মোহাম্মদ সেলিম *
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া-বাড়বকুণ্ডের উপকুলীয় এলাকায় প্রচুর ধান-রবিশস্যসহ বিভিন্ন ফসলের বাম্পার ফলন কৃষকদের মুখে হাসি ফোটতো সারাবছর। কৃষকের সেই শতশত একর ধানি ও বিভিন্ন ফসলের জমি এখন এলপিজি গ্যাস ফ্যাক্টরীর মালিক ও ভূমিদস্যুদের কব্জায় চলে গেছে। স্থানীয় দালাল ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে শতশত কৃষকের ফসলী জমি দখলে নিয়ে শুধু ক্ষান্ত নয়; এখন রাস্তা, খাল-নালা দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। গ্রামীণ শান্ত জনপদ বাড়বকুণ্ডের একমাত্র মান্দারিটোলা সড়কেই এখন প্রতিদিন সিলিন্ডারবাহী হাজারো ট্রাক-লরীর বেপরোয়া পদচারণায় বসবাসকারী সবমানুষের চলাচলে চরম ব্যাঘাতসৃষ্টিসহ শব্দদূষণ ও পরিবেশের মারাত্বক ক্ষতিসাধন করলেও জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন সম্পূর্ণ নির্বিকার।
কৃষকের ধানী জমি দখলে নিয়ে কোনো ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান না করার জন্যে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বিভিন্নস্থানে শিল্পজোন তৈরি করে দিচ্ছেন। আবাদী জমিতে শিল্পকারখানা নির্মাণ না করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী বারবার বলে আসছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনাকে উপক্ষো করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের দেড়/দুই কিলোমিটার পশ্চিমে বাঁশবাড়িয়া ও বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নে বিগত এক দশকে হাজার হাজার একর আবাদী জমি শিল্পপতি ও ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়েছে।

বাঁশবাড়িয়ার উপকূলীয় এলাকার কৃষকের বেশিরভাগ ধানী জমি বসুন্ধরা গ্রুপের দখলে। অয়েল এন্ড গ্যাস প্ল্যান্ট নির্মাণের নামে সহজসরল কৃষকের শুধু ধানী জমি নয় জোরপূর্বক বাড়িঘর-পুকুর ও জনসাধারণের চলাচলের রাস্তা জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহায়তায় সমুদ্রের মাটি দিয়ে ৮/১০ফুট উঁচু করে ভরাট করে সশস্ত্র আনসার বাহিনীর প্রহরায় দখল করে আছে।
বাঁশবাড়িয়ার আবাদী জমি বুসন্ধরা গ্রুপের কব্জায় চলে যাওয়ার পর অন্যশিল্পপতিরা উত্তরপাশের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের কৃষকের ধানীজমি দখলের প্রতিযোগিতা শুরু করেন প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজসে। ১০-১২ টি এলপিজি গ্যাস প্ল্যান্ট নির্মাণের নামে কৃষকের শতশত একর ধানী ও ফসলী জমি দখলের মহোৎসব চলছে এখানে। জনবসতি এলাকার প্রায় এক-দেড়কিলোমিটার পশ্চিমে একদশকের মধ্যে স্থাপিত হয়েছে বিএম এনার্জি (বিডি) লিমিটেড, জেএমআই ইন্ডস্ট্রিয়াল গ্যাস লিমিটেড,ইউনিটেক্স এলপি গ্যাস লিমিটেড, ইউরো গ্যাস এলপিজি ও ইউনিভার্সেল গ্যাস। এর মধ্যে জেএমআই উপকূলীয় বেড়িবাঁধের পশ্চিমে নদীর কিনারায় আর বাকীগুলো বেড়িবাঁধের পূর্বে সম্পূর্ণ আবাদী জমি দখলে নিয়ে গড়ে ওঠেছে। এগুলো ছাড়াও আরও ৫/৬টি এলপিজি গ্যাস প্ল্যান্ট নির্মাণের নামে ইতোমধ্যে শতাধিক একর আবাদী জমি দখলে নিয়ে তা অবৈধভাবে সমুদ্রের মাটিবালি দিয়ে ৫/৬ফুট উঁচু করে ভরাট করেছে।
সম্প্রতি বাড়বকুণ্ড উপকূলীয় ও জনপদে সরেজমিনে দেখতে গিয়ে ভুক্তভোগি এলাকাবাসীর প্রতি ভয়াবহ শোষণ ও বঞ্চণা এবং নানা দুর্ভোগের চিত্র ওঠে আসে।
নির্মিত এলপিজি গ্যাস প্ল্যান্টগুলোর প্রত্যেকের ৩/৪করে হেভি ক্যাপাসিটার ট্যাঙ্ক স্থাপন করেছে। যে গ্যাস সাগর পথে বিদেশ থেকে জাহাজে করে এনে এসব ট্যাংঙ্কে মজুদ করা হয়। গত ৪জুন বিএম কনটেইনার ডিপোর ছোট ড্রামের বিষাক্ত গ্যাস বিষ্ফোরণে তিনশতাধিক হতাহতের পর আতঙ্ক আরো বড় করে দেখা দিয়েছে এলাকায় বসবাসকারী সব মানুষের মধ্যে। জেলা-উপজেলা প্রশাসন,জ্বালানী মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর এলাকার কৃষকের শেষসম্বলটুকু আবাদী জমি দখলে নিয়ে কীভাবে জনবসতি এলাকার কাছাকাছি কোন্ যুক্তিতে এসব গ্যাসপ্ল্যান্ট স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসী বলছে, এসব গ্যাসপ্ল্যান্ট নির্মাণ করতে হয় চরাঞ্চলের অনাবাদী জমিতে। কিন্তু ছোট্ট আয়তনের এ জনপদে ধানী জমি দখলে নিয়ে গ্যাসপ্ল্যান্টের মধ্যে বিধ্বংসী ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে এলাকাবাসীর জন্যে মরণঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব প্ল্যান্টের গ্যাসভর্তি ছোটছোট সিলিন্ডার ও গ্যাসট্যাঙ্ক সরবরাহের জন্যে এক হাজারের মতো ভারি যানবাহন প্রতিদিনই চলাচল করছে এলাকাবাসীর একমাত্র চলাচলের পথ মান্দারীটোলা সড়ক দিয়ে। বিগত ৬/৭ বছর রাত দিন সমানে চলছে গ্যাস সিলিন্ডার ও ট্যাঙ্কবাহী ট্রাক ও লরি। যানবাহনগুলোর পদভারে ভেঙ্গেচুরে রাস্তাটিকে জমিনের সাথে মিশে ফেলা হয়। পুরো বর্ষাকালে এলাকাবাসীর চলাচলের এ সড়কটি ভেঙ্গেচুরে কাদামাটিতে থৈথৈ করতো আর শুষ্কমৌসুমে ধুলাবালিতে ডুবে গিয়ে ঝুঁকিুপূর্ণ এক বিষাক্ত পরিবেশ চেপে বসে এলাকাবাসীর ললাটে। গত ৭/৮ মাস ধরে গ্যাস ফ্যাক্টরীর মালিক ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে মান্দারীটোলা সড়কটি পিচঢালাইয়ের উদ্যোগ নেয়। ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের বাড়বকুণ্ড বাজারের দক্ষিণ পাশ থেকে পশ্চিমে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত ঘনবসতি এলাকার সড়কটির নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। সড়কে ব্রিজ নির্মাণ করার সময় কয়েক মাস যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলেও গত তিন সপ্তাহ ধরে মান্দারীটোলা সড়ক দিয়ে যানবাহন ফের শুরু হয়েছে।
গ্রামীণ জনপদের বেড়িবাঁধ পর্যন্ত মান্দারিটোলা সড়ক এলজিইডি ও শিল্পমালিকরা যৌথভাবে নির্মাণ করতে গিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো এটিকে সম্প্রসারণ করছে। সড়কের দক্ষিণ পাশের প্রায় এককিলোমিটার রিটার্নিং ওয়াল দিয়েছে কামানিয়া খালের প্রায় মাঝখানে।শিল্পমালিকরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ইচ্ছেমতো সড়কের দুইপাশ নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ভরাট করে নিচ্ছে- এমন অভিযোগ কামানিয়া খালের আশপাশের কৃষকদের।

বাড়বকুণ্ডের অলিনগর এলাকার ৭৩বছর বয়সী কৃষক ও কামানিয়া খালের পাশের সওদাগর নুরুল ইসলাম চাটগাঁর বাণীকে ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘বর্ষার পানি নিষ্কাশন ও চাষাবাদের সুবিধার্থে কামানিয়া খাল সংস্কার করে সম্প্রসারণ করার কথা কিন্তু শতবছরের পানি চলাচলের এ খালটির প্রায় মাঝখানে ওয়াল দিয়ে রাস্তা দ্বিগুন বাড়িয়ে খাল সঙ্কুচিত করে ফেলা হয়েছে।’ এদিকে মান্দারিটোলা সড়কের একেবারেই গা ঘেষেই গ্রামের মাঝখানে জনবসতি এলাকায় জেএমআই গ্রুপ নির্মাণ করেছে জেএমআই সিলিণ্ডার ও জেএমআই শাঙ্কুর অটো ট্যাঙ্ক ফ্যাক্টরী। প্রতিদিন এসব ফ্যাক্টরির কাঁচামাল হিসেবে শতশত ট্রাকে করে আনা প্লেনশীট লোড আনলোডিং, প্লেট কাটা ও গ্যাস নিঃস্বরণের প্রচণ্ড শব্দে জনজীবন অতীষ্ঠ হয়ে উঠছে। আর এলাকার মানুষের চলাচলের সড়ক দখল করে প্রতিদিন অসংখ্য ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ফ্যাক্টরীর সামনের বাসিন্দা মো. ইসলাম সওদাগর ক্ষোভের সাথে চাটগাঁর বাণীকে বলেন, ‘ফ্যাক্টরীতে প্লেটকাটার সময় ভূমিকম্পের মতো বাড়িঘরসহ সমস্ত জিনিসপত্র কেঁপে ওঠে। আর এখানে পুরোরাস্তা দখল করে ভারি যানবাহনগুলো সার্বক্ষণিক চলার কারণে ছেলে-মেয়েরা রাস্তায় ওঠতে পারে না। সবসময় এক মহাআতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছি বাপদাদার ভিটেমাটিতে। এসব ফ্যাক্টরিগুলো আমাদের এলাকাবাসীর জন্যে প্রতিদিনের বাড়তি অসহ্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
মান্দারিটোলা সড়কটির পিচঢালাই পূর্বদিকের গ্রামীণ সাইডের কাজ শেষ হওয়ার পর এখন পুরোদমে প্রতিদিন সিলিন্ডারবাহী হাজারো ট্রাক-লরি বেপরোয়া গতিতে সার্বক্ষণিক চলাচলের কারণে এলাকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ চরম ভোগান্তি হজম করে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। গ্রামের সর্বস্তরের মানুষের চলাচলের প্রধান মান্দারিটোলা সড়কটি যানবাহনের দখলে থাকায় এলাকাবাসী সড়কটি দিয়ে চলাফেরার কোনো পরিবেশ নেই। দুটি গাড়ি একসাথে ক্রসিং হওয়ার সময় পথচারিদের রাস্তার ধারেকাছেও টিকে থাকা দায় হয়ে ওঠে। বর্ষাকালে গাড়ির চাকা থেকে প্রতিনিয়ত ময়লা ও বিভিন্ন ছোটখাটো পাথর ছিটকে পথচারীদের গায়েপড়া, শুষ্কমৌসুমে ধুলোবালির গজব সৃষ্টি, উচ্চস্বরে গাড়ির হর্নবাজানোসহ শব্দ দূষণের মাধ্যমে এখানকার পরিবেশ সবসময় ভারি হয়ে আছে। সার্বক্ষণিক ধুলোবালি ও উচ্চস্বরে হর্নবাজানোর কারণে অজান্তেই শিশুদের বধির ও স্বাস্থ্যহানির ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ও বিপর্যয়ের মধ্যে আছে এ সড়কে চলাচলকারী নূরানী মাদ্রাসা, মান্দারীটোলা ও মাহমুদাবাদ উচ্চবিদ্যালয়ের শতশত কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। স্কুল-মাদ্রাসায় পাঠিয়ে মা-বাবারা থাকেন চরম উৎকণ্ঠায়।

সরেজমিনে দেখতে গিয়ে,মান্দারিটোলা সড়কে কিছুদূর পায়ে হেঁটে হাড়েহাড়ে টের পেলাম এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে কথা বলে এবং পরিবেশের নানামুখি বিপর্যয়ের চিত্র দেখে। পিচঢালা সড়কে ১০/১৫ মিনিট হাঁটার পথে বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি, তারা সবাই শিল্পমালিকদের প্রতি চরমভাবে অসন্তোষ্ট।
আরও কয়েকমিনিট হাঁটার পর সড়কের পাশে পড়ন্ত বিকেলে কয়েকটি দোকান খোলা দেখে সামনে বসা নুর আলম নামে প্রায় ৬৫বছর বয়সী মানুষটির সাথে সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি চাটগাঁর বাণীকে বলেন, শহর বন্দরে চাকরি করে অবসর জীবনে নিজের গ্রামে এসে এক মহাযন্ত্রণায় আছি পরিবার পরিজন নিয়ে। শুধু আমি নই গ্রামের হাতেগোনা কিছু দালালছাড়া সবারই একই অবস্থা। এমন উদ্বেগের কথা বলতে শুরু করলে আশপাশের বহু মানুষ জড়ো হন। সবাই একই সুরে বললেন,‘ আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেতে ভয় পায় গ্যাস সিলিন্ডারবাহী যানবাহনের ভয়ে।’ এসময় সংবাদকর্মী হিসেবেও আমি একটারপর একটা সিলিন্ডারবাহী ট্রাক-লরি ও গ্যাস ফ্যাক্টরির মালিক পক্ষের কয়েকটি প্রাইভেটকার পাজেরোর বেপরোয়া গতিতে চালানো ও হর্ণবাজানোর বেসামাল পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করলাম।
এসময় ভূক্তভোগি এলাকাবাসিরা ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘একনাগারে চলা শতশত যানবাহনের দাপটে গৃহপালিত পশু গরু-ছাগল নিয়ে আমরা বিল – ক্ষেতখামারে যেতে পারিনা, রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটলে ও পার হতে চাইলে অনেকের গায়ে কাদামাটি, পাথর ছিটকে গায়ে পড়ছে, আহত হচ্ছে অনেকেই। গত একছর আগে ফিরোজা আক্তার নামে ২সন্তানের জননী বেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারান। আর ফ্যাক্টরিগুলোর মালিক পক্ষের প্রাইভেটকার ও পাজেরোগুলো আরও ভয়ঙ্কর। বেপরোয়া গতিতে এরা উচ্চস্বরে হর্ন বাজিয়ে আমাদের চলাচলের গতিপথ জিম্মি করে চলাচল করছে। এলাকার স্বার্থে কিছু বললে কোনো বিশৃংখলার প্রতিবাদ করলে পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে যায়, জেল খাটায়।’
এলাকাবাসীর পক্ষে নুর আলম আরও বলেন, ‘নানা কৌশল ও চাকরির লোভ দেখিয়ে এলাকার আবাদী জমিতে শিল্পকারখানা স্থাপন করলেও স্থানীয় লোকজনের তেমন কর্মসংস্থান নেই বললে চলে। এসব কারখানার মাধ্যমে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে বেশি। তিন-চার গ্রামের পানি চলাচলের কামানিয়া খালের প্রায় মাঝখান বরাবর ওয়াল দিয়ে রাস্তার জন্যে দখল করে নিয়েছে। শিল্পমালিকরা পশ্চিমে আরও কয়েকটি ছড়া ভরাট করে ফেলেছে। সমুদ্রমুখি পানি নিষ্কাশনের পথ বিনষ্ট হয়ে ভারি বর্ষণে এলাকার বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ে, জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়ে চাষাবাদের ক্ষতি হচ্ছে।’

এদিকে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিষ্ফোরণের পর বাড়বকুণ্ড অধিবাসীদের অনেকেই এলপিজি গ্যাস প্ল্যান্টগুলোর গ্যাস মজুদের বড়বড় ট্যাঙ্কগুলোর ব্যাপারে প্রতিবাদমুখর হয়ে নিজেদের ফেসবুক ফেইজে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সমাজসেবক লায়ন মো. গিয়াস উদ্দীন (ট্যাঙ্কগুলোর ছবিসহ প্রদর্শন করে ) লিখেছেন ‘বাড়বকুণ্ডের এলপি গ্যাস কারখানাগুলোতে এ মৃত্যুকূপগুলো কি ভয়াবহ! বিস্ফোরণ হলে সীতাকুণ্ড থাকবে ? এ গুলো কি মাটির নিচে দেয়া যায় না ?
ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন লিখেছেন, বাড়বকুণ্ডের সমুদ্রপাড়ে আবাদী জমিতে গ্যাসবোমা স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে এখনি ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখতে হতে পারে, তাই সাধু সাবধান।’
এ প্রসঙ্গে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্ল্যাহ মিয়াজী চাটগাঁর বাণীকে বলেন, ‘এলজিইডি রাস্তাটি নির্মাণ করেছে। গ্যাস ফ্যাক্টরীর মালিকরাও এতে সহযোগিতা করেছেন। কামানিয়া খালের প্রায় মাঝখানে ওয়াল দেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ার রাস্তাটির সুরক্ষার জন্যে সীট দিয়ে মেপে খালের পাশে রিটার্নিং ওয়াল দেয়া হয়েছে। এসময় এসি ল্যান্ড ও সীতাকুণ্ড ইউএনও সাহেব ছিলেন।’
সড়ক বর্ধিতকরণের জন্য কামানিয়া খালের প্রায় মাঝবরাবর রিটার্নিং ওয়াল দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম চাটগাঁর বাণীকে বলেন, ‘খালটি দিয়ে আশপাশের এরিয়ার যেসব পানি নিষ্কাশন হয় ওয়াল দেয়ার পরও পানি প্রবাহে কোনো সমস্যা হবে না। এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ার সড়কের সীমানা মেপে বুঝিয়ে দেয়ার পর রাস্তার ভিত্তি মজবুতের জন্যে রিটার্নিং ওয়াল দেয়া হয়।’

খালের প্রায় অর্ধেক দখলে নিয়ে মাঝখানেই রিটার্নিং ওয়াল দেয়া কারও এখতিয়ার আছে কী না জানতে চাইলে তিনি এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ার সীতাকুণ্ডের সাথে কথা বলতে হবে বলে জানান। এসময় মোবাইলে ফোন দিয়ে কথা বলার চেষ্টাও করেন, তবে তিনি ইঞ্জিনিয়ারকে পাননি মোবাইলে।
জনবসতি এলাকার কাছাকাছি ও আবাদী জমি ভরাট করে কীভাবে এলপিজি গ্যাস ফ্যাক্টরিগুলো স্থাপিত হলো এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার চাটগাঁর বাণীকে বলেন, ‘জনবসতি বলতে একসাথে ৫০টির মতো পরিবার থাকতে হবে, যেখানে গ্যাসপ্ল্যান্ট বসানো হয়েছে সেখানকার কাছেধারে মাত্র ২/৩টি পরিবার আছে, এখানে অনাবাদি জমি নেই কিন্তু শিল্পায়নেরও প্রয়োজন আছে উল্লেখ করে উপপরিচালক আরও বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরসহ আরও সংশ্লিষ্ট দপ্তর সরেজমিনে পরিদর্শন করে এসব স্থাপনা বসানোর অনুমতি দিয়েছে। তারপরও এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে জ্বালানী মন্ত্রণালয় এমন পরামর্শও দেন এ কমকর্তা।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিষ্ফোরক পরিদপ্তরের উপপ্রধান বিষ্ফোরক পরিদর্শক ড. আব্দুল হান্নান মুঠোফোনে চাটগাঁর বাণীকে বলেন, এসব স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে জেলাপ্রশাসকের সুপারিশক্রমে আমরা অনুমতি প্রদান করে থাকি।’
আমরা নিরীহ অধিদপ্তর উল্লেখ করে এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সরেজমিনে পরির্দশন ও অনুমতিছাড়া এতোবড় স্থাপনা কেউ নির্মাণ করবে বলে আমি মনে করি না।’
বিষ্ফোরক পরিদপ্তর সরেজমিনে পরিদর্শন করে গ্যাসপ্ল্যান্ট স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে কী-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই পরিদর্শন করা হয়েছে। গ্যাসট্যাঙ্ক ক্যাপাসিটি অনুযায়ী গ্যাস মজুদ রাখলে ঝূঁকি থাকার কথা নয়; আর এখানে উপকূলবর্তী এলাকায় গ্যাসপ্ল্যান্ট স্থাপনের ফেজিবেলিটি আছে বলে এখানে পারমিশন দেয়া হয়েছে। ’
এদিকে সোনাইছড়ির বিএম কন্টেইনার ডিপোর প্রায় এক/দেড় কিলোমিটার উত্তরে প্রিমিয়ার এলপি গ্যাস লিমিটেড ( টোটাল গ্যাস) । এর বিশাল বিশাল গ্যাসট্যাঙ্ক নিয়ে আশপাশে বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। টোটাল গ্যাস ট্যাঙ্কগুলোর খুব কাছেই অবস্থিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন ও ছাত্রহোস্টেল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় বার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ও পাঁচশ’ শিক্ষকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারিরা আতঙ্কের মধ্যে আছেন।

এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর একেএম আক্তারুজ্জামান (কায়সার) চাটগাঁর বাণীকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা পুরোপুরি ঝুঁকির মধ্যে আছি, টোটাল গ্যাস কর্তৃপক্ষ গ্যাসপ্ল্যান্টে পর্যাপ্ত সিকিউরিটি ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা আছে বললেও আমাদের খুব টেনশনে থাকতে হচ্ছে’। এ ব্যাপারে টোটাল গ্যাসের জিএম মোহাম্মদ সবুর এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাড়বকুণ্ড কৃষকের ধানী জমি ভরাট করে জনবসতি এলাকার সন্নিকটে এলপিজি গ্যাসপ্ল্যান্ট কীভাবে গড়ে ওঠা সম্ভব এব্যাপারে চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান এর কাছে মুঠোফোনে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি চাটগাঁর বাণীকে বলেন, ‘সরকারের কাজগুলো দেখার জন্য আলাদা আলাদা বিভাগ আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক আছে, আমরা মনিটরিং করি, কিছু অঘটন হলে দায় পড়ে আমাদের গায়ে।’ তিনি বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস প্ল্যান্ট এর ব্যাপারে কেউ যদি লিখিত অভিযোগ দেন আমরা তা দ্রুত উচ্ছেদ করে দেবো।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন এর কাছে বাড়বকুণ্ডের গ্যাস প্ল্যান্ট এর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জনবসতি এলাকায় এগুলো কীভাবে অনুমতি পায় উদ্বিগ্ন হয়ে পাল্টা এমন প্রশ্ন রাখেন। তিনি বলেন,‘আমি খবরা-খবর নিচ্ছি, অনুমোদন না থাকলে নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’
বাঁশবাড়িয়া ও বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের আবাদি জমি প্রায় গিলে খাওয়ার পর শিল্পপতিরা এখন পাশের সর্ববৃহৎ মুরাদপুর ও সৈয়দপুর ইউনিয়নের কৃষকের ধানী ও ফসলীজমিগুলো দখলে নিতে জোরেশোরে তৎপরতা চালাচ্ছেন। নানা প্রলোভনের মাধ্যমে সহজসরল কৃষকের শেষসম্বল আবাদী জমি দখলে নিতে শক্তিশালী দালাল হিসেবে কাজ করছে জনপ্রতিনিধিরা।
লেখক- সম্পাদক, চাটগাঁর বাণী
