শোকাবহ ১৫ আগস্ট। আজ জাতীয় শোক দিবস। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদতবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এ দিনে কাকডাকাভোরে বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। এদিন বাঙালি জাতির ললাটে একদল হায়না এঁটে দেয় কলঙ্কের তিলক। যে কলঙ্ক থেকে দেশ-জাতি আজও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। খুনিদের মধ্যে ৫জনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে, কিন্তু দণ্ডিত বাকি ৬খুনি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিদেশে পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস জোরদার করবে-এমন প্রত্যাশা সরকারের কাছে।
মর্মস্পর্শী এ হত্যাকাণ্ডের আজ ৪৩ বছর পূর্ণ হলো। ঘটনার ৩৪ বছর পর গত ২০১০ সালে প্রত্যক্ষ ঘাতকদের কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে। এতে কিছুটা হলেও জাতির গ্লানিমুক্তি ঘটেছে। তবে এখনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন ঘাতক বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। অন্যদিকে এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। সেসব কিন্তু আজো উন্মোচিত হয়নি, শনাক্ত হয়নি হত্যার ষড়যন্ত্রকারীরা, নেপথ্য নায়করা।
অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক স্বদেশ গড়ার যে লক্ষ্য ও আদর্শকে সামনে রেখে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সেই স্বপ্ন-সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেশকে আবার সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের পথে ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্য নিয়েই ঘটানো হয়েছিল ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি। ঘাতকদের লক্ষ্য ছিল শুধু বঙ্গবন্ধু পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করাই নয় বরং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশটাকেই ধ্বংস করে দেয়া। তাই তো ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় একই বছরের ৩ নভেম্বর কারা অভ্যন্তরে হত্যা করা হলো বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর চার জাতীয় নেতাকেও। ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তির প্রতিশোধ গ্রহণের যে প্রক্রিয়া সে সময় অঙ্কুরিত হয়েছিল তারই একটি ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটে ১৫ আগস্টে। স্বাধীন বাংলার স্থপতিকে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারীরা খুনিদের যাতে বিচার না হয় সেজন্য ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে স্বঘোষিত খুনিরা পরবর্তী সময়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে থাকার সুযোগ পায়। এদের কেউ কেউ বিদেশে মিশনে চাকরি পেয়ে পুরস্কৃত হয়। ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিলের আগ পর্যন্ত ২১ বছর স্বঘোষিত খুনিরা বিচারের আওতা থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ পেয়েছিল। অনেক দেরিতে ও পাহাড়সম বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। খুনিদের মধ্যে পাঁচজনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে, কিন্তু দণ্ডিত বাকি ছয় খুনি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুজনের অবস্থান সরকার জানলেও বাকি তিনজনের অবস্থানই অজানা। দীর্ঘ সাড়ে সাত বছরেও এই খুনিদের দেশে ফিরিয়ে দণ্ড কার্যকর করতে না পারাটা জাতির জন্য হতাশার। আমরা আশা করব, সরকার বিদেশে পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস জোরদার করবে।
জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা শুধু কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের কাজ নয়, এর নেপথ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কিছু তথ্য ওঠে এসেছে দেশি-বিদেশি গবেষক সাংবাদিকদের লেখায়। জোর দাবি ওঠেছে একটি কমিশন গঠন করে এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করার এবং চক্রান্তকারীদেরও বিচারাধীন করার। আমরা চাই সরকার এ লক্ষ্যে দ্রুত উদ্যোগ নিক। কারণ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তি মুজিব ও তাঁর পরিবারকে হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয় ও সংবিধান ছেঁটে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের-বিরোধী ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলে। সে ষড়যন্ত্র, সে অপচেষ্টা এখনো বলবৎ। একই লক্ষ্য ও চক্রান্তের পথ ধরে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে গেছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টসহ আরো কিছু হামলা-হত্যাকাণ্ড। কাজেই জাতীয় নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে সুরক্ষার জন্যই দরকার বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের উদঘাটন করতে হবে।
১৫ আগস্ট উপলক্ষে আজ সাধারণ ছুটি থাকবে। সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। সকাল সাড়ে ছয়টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। সাড়ে সাতটায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য শহীদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।