[bangla_date] || [english_date]

বিশেষ প্রতিনিধি *

আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস । বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিবস। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ডের নাম জানান দেয়ার দিন। আজ ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের ৫২ বছর পূর্ণ হলো। এই গৌরবগাঁথায় যেমন আছে বিজয়ের আনন্দ, তেমনি আছে স্বজন হারানোর বেদনাও।

একাত্তরের মার্চ মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলার দামাল ছেলেদের নিয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আজকের দিনে পাক-বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটায়। এবারের বিজয় দিবস পালিত হবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক শক্তির ধারক-বাহকদের প্রত্যাখ্যান করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে বিজয়ী করার প্রত্যয়ে ভিন্নভাবে উজ্জবিত জাতি দিবসটি পালন করবে।

বিজয় দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা পৃথক বাণী দিয়ে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এছাড়া নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে বিজয় দিবস পালিত হবে।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার বাণীতে পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা হলো বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই অর্জনকে অর্থবহ করতে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সবাইকে জানতে ও জানাতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমরা পৌঁছে দিবো- বিজয় দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

আজ বিজয় দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জনতার ঢল নামবে। শ্রদ্ধার সঙ্গে তারা শহীদের উদ্দেশে নিবেদন করবেন পুষ্পাঞ্জলি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সব প্রান্তের মানুষ অংশ নেবে বিজয় দিবসে। বঙ্গবন্ধুর বজ্র নিনাদ ভাষণ আর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের জাগরণী গানে আকাশ-বাতাস হবে মুখরিত। আজ সরকারি ছুটির দিন। সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপসমূহ জাতীয় পতাকা ও বিভিন্ন পতাকায় সজ্জিত করা হয়েছে। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসমূহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে।

১৯৪৭ সালে দুইশ’ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে এ অঞ্চলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান নামে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। একটি থেকে হাজার মাইল ব্যবধানের মধ্যে আরেকটি। এ পৃথক দুই ভূ-খ- নিয়ে সৃষ্ট পাকিস্তান ব্রিটিশ শাসনামলে প্রচলিত শোষণের চিরায়ত ধারা থেকে মুক্তি পেল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সত্যিকারের স্বাধীনতা বঞ্চিত হয়ে রইল। পশ্চিম পাকিস্তান এ দেশে শোষণ চালাতে থাকে। তারা বাঙালি গণমানুষের ভাষা সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য ধ্বংস করার জন্য সুপরিকল্পিত চক্রান্ত করে। পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সমৃদ্ধ ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবন ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও বাঙালিদের ওপর বিজাতীয় উর্দু সংস্কৃতি গ্রহণ করতে বাধ্য করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি হটিয়ে তারা সামরিক শাসন এবং নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। এতে বাঙালি জাতি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তানের সব অনাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। বাঙালি জাতির এ প্রতিবাদী চেতনা সহ্য করতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বাঙালিদের ওপর শোষণ ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাদের নির্যাতনের মাত্রা যত বাড়তে থাকে বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামও ততই বেগবান হয়। এভাবে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৮-৬৯’র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধের পথ ধরে ঊনসত্তরে বীর বাঙালি জাতি ফুঁঁসে ওঠে। এর মধ্যেই সংঘটিত হয় ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। সেই গণআন্দোলনে পতন ঘটে সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুবের। কিন্তু বাঙালির অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হয়ে বরং আবারও ক্ষমতার দৃশ্যপটে আসেন আরেক সামরিক স্বৈরাচারী শাসক ইয়াহিয়া খান। আন্দোলনের পথ বেয়ে পাকিস্তানি শাসকরা বাধ্য হয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন দিতে।

১৯৭০ সালে দেশে প্রথম অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এ ভূ-খণ্ডের এবং বাঙালি গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও দেশ পরিচালনার ভার বঙ্গবন্ধুর হাতে না দিয়ে পাকিস্তানি শাসক চক্র ভিন্নরকম চক্রান্তে মেতে ওঠে।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হলেও পরে তা স্থগিত করে দেয় পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া। এর ফলে বাঙালি প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে। রাজপথে স্লোগান ওঠে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। একাত্তরের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শুরু হয় সারাদেশে গণমানুষের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। এরপর সামরিক চক্র আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকে বাংলাদেশে। ২৫ মার্চ বর্বর পাক-বাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর সামরিক শাসকচক্র তাকে গ্রেপ্তার করলে তার অনুপস্থিতিতেই তার নির্দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় গঠিত হয় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার। এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত করতে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি গ্রামে। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের পর বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে।’ ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তনি সেনা কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন।

বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান

যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস পালনের লক্ষ্যে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিকরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। দেশের সব জেলা ও উপজেলা সদরে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে।

আওয়ামীল লীগ : বিজয় দিবস উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারাদেশের সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।

এছাড়া সারাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক আলোচনাসভা, বিজয় র‌্যালি, আলোকচিত্র, ডকুমেন্টারি ও চলচ্চিত্র প্রদর্শন, মুক্তিযুদ্ধের গান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার প্রকাশ করা হবে।

এছাড়া বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া, মিলাদ মাহফিল, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বিভিন্ন সংগঠন। এছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহিদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হবে এবং এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, সরকারি শিশুসদনসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস সমূহে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে কর্মসূচি পালন করা হবে।