মো. আবুল হাসান/ খন রঞ্জন রায় * এখন যৌবন যার আত্মকর্মে স্বনির্ভর হবার সময় তার। যুবরাই দেশের প্রাণশক্তি এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধান হাতিয়ার। সুখী-সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়তে সুশৃঙ্খল ও প্রশিক্ষিত যুবশক্তি একান্ত অপরিহার্য। গত ১২ বছরে বিশ্বে মানুষ বেড়েছে ১০০ কোটি। আগামী ১৩ বছরে যোগ হবে আরো ১০০ কোটির বেশি। জাতিসংঘের ২০১৭ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বিশ্বে মানুষের সংখ্যা ৭৬০ কোটি। বিশ্বে বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ তরুণ, যারা দেশ তথা বিশ্বকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তরুণ সমাজের বৃহৎ একটি অংশ যুব।
বর্তমানে বিশ্বে ২ শত কোটির বেশি যুবক রয়েছে। ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত তরুণ ধরলে কিশোর-তরুণের সংখ্যা গড়ে তিনশ’ কোটি। তরুণ, শিশু, কিশোর মিলে বিশ্বের এ ৩০ শতাংশ মানুষকে নৈতিক, আধুনিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে বিশ্ব পরিস্থিতি অস্থির হবে তা নিশ্চিত।
আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে সে সময়কার তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী এমনকি কিশোর-কিশোরীরা সারা দেশে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাভাবনা নিয়ে চষে বেড়িয়েছে। ইউরোপের শিল্প বিপ্লব তরুণদের মেধা ও শ্রমে অগ্রগ্রামী হয়েছে। শুধু তা নয় তারা মানুষকে সংগঠিত করেছে, ঐক্যবদ্ধ করেছে, এমনকি একের পর এক ধারাবাহিক বিজয় অর্জন করেছে। সে সময়কার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পূর্ণতা এখন ইতিহাস।
বর্তমান বিশ্বে বিপথগামী লোকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আগে সমগ্র বিশ্বে বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা বছরে দু’একবার শোনা গেলেও এখন তা হরহামেশা। অবস্থা উত্তরণে শিশু-কিশোরদের সুন্দর ও সুশৃঙ্খল পথ দেখানো সকলের কর্তব্য। অপরাধ থেকে পরিবারের কিশোরটিকে দূরে রাখতে সবসময় তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য। বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতি মিনিটে অন্তত ২০ জন মানুষ ঘরবাড়ি, দেশ সব ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও। বেছে নিচ্ছে অনিশ্চিত গৃহহীন জীবন। একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের সুফল জনগণ তখনই ভোগ করতে পারে যখন সেখানে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করা হয়। বর্তমান চিন্তার নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বিষয়টিও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।
সাধারণত দেখা যায়, যেখানে বস্তি গড়ে উঠে সেখানে শিক্ষার সুযোগ থাকে না। শিক্ষার পরিবেশ তো নয়ই। বস্তিবাসীদের অধিকাংশই নিরক্ষর। সন্তানকে লেখাপড়ায় সাহায্য করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বর্তমানে যারা বস্তিতে রয়েছে তাদের সন্তানদের শিক্ষার আওতায় আনা এবং গ্রামের ভিটে মাটি ছেড়ে যেন বস্তিবাসী হবার স্রোত বন্ধ করা যায়, তার জন্য স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার তথ্য অনযায়ী, ২০১৬ সালে ৬৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ বাধ্য হয়েছে নিজেদের দেশ ছেড়ে যেতে। তাদের মধ্যে ২২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছে। এক কোটি মানুষ রাষ্ট্রহীন অবস্থায় জীবনযাপন করছে। অধিকাংশ মানুষ এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় পাড়ি দিচ্ছে। জাতিসংঘের মতে, ৫৫ শতাংশ শরণার্থী যুবক।
জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় উগ্রতা, জাতীয়তাবোধ, রাজনৈতিক আদর্শগত কারণে সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতার কারণে একজন মানুষ শরণার্থী হতে বাধ্য হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে পৃথিবীর মানুষেরা যখন ভোগ-বিলাসের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট করছে, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর জন্য চলছে মরণাস্ত্র আবিস্কার এবং অস্ত্র বাণিজ্য; ঠিক এই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ৩৩ মিলিয়নেরও বেশি যুবক খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ পিতা-মাতাহীন, কেউবা সারা জীবনের জন্য বরণ করে নিয়েছে পঙ্গুত্বকে, এখন তাদের নতুন পরিচয় ‘যুদ্ধা যুবক’। প্রতিদিন একমুঠো খাবারের জন্য তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয় লাইন ধরে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের এই যুবকদের সংখ্যার প্রায় ৫ লাখ ৩৪ হাজারের মতো, যাদের প্রত্যেকের অবস্থান এখন বাংলাদেশে।
এ বিশাল সংখ্যা শরণার্থী যুবর সাময়িকভাবে আশ্রয় ও খাদ্যের সংস্থান করা গেলেও তাদের শিক্ষা বিশেষ করে কর্মক্ষম করার শিক্ষা থেকে তারা যোজন যোজন দূরে। সমগ্র বিশ্বে ক্রমাগত উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলছে সম্পদের বৈষম্য। বেসরকারি হিসাব মতে, এখনও শতকরা ৩০ জন মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে। এর কুফল ভোগ করছে সম্ভাবনাময় যুবসমাজ। প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। বলা হয়ে থাকে, তাদের সংখ্যা প্রায় বিশ কোটি। আবার তাদের বেশিরভাগই অর্থাৎ ৫ থেকে ৬ কোটি লোকের কাজের সুযোগ পেলেও বাকিরা বেকার থাকছে। এভাবেই বেড়ে চলেছে বিশ্বব্যাপি বেকারের হার।
যুব সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপদ পরিসর (Safe Spaces for Youth)- এর প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক যুব দিবস। এবছর তরুণদের সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত করতে মানুষের জন্য, মানবতার জন্য কাজ করার এবং মানবিক মূল্যবোধ তৈরিতে সুযোগ করে দিতেই এ দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। যুবকদের জন্য এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যা হবে তাদের আগ্রহ ও স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তারা তাদের মতামত দিতে পারবে নিঃসংকোচে। যুব সম্প্রদায়ের অধিকার বাস্তবায়ন এবং নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি যদি সঠিকভাবে নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে সুশাসন প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয় না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক- সব ক্ষেত্রেই নিরাপদ ও নিশ্চিত পরিসর নিশ্চিতকরণ একটি সমৃদ্ধ কল্যাণমুখী যুব প্রজন্ম তৈরির পরিকল্পনায় অগ্রগামী হতে হবে। যুব তরুণদের এগিয়ে নিতে ডিপ্লোমা শিক্ষায় বিনিয়োগ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। যুবসমাজের কর্মসংস্থানের জন্য সহজ বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু করা দরকার। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে যুবসমাজের দারিদ্র দূরীকরণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, ছেলেমেয়ের বৈষম্য দূরা করতে পারে কর্মক্ষম হওয়ার বিশ্বস্বীকৃত ডিপ্লোমা শিক্ষায়।
এ বিশ্ব সকল মানুষের, প্রত্যেকের এখানে যুব-নারী-পুরুষ নিরাপদে, সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এখানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই সমান সমান। সকলের নিজ নিজ ধর্ম ও কর্ম করার অধিকার রাখে। কর্মের যে বন্ধন বিশ্বের সকল প্রান্তে, সবসময়, সকল অবস্থাতেই অটুট থাকে। আর কোন অন্যায়, কোন হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন কর্মক্ষমরা করে না। কোন আর্তনাদ আমরা শুনতে চাই না। আজ আমরা কত হাসি-খুশি, আনন্দে থাকার অধিকার তাদেরও আছে। চোখের সামনে রোহিঙ্গা যুবকদের কান্না দেখে দুঃখে বুক ফেটে যাচ্ছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। তাই আজ বিশ্বের সকল মানুষের কাছে বিনীত আবেদন, আসুন সকলে এক হয়ে নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়াই, তাদের শান্তি-স্বস্থি, স্ব-উদ্যোগে বাঁচার সুযোগ করে দেই।
বিশ্বের প্রতিটি দেশে স্বতন্ত্র ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হলে স্কুল লেভেল উত্তীর্ণ অবহেলিত সুবিধাবঞ্চিত যুবকদের ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশ্ব প্রযুক্তির ধারাবাহিক অগ্রগতির বিষয়সমূহ নিয়ে নতুন নতুন কর্মকেন্দ্রীক শিক্ষার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা হবে। ইনস্টিটিউটগুলোতে মর্নিং, ডে, ইভিনিং, নাইট চার শিফট শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হবে। রাজ পরিবারের আলালের দুলাল, বাসার কাজের লোক, ভিখারী, বস্তিবাসী, এতিম, পঙ্গু, যুদ্ধাহত, শরণার্থী, বাস্তুচ্যুত, নারী, মরুভূমি, দ্বীপ, উপকূলের অধিকার বঞ্চিত পথ শিশুরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে ডিপ্লোমা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবেন। ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে নতুন বিশ্ব গড়ে ওঠবে। তরুণদের মাদকাসক্ত, জঙ্গিবাদে অংশগ্রহণ ও মারামারি বন্ধ হবে। ধনী-গরিব শহর গ্রামের আয় ব্যবধান দূর হবে। আয় বৈষম্যের কারণে যে সামাজিক অস্থিরতা, তার অবসান হবে।
বিশ্বের প্রতিটি নাগরিক তাদের জন্মগত মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার সুযোগ পাবেন। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ সকল দেশে সকল অঞ্চলে সমভাবে বাস্তবে রূপ নেবে। সর্বোপরি জ্ঞাননির্ভর বিশ্ব গঠনে ভূমিকা রাখবে কর্মকেন্দ্রীক শিক্ষা কোর্সের নতুন নতুন ইনস্টিটিউটসমূহ ।
লেখকদ্বয়- সভাপতি /মহাসচিব, ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ Khanaranjanroy@gmail.com