাম।

মওলানা ওবায়দুল হক ছাড়াও অতীতে বিভিন্ন সময়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে অবদান রেখেছেন মান্দারিটোলা গ্রামের এমন আটজন কৃতিসন্তানকে মরণোত্তর সম্মাননা দেয়া হয়। আট এ গুণি ব্যক্তিত্ব হলেন-বাড়বকুণ্ড উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও চট্টগ্রামের সাবেক জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক মৌলভী ছাদাকাত উল্লাহ, চট্টগ্রামের সাবেক জেলা শিক্ষা অফিসার নুরুল হক, চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাইস্কুলের সাবেক প্রধানশিক্ষক এ কে এম ফজলুল হক (আবু), বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী মোহাম্মদ খলিল বি এ, গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন প্রকল্পের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম আবুল খায়ের, চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আয়ুব আলী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রখ্যাত শ্রমিকনেতা এ টি এম নিজাম উদ্দিন ও বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ম. শহীদুল্লাহ।
অন্যদিকে মান্দারিটোলার যেসব কৃতিসন্তান সম্মাননা স্মারকে ভূষিত হন, তাঁরা হলেন-ডাক ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মুহাম্মদ আবু হেনা মোরশেদ জামান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ শামীম সোহেল, সাবেক আইজিপি নুরুল আনোয়ার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর পরিচালক ও ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ফছিউল আলম, চট্টগ্রাম কর আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শওকতুল আলম, বাড়বকুণ্ড উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধানশিক্ষক মো. রবিউল হোসেন ও বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের সদস্য মোহাম্মদ জামাল উল্যাহ।
গত ৬মে ২০২৩ সকালে বাড়বকুণ্ডের মান্দারিটোলা ঈদগাহ কমিটির উদ্যোগে স্থানীয় সমুদ্রসৈকতে আয়োজিত ঈদপুনর্মিলনী ও গুণিজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে ঘিরে সচিব, যুগ্নসচিব, ডিসি, ইউএনও থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারি,ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চিকিৎসকসহ সকল শ্রেণিপেশার বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানস্থল মহামিলনমেলায় রূপ নেয়।গুণিজন সম্মাননা অনুষ্ঠানে বসেছিল রীতিমতো চাঁদেরহাট। এলাকার সকল কৃতিসন্তান ও সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদচারণায় উপকূলীয় শান্ত পরিবেশ মুখরিত হয়ে ওঠে। এ ধরনের আয়োজন মান্দারিটোলার ইতিহাসে এ-ই প্রথম-যা অন্য এলাকার মানুষের জন্যে দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। জমকালো এ সফল আয়োজন করতে পেরে আয়োজকেরা ছিল আনন্দে আত্মহারা ও গর্বিত।
সংবর্ধনা কমিটির আহবায়ক, বাড়বকুণ্ড উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধানশিক্ষক মো. রবিউল হোসেনের সভাপতিত্বে ও লতিফা সিদ্দিকী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক লোকমান মিয়া, টিএসপি হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক আবদুল আলিম এবং সংবর্ধনা কমিটির সদস্যসচিব জাবের আল মাহমুদের যৌথ সঞ্চালনায় এ মহতি অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মান্দারিটোলা ঈদগাহ কমিটির সভাপতি দিদারুল আলম। সংবর্ধিত প্রধানঅতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ডাক ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মুহাম্মদ আবু হেনা মোরশেদ জামান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ শামীম সোহেল, চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান,সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আশরাফুল আলম। সম্মানিত অতিথির বক্তব্য রাখেন সাবেক আইজিপি নুরুল আনোয়ার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর পরিচালক ও ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. মুহাম্মদ ফছিউল আলম। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্ল্যাহ মিয়াজী, চট্টগ্রাম কর আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শওকতুল আলম, সহযোগী অধ্যাপক মাসুম মুকুল, সহযোগী অধ্যাপক মো.নাজমুল হক, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.আব্দুল্লাহ আল মামুন, প্রভাষক মো. কামরুজ্জামান, ডা. আব্দুল হামিদ ইমন, জেএমআই গ্রুপের এমডি মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, ইউপি সদস্য মোহাম্মদ জামাল উল্যাহ ও মান্দারিটোলা ঈদগাহ কমিটির সেক্রেটারি জসিম উদ্দীন মোবারক। এসময় মান্দারিটোলার যেসব কৃতিসন্তান বিসিএস স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন এবং যারা নন ক্যাডার চিকিৎসক, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার,আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশায় আছেন তাঁদেরও মঞ্চে পরিচয় করে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়।
মান্দারিটোলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, কর্মসংস্থানসহ সার্বিক উন্নয়নে এলাকাবাসীর সকল দাবীদাওয়া পূরণের আশ্বাস দিয়ে প্রধানঅতিথি আবু হেনা মোর্শেদ জামান বলেন, আমি এখানে রাজনীতি, ইউনিয়ন ও উপজেলা চেয়ারম্যান কিংবা এমপি নির্বাচন করবো না। আমি বা আমার ছেলেমেয়েরাও কেউ এখানে থাকতে আসবে না। আমি এ এলাকার উন্নয়নে যাকিছু করবো, মাটির টানেই করবো,নীরবে করে যাবো। দিনশেষে এ মান্দারিটোলায় আমার কবর হবে। বছরে দুজন লোকও যদি জুমার নামাজের পর আমার কবর জেয়ারত করে সেটিই হবে আমার বড় প্রাপ্তি। এসময় তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান মান্দারিটোলাবাসীর দাবিদাওয়া পূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়ার জন্যে। ধন্যবাদ জানান,সীতাকুণ্ড ইউএনও শাহাদাত হোসেন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলমকে এলাকার উন্নয়নে সহযোগিতার জন্যে। সচিব আবু হেনা জিএমআই গ্রুপের এমডি আবদুর রাজ্জাককে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি বলেছেন, আপনার ফ্যাক্টরিতে দুহাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আমার প্রশ্ন,আমাদের মান্দারিটোলার কজনের চাকরি হয়েছে।আপনি মান্দারিটোলাতে সোনার খনি আবিস্কার করার কথা বলেছেন।সব সোনা আপনারা নিয়ে যাবেন না, আমাদেরও কিছু দেবেন।পুঁজি বিনিয়োগের উদ্দেশ্য মুনাফা, তবে শিল্পএলাকার মানুষের স্বার্থও দেখতে হবে। এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট না করে শিল্পায়ন করার পরামর্শ দিয়ে শিল্পপতিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, শিল্পকারখানা পরিচালনায় মান্দারিটোলাবাসী আপনাদের সহযোগিতা করবেন আর আপনাদেরও এলাকাবাসীর পাশে থাকতে হবে।তবে কর্মসংস্থানের জন্যে দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। এসময় উপস্থিত ইউএনওকে যুবউন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে এলাকার যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন।
ড. ফছিউল আলমের বক্তব্যের সূত্র ধরে মোরশেদ জামান বলেন, ড. ফছিউল আলম সাহেব আফসোস করে বলেছেন, আমরা মান্দারিটোলায় একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি তৈরি করতে পারিনি। এ ব্যাপারে আমি বলতে চাই, আমরা শিল্পপতি তৈরি করতে না পারলেও একজন ফছিউল আলম, একজন নুরুল আনোয়ার ( সাবেক আইজিপি), একজন শামীম সোহেল (যুগ্মসচিব) তো তৈরি করতে পেরেছি। কামনা করি, শামীম সোহেল আমার মতো সচিব কিংবা আরও বড়কিছু হবে। অবসরে গিয়ে যখন কোনো চক্ষুচিকিৎসকের কাছে যাবো, তখন তিনি বিনাপয়সায় চিকিৎসা করে আমাকে বলবেন, আমি মান্দারিটোলারই সন্তান। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন যাবো- তখন যাতে দেখতে পাই, ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধান মান্দারিটোলারই সন্তান।এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে মান্দারিটোলার সন্তানেরা যখন তাদের জায়গা করে নেবে- সেটাই হবে আমাদের বড় অর্জন। পরিশেষে তিনপুত্রসন্তানের পিতার গল্প বলে সচিব আবু হেনা তাঁর বক্তব্যের ইতি টানেন। গল্পের বাবা বড়ছেলেকে ১০টাকা দিলেন ঘর আলোকিত করতে। ১০টাকার খড় কিনে এনে ছেলেটি ঘরে ছড়িয়ে দিলে ঘর নোংরা হয়ে যায়। মেঝছেলেকে ১০টাকা দিলে সে ১০টাকার কাগজ এনে ঘরে ছিটিয়ে দিলে ঘর আবর্জনায় ভরে যায়। এবার বাবা ছোটছেলেকে ১০টাকা দিলে সে ৫টাকার একটি দিয়াশলাই বক্স ও ৫টাকার মোমবাতি কিনে এনে ঘরের মাঝখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলে পুরো ঘর আলোকিত হয়ে যায়। আমরা মান্দারিটোলায়ও এমনসব সন্তান তৈরি করবো যারা সীমিত সম্পদ দিয়ে পুরো এলাকা আলোকিত করে তুলবেন।
অনুষ্ঠানে মান্দারিটোলাকে একটি ” মডেল ভিলেজ” করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে অন্য বক্তারা বলেন, “এলাকার প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট যেকোনো সমস্যা সমাধানে থাকবে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস। মানবিক চেতনা জাগ্রত করার মাধ্যমে দারিদ্রতা ও বেকারত্ব দূরিকরণ, বিয়ে-শাদী বা যেকোনো আর্থিক সংকটে সকলকে সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। মান্দারিটোলা গ্রামের মানুষের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্যে সকলকে দল-মত-নির্বিশেষে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।”
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিজমি ও লোকালয়ে শিল্পকারখানা না করে ইকোনমিক জোনে শিল্পায়নের কথা বারংবার বলে আসলেও শিল্পপতিরা তা পাত্তা দিচ্ছেন না। দেশে ভূমি ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় এমনটি হচ্ছে। এ সুযোগে বাড়বকুণ্ডের মান্দারিটোলা গ্রামের কৃষিজমিতে ৫টি এলপিজি গ্যাস কারখানা গড়ে ওঠেছে। এগুলো হচ্ছে- বিএম এনার্জি (বিডি) বাংলাদেশ, ইউনি গ্যাস, ইউরো গ্যাস, ইউনিভার্সেল ও জেএমআই গ্রুপ। অর্কিডসহ আরো কয়েকটি গ্যাস ফ্যাক্টরি স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। কৃষিজমি কিনে জনবসতি এলাকায় এসব এলপিজি কারখানা স্থাপিত হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এ ৫টি এলপিজি কোম্পানিতে ১০/১৫ দারোয়ান-বাবুর্চি ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারি পদে একজনকেও চাকরি দেয়া হয়নি। অদক্ষতার দোহাই দিয়ে স্থানীয় লোকের চাকরি দেয়া হয় না। অথচ অদক্ষ লোকেরও এসব কা্রখানায় কাজ করার সুযোগ আছে। কিছুদিন কাজ করে তারা দক্ষ হয়ে ওঠতে পারে। উর্বর ধানী জমিতে কারখানাগুলো গড়ে ওঠায় কৃষিশ্রমিকেরা বেকার হযে গেছে। এসব বেকার লোকজন তাদের গ্রামের বুকে গড়েওঠা কারখানায় চাকরি পাবে না- তা তো হতে পারে না। জনপ্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে সক্রিয় কোনো ভূমিকা রাখছে না বলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলছে না এলাকার বেকার জনগোষ্ঠীর।
লেখক- প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম