গোলাম সারোয়ার *
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ যে একটি ন্যায়যুদ্ধ তার দলিল হলো, স্বাধীনতার মাত্র তিন মাসের মধ্যে বিশ্বের ৫৪ টি দেশ কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল আকারে ও প্রকারে একটি জনযুদ্ধ । মানে জনগণ যে যেভাবে পেরেছে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে । এরকম একটি ন্যায়যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া দেশের যুদ্ধপরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে এ দেশের প্রতিটি তরুণ, যুবকের গর্বিত হওয়ার কথা । কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো অন্য যে কোনো ব্যাপারের মতো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও নতুন প্রজন্ম দ্বিধাবিভক্ত ।
তার কারণ আছে । কারণ হলো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশের ইতিহাসে একটি বিপদজ্জনক মোড় নেয় । আর এ বিপর্যয়কর মোড় নেয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় শক্তিগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পরিণামে ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত হয়েছে তারা ইতিহাসকে নিয়ে যায় বিভ্রান্তির পথে । তাই আজ ইতিহাসের সত্য উদঘাটনে এতো কষ্ট ।
সুতরাং এ প্রজন্মের দেশ প্রেমিক তরুণ, যুবকদের সত্য সমুন্নত রাখার স্বার্থেই সত্য অন্বেষণ চালিয়ে যেতে হবে । মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের ইতিহাস এবং তার প্রেক্ষাপট এতো দীর্ঘ মহাকাব্য যে তা’ যেকোনো ক্ষুদ্র পরিসরে লিখা সম্ভব নয় । তাই এ প্রজন্মের চোখ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখার দৃষ্ট্রতার জন্যে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতেই হবে ।
ইতিহাসের আগের ইতিহাসঃ
ব্রিটিশরা আমাদের এ ভারতীয় উপমহাদেশটিকে প্রায় দুইশ’ বছর শাসন-শোষণ করেছে । তাদের হাত থেকে স্বাধীনতার জন্যে অগণিত মানুষ জীবন দিয়েছে । অবশেষে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে স্বাধীনতার আশা দেখা দেয় । এ সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে ১৯৪০ সালে ‘লাহোর প্রস্তাব’ আনা হয় । প্রস্তাবটির মূল কথা হলো, ভারতবর্ষের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটি মুসলিম দেশ হবে । আর বাকী অঞ্চল নিয়ে আর একটি দেশ হবে ।
অবশেষে লাহোর প্রস্তাব অনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি দেশ এবং ১৫ আগস্ট বাকি অঞ্চল নিয়ে ভারত নামে হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ অন্য একটি দেশের জন্ম হয় ।
দুটি ভিন্ন ভূখণ্ডের একটি বিচিত্র দেশঃ
পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান নামে যে দুটি প্রদেশ মিলে পাকিস্তান নামক বিচিত্র দেশ হয় তাদের মাঝে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব । দূরত্ব আরো ছিল । দুই দেশের মানুষের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, সংস্কৃতি, মূল্যবোধের ছিল আরো বেশি দূরত্ব । শুধু মিলের মধ্যে মিল ছিল ধর্ম ।
প্রথম আঘাত ভাষায়ঃ
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণমূলক আচরণ । কেবল অর্থনৈতিক শোষণ নয়, বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপরও নিপীড়ন শুরু হয় এবং এর প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়, যখন পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দেন “উর্দু এবং কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। এই ঘোষণার সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা এই ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে । ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্যে এ আন্দোলন তীব্রতম রূপ ধারণ করে । এদিন পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ আরো অনেকে । পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে হয় । আজ পৃথিবীব্যাপী ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। বৈষম্য শুরু থেকেঃ
দেশভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি আর পূর্ব পাকিস্তানের ছিল চার কোটি । সঙ্গত কারণেই শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিশ-মিলিটারি, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা সবকিছুতই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অংশ গ্রহণের পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার কথা । কিন্তু হলো না ।
দেখা গেল সবকিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগ ছিল শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। বাজেটের ৭৫% ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে । ২৫% ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে । কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাজস্ব আয় ছিল শতকরা ৬২ ভাগ । সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে । পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যের সংখ্যা ছিল ২৫ গুণ বেশি । সেনা বাহিনীতে যে কিছু সংখ্যক বাঙ্গালি নেওয়া হতো তাদের বেশির ভাগই নেওয়া হতো টেকনিক্যাল ক্ষেত্রে । সেনা নেতৃত্বে বাঙ্গালীরা যেন আসতে না পারে, সে জন্যে এ ব্যবস্থা ।
বস্তুত কায়েম হওয়ার পর নিখিল পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাস, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস ।
রাজনৈতিক অসমতাঃ
জনসংখ্যার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের বৃহত্তর অংশ হওয়া সত্ত্বেও দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তান কুক্ষিগত করে রাখে । জনসংখ্যার ভিত্তিতে ক্ষমতার বন্টন পূর্ব পাকিস্তানের অনুকূল হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তান “এক ইউনিট তত্ত্ব” নামে এক অভিনব ধারণার সূত্রপাত করে । এ ব্যবস্থায় সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান একটি প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত হয় । এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের ভোটের ইঞ্জিনিয়ারিং ।
একেবারে শুরু থেকেই পাকিস্তানে শাসনের নামে ষড়যন্ত্র শুরু হয়, আর এ ষড়যন্ত্রে মূল ভূমিকা পালন করে সামরিক বাহিনী । যখনই পূর্ব পাকিস্তানের কোনো নেতা, যেমন খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুড়া, অথবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতেন, তখনই পশ্চিম পাকিস্তানীরা কোনো না কোনো অজুহাতে তাদের পদচ্যুত করত । নানারকম টালবাহানা করে জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করে নেন এবং দীর্ঘ ১১ বছর ধরে পাকিস্তানে তার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালু থাকে । পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের এ অনৈতিক ক্ষমতা দখল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়েই চলে ।
ছয় দফাঃ স্বায়ত্বশাসনের দলিল
১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করলেন পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান । এটি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের রূপরেখা । আসলেই ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সবকরম অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়ন থেকে মুক্তির এক অসাধারণ দলিল । ছয় দফা দাবি করার সাথে সাথেই আওয়ামী লীগের নেতাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পুরানো হলো। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে দেশদ্রোহিতার মামলার প্রধান আসামি করা হলো । বাঙালিরা ফুঁসে উঠলো । সারা পূর্ব বাংলায় আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। জেল-জুলুম, পুলিশ, ইপিআর-এর গুলি কোনো কিছুই সেই আন্দোলনকে থামিয়ে রাখতে পারলো না ।
সেই সময় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিল ছাত্ররা । তাদের ছিল এগারো দফা দাবি । মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও এগিয়ে এলেন । দেখতে দেখতে সেই আন্দোলন একটি গণবিস্ফোরণে রূপ নিল ।
গণ অভ্যুত্থানঃ
এরই জের ধরে ৬৯-এ হয় গণ অভ্যুত্থান । ৬৯-এর গণআন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিল কিশোর মতিউর, প্রাণ দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ । তার নামে হয় আসাদ গেট । আগে এ স্থানটির নাম ছিল আইয়ুব গেট । পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সহ সব নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো । প্রবল পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট আইয়ুর খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নিল ।
পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনঃ
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এলেন । পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দেবার ঘোষণা দিলেন । ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন ঠিক হল । ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের উপকূল এলাকায় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে । প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দশ লাখ লোক মারা গেল । এত বড় একটি ঘটনার পর পাকিস্তানের সরকার এগিয়ে এলো না সে রকম গুরুত্ব দিয়ে । ঘূর্ণিঝড়ের পরেও যারা কোনোভাবে বেঁচে ছিল তাদের অনেকে মারা গেল খাবার আর পানির অভাবে । এ অবহেলা আর নিষ্ঠুরতায় পূর্ব বাংলার মানুষের মন ভেঙ্গে গেল ।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সারা পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো । নির্বাচনের ফলাফল হলো, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মাঝে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি, পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পিপল্স পার্টি ৮৮টি এবং অন্যান্য সব দল মিলে পেয়েছে বাকি ৫৮টি আসন।
ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে নকশাঃ
এ সময়ে একদিন জুলফিকার আলী ভুট্টো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে লারকানায় ‘পাখি শিকার’ করতে আমন্ত্রণ জানাল। ‘পাখি শিকার’ করতে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে যোগ দিল পাকিস্তানের জেনারেলরা । ক্ষমতা বাঙ্গালীদের নিকট হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্রের নীল নকশা সম্ভবত সেখানেই তৈরি হয়েছিল ।
ইয়াহিয়া খান ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করল ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে । ঠিক দুই দিন আগে ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিল । পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লো ।
উত্তাল মার্চঃ
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে গেছে, ঘোষণাটি যখন রেডিওতে প্রচার করা হয়েছে, তখন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সাথে কমনওয়েলথ একাদশের খেলা চলছে। মুহূর্তের মাঝে জনতার বিক্ষোভে ঢাকা স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে একটি যুদ্ধক্ষেত্র। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট সবকিছু বন্ধ হয়ে যায় । লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমে আসে। পুরো ঢাকা শহর দেখতে দেখতে একটি মিছিলের আর শ্লোগানের নগরীতে পরিণত হয় । ‘জয় বাংলা’ ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’
একটি জগত বিখ্যাত ভাষণঃ
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন । এই ভাষণে তিনি ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই বাস্তবায়নের জন্য চার দফা দাবি পেশ করেন:
১. অবিলম্বে মার্শাল ল’ প্রত্যাহার করতে হবে।
২. সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে।
৩. নিহত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা অনুসন্ধান করতে হবে।
৪. ২৫শে মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে ।
বঙ্গবন্ধু ৫ দিনের জন্যে হরতাল ও অনিদিষ্টকালের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। তাঁর মুখের কথায় সারা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে গেল। অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্যে কারফিউ দেয়া হলো । ছাত্ররা সেই কারফিউ ভেঙে পথে নেমে এল। সেনাবাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছে তারপরেও কেউ থেমে রইল না, দলে দলে সবাই পথে নেমে এল।
২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হলো। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি নির্বাচন করা হলো। পাঁচদিন হরতালের পর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিতে এলেন।
ততদিনে পুরো পূর্ব পাকিস্তান চলছে বঙ্গবন্ধুর আঙ্গুলের ইশারায় । লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর ভাষণ শুনতে এসেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আক্ষরিক অর্থে হয়ে যায় একটি জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ঠিক এ সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান গণহত্যার প্রস্তুতি শুরু করে দিল। বেলুচিস্তানের কসাই নামে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠাল । পূর্ব পাকিস্তানের কোনো বিচারপতি তাকে গভর্নর হিসেবে শপথ করাতে রাজি হলেন না ।
১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে বসে । তাদের থামানোর জন্যে ঢাকা থেকে যে সেনাবাহিনী পাঠানো হয় তাদের সাথে সাধারণ জনগণের সংঘর্ষে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায় । ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস, কিন্তু সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট আর গভর্নমেন্ট হাউজ ছাড়া সারা বাংলাদেশে কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড়লো না। ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসাতে সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সাথে সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হলো ।
মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকঃ
সারা দেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল, তখন ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করে । অনেক আশা সত্বেও মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক সফল হল না ।
২৫ মার্চে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ভেঙে গেলে ইয়াহিয়া গোপনে ইসলামাবাদে ফিরে যান সামরিক বাহিনীকে বাঙ্গালি নিধনযজ্ঞের সবুজ সংকেত প্রদান করে । সামরিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলে গেলেন, “তিরিশ লক্ষ বাঙ্গালিকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে” ।
পাকিস্তানি বাহিনী সে রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালায় নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর ।
গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তানি সেনারা সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুসহ তার পাঁচ বিশ্বস্ত সহকারীকে গ্রেফতার করে।
গণহত্যা ও জনযুদ্ধের সূত্রপাতঃ
২৫শে মার্চ রাতের পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট নামের গণহত্যাযজ্ঞের পর বাঙ্গালীদের প্রতিরোধ যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো বিকল্প রইলো না । শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
অস্থায়ী সরকার গঠনঃ
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার -এর আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগর) গ্রামে । শেখ মুজিবুর রহমান এর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠন করা হয় ।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদ এর উপর। বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের সামনে শপথ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করে । এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ২৬ মার্চ হতে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় ।
আগস্টের পরপরই বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসরদের ওপর হামলা চালাতে থাকে ।
মনে রাখতে হবে, মার্চের শেষদিক হতেই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশেষভাবে তাদের রোষের শিকার হয় । দলে দলে মানুষ ভারত সীমান্তের দিকে পালাতে শুরু করে। এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া শরণার্থীদের এ স্রোত নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এবং এ সময়ে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে ।
এদিকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে বাংলাদেশকে সর্বমোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং পাকিস্তান আর্মি থেকে পালিয়ে আসা অফিসারদের মধ্য থেকে প্রতিটি সেক্টরের জন্যে একজন করে কমান্ডার নির্বাচন করা হয় ।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধঃ
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ে যে উপায়ন্তর না দেখে ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করতে তারা ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় রেডিও পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত এক বিশেষ সংবাদ প্রচার করে যে ‘ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে ।
এর পর পাঁচটা ৯ মিনিটে পেশোয়ার বিমানবন্দর থেকে ১২টি যুদ্ধবিমান উড়ে যায় কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অনন্তপুরের উদ্দেশ্যে এবং সারগোদা বিমানঘাঁটি থেকে আটটি মিরেজ বিমান উড়ে যায় অমৃতসর ও পাঠানকোটের দিকে । দুটি যুদ্ধবিমান বিশেষভাবে প্রেরিত হয় ভারত ভূখণ্ডের গভীরে আগ্রার উদ্দেশ্যে । মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় আক্রমণে।
৩রা ডিসেম্বর বিকেলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাদানকালে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানের উল্লিখিত বিমান-আক্রমণ শুরু হয় । অবিলম্বে তিনি দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন ।
মধ্যরাত্রির কিছু পরে বেতার বক্তৃতায় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বলেন, এতদিন ধরে “বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।” ভারতও এর জবাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাদের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের হামলা প্রতিহত করে । ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে যৌথবাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে । ভারত যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় যৌথবাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় ।
পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বিজয়ঃ
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেঃ এ. এ. কে নিয়াজী হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে । প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান । বাংলাদেশের মানুষের বহু আকাঙ্খিত বিজয় ধরা দেয় যুদ্ধ শুরুর নয় মাস পর ।
উল্টোপথের দেশদ্রোহীরাঃ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে যে সব দেশদ্রোহী সাহায্য করেছিল তারা হল, কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খয়েরউদ্দিন, কনভেনশন মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী, কাইয়ূম মুসলিম লীগের খান এ সবুর খান, জামায়াতে ইসলামীর গোলাম আযম এবং নেজামে ইসলামীর মৌলভী ফরিদ আহমেদ।
বিশ্বাসঘাতকরা সর্বশক্তি দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে । তারা রাজাকারবাহিনী তৈরি করে । এছাড়া আলবদর ও আলশামসের নামেও তারা দুটি দল তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিকূলে । এরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর যে অত্যাচার এবং নির্যাতন করেছে তার অন্য কোনো নজির নেই।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের মানুষকে চিনত না । আলবদর, আলশামস, রাজাকাররাই তাদেরকে পথ দেখিয়েছে ।
শেষ সময়ে জাতিকে মেধাশূণ্য করার পদক্ষেপঃ
পরাজয় যখন নিশ্চিত তখন ভবিষ্যতে বাঙ্গালি জাতি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্যে দেশের সূর্য সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় মেতে উঠে তারা । বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত আলবদর বাহিনীতে ছিল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য চৌধুরী মইনুদ্দিন, আশরাফুজ্জামান খান, মতিউর রহমান নিজামী (পূর্ব পাকিস্তান আলবদর সর্বাধিনায়ক) এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ (পূর্ব পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংগঠক)।
গণহত্যার পরিসংখ্যানঃ
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার । মিলিশিয়া বাহিনী ছিল প্রায় ২৫ হাজার । বেসামরিক বাহিনী প্রায় ২৫ হাজার । রাজাকার, আলবদর, আলশামস আরো ৫০ হাজার। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ পচাঁত্তর হাজার । যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ভারতীয় সেনা মিত্রবাহিনী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়।
যুদ্ধ শেষে আত্মসমর্পণের পর প্রায় একানব্বই হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী ভারতে স্থানান্তর করা হয়। যুদ্ধ চলাকালে প্রায় আড়াই লক্ষ নারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর তাদের পদলেহী বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহীদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা চলাকলে কতজন মানুষ মারা গিয়েছে সে সম্পর্কে গণমাধ্যমে বেশ কয়েক ধরনের সংখ্যা রয়েছে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড আলমানাকে সংখ্যাটি ১০লক্ষ, নিউইয়র্ক টাইমস (২২ ডিসেম্বর ১৭৭২) অনুযায়ী ৫ থেকে ১৫ লক্ষ, কম্পটনস এনসাইক্লোপিডিয়া এবং এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা অনুযায়ী সংখ্যাটি ৩০ লক্ষ। প্রকৃত সংখ্যাটি কত, সেটি সম্ভবত কখনোই জানা যাবে না। তবে বাংলাদেশের এই সংখ্যাটি ৩০ লক্ষ বলে অনুমান করা হয়।
লেখক-গোলাম সারোয়ার
গবেষক ও কলামিস্ট।