মো. আবুল হাসান/খন রঞ্জন রায় *
ডিসেম্বর বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের মাস। ২০২০ সালে জাতি ধুমধামের সাথে পালন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি উৎসব। ১৯৭১ সালের এ ডিসেম্বরেই বাঙালি জাতির জীবনে নিয়ে এসেছিল মহান এক অর্জনের আনন্দ। সেই আনন্দ স্বাধীন হওয়ার। ডিসেম্বর আমাদের বাঙালি জাতির জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মাস। বীরত্ব প্রর্দশনে গৌরবের মাস।
স্বাধীন বাংলাদেশের এ জনপদ কখনো মোগল, কখনো পাঠান, কখনো ব্রিটিশ, কখনো পাঞ্জাব-পাকিস্তানিদের শাসনাধীন ছিল। কখনো ঔপনিবেশিকতার নিগড়, কখনো ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের করাল আগ্রাসন। তবে সব ছাপিয়ে প্রথমে ভাষার দাবিতে তারপর স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন ও সবশেষে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তির সংগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষণা। এরপর মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্ত ঢেলে দিয়ে বীর বাঙালির বিজয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ শক্রমুক্ত করার গৌরব খুব কম জাতিরই আছে। নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর বিজয়ের ১৬ ডিসেম্বর অনন্য। বিশ্বের বুকে এক নতুন ইতিহাস। বর্তমান ও ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াশীলতা, উগ্র মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদকে পরাস্ত করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই সহায়কশক্তি।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, জীবন উৎসর্গ, ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রম হারানো বেদনার ইতিহাস উৎকীর্ণ হয়ে আছে। সাথেতো প্রায় সকল পরিবারের বেদনা বঞ্চনা ত্যাগের ইতিহাস সংযোজিত আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল অনেক বড় স্বপ্ন। এদেশের প্রতিটি মানুষ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার সুযোগ পাবে। এদেশে কোন দরিদ্র থাকবে না। প্রতিটি তরুণ শিক্ষার সুযোগ পাবে। শিক্ষা গ্রহণ করে সম্মানজনক একটি কর্মসংস্থান হবে। বেকার শব্দটির উদ্ভব কিন্তু সাম্প্রতিক কল্পনাতীত মুক্তিচেতনার পরিপন্থি।
বর্তমানে যুব সমাজে তরুণদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে বিপুল পরিমাণে। তার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে বেকারত্ব। উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, নেই চাকরির সুযোগ। এর মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় শিক্ষিত বেকার বেড়েই চলেছে। এ চাপ তৈরি করছে অর্থনীতির ওপর। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় অধিক। প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই বেকারত্ব বৃদ্ধি উদ্বেগজনকভাবে।
স্বল্প শিক্ষিতের পাশাপাশি উক্ত শিক্ষিত কর্মহীনের সংখ্যাও বাড়ছে। সেই সঙ্গে ছোট হয়ে আসছে কর্মসংস্থানের পরিধি। অবস্থা এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ইঞ্জিনিয়ারিং ও এমবিবিএসের মতো সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অনেক উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী ঘুরছেন বেকারত্ব নিয়ে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ডিসেন্ট ওয়ার্ক ডিকেড: এশিয়া, প্যাসিফিক অ্যান্ড দ্য আরব স্টেট শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জনসংখ্যার মধ্যে এ ধরনের তরুণদের দিক দিয়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় খারাপ অবস্থানে আছে।
বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে অমানবিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে হাজারো কোটি তরুণযুবা। মূল কারণসমূহ হচ্ছে শ্রমিকের অদক্ষতা, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের অভাব, যুগোপযোগী ডিপ্লোমা শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাব, কৃষি, মৎস্য, পশুপালন ও পোল্ট্রির মতো লাভজনক খাতে প্রযুক্তিদক্ষ ডিপ্লোমা শিক্ষায় শিক্ষিত লোকের হাতে ন্যস্ত না করা।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে শিল্প-কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি বা সম্প্রসারণ ঘটছে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টির সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি খাতে বরাদ্দের অভাব পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার দেশে ইপিজেডের পাশাপাশি ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ শঙ্কা আশঙ্কা উদ্বেগ যে, দেশে বিশেষায়িত পেশাভিত্তিক শিক্ষিত জনবলের অভাব পূরণে পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
দেশকে বেকারত্বের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে বেসরকারি খাতে অধিকহারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা ও দক্ষ জনবলের যোগান বাড়াতে হবে। উল্লেখ করার বিষয় যে দেশি শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের চাহিদাপূরণে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় এবং চাকরি না পেয়ে শিক্ষিত তরুণরা হতাশায় নিমজ্জিত। একই সময়ে দেশে সুনির্দিষ্ট কর্মের ডিপ্লোমা শিক্ষার পরিবর্তে সাধারণ শিক্ষার জয়যাত্রা অব্যাহত থাকায় দক্ষ জনবল সরবরাহের জন্য বিদেশনির্ভর হয় ।
এটাকে আত্মঘাতী পরিস্থিতি সৃষ্টির শিক্ষা বললেও কম বলা হবে। এতে আশঙ্কা প্রকাশ পাচ্ছে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট, ডেমোগ্রাফিক ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে। জনসম্পদ উন্নয়নে বিদ্যমান এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং উন্নত পর্যায়ে উত্তরণ শুধু জরুরি নয়, অনিবার্যও বটে। এখনই যদি কর্মসংস্থানভিত্তিক ডিপ্লোমা শিক্ষাব্যবস্থা সুনির্দ্রষ্টিকরণ না হয় তাহলেও আগামী ১৫ বছরের মধ্যেই সেই দক্ষ জনবলের ডিজাস্টার নিয়ন্ত্রণহীন হবে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে দক্ষের পরিবর্তে অদক্ষ শ্রমিক পাঠানোর মাত্রা আরো বাড়বে। পরীক্ষায় পাসনির্ভর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রতিবেশী দেশগুলোর কর্মীদের তুলনায় চটপটে, পটু ও প্রায়োগিক জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া থেকে পিছিয়ে রয়েছে। এরূপ অদক্ষ, অর্ধশিক্ষিত জনসম্পদ বছর বছর তাদের চাকরির বয়স ও সক্ষমতা খুইয়ে স্থায়ী বেকারে পরিণত হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে, বিদেশিদের নিয়োগ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ঊর্ধ্ব ও মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপক, পরামর্শক, সংগঠন ও কর্মীরা এসে বাংলাদেশে বিভিন্ন আর্থিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের দক্ষ জনশক্তির অর্ধেকেরও বেশি আসে কোরিয়া, চীন, ভারতসহ বাইরের দেশ থেকে, যারা আমাদের দেশের গার্মেন্ট, সিরামিক, ঔষধ, ভৌত-অবকাঠামোসহ বিভিন্ন শিল্পে নিয়োজিত প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা এ সকল বিদেশি দক্ষ জনশক্তির পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের তুচ্ছতাচ্ছিল্লের ডিপ্লোমা শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করা গেলে দেশের মধ্যেই দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব হতো। বিদেশেও দক্ষ প্রশিক্ষিত লোকবল প্রেরণ করা যেতো।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে ডিপ্লোমা শিক্ষার ওপর ভর করে। তাদের কৃষি, শিল্প ও স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি যুগোপযোগী মানসম্মত ডিপ্লোমা শিক্ষাব্যবস্থা। অথচ আমাদের দেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ডিপ্লোমা চিত্রটা ভিন্ন। এখানে ডিপ্লোমা শিক্ষার প্রতি সমাজের এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব আছে। সামাজিকভাবে ধরে নেয়া হয় যারা পড়াশোনায় ভালো নয় তারা ডিপ্লোমা শিক্ষা নিতে আসে। এর ফলে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে থাকে। ডিপ্লোমা অবশ্য সাধারণ শিক্ষার বোর্ডসমূহ ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়ে আত্ম-অহমিকায় নিপতিত হয় জাতিকে পঙ্গু বিকলাঙ্ক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে।
দেশে সাম্প্রতিকালের বেসরকারি বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট হয়। এরপরও বড় বড় শহরকেন্দ্রীক হাতেগোনা যে কয়টি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলা হয়েছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানে কি যুগোপযোগী শিক্ষা দিতে পারছে? তাদের কোর্স-কারিকুলাম কি মানসম্মত? দেশের জন্য কি উপযুক্ত? শিক্ষাগ্রহণের উপযুক্ত পরিবেশ কি বিদ্যমান? ব্যবহারিক শিক্ষার সকল সুযোগ সুবিধা কি পর্যাপ্ত? এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনার কি কেউ আছে? এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রিকায় শিরোনাম খবর হয়। উচ্চবিত্ত না হলেও মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণির লোকদের স্বার্থে তাদের সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য এবং দেশের ডিপ্লোমা শিক্ষার হার বাড়াতে সরকারিভাবে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে ডিপ্লোমা শিক্ষার ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার সময় এসেছে। বাংলাদেশের বয়স প্রায় ৫০ হতে চলছে। এখনও আমরা ব্রিটিশ ও পাকিদের ডিপ্লোমা শিক্ষা ব্যবস্থার নীতি আদর্শ পরিচালনা ব্যবস্থা লালন করছি। এর থেকে উত্তরণের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
উপনিবেশিক আমলে গড়া ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী ৭টি প্রতিষ্ঠান যথা কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ইউনানি ও আয়ুর্বেদীয় বোর্ড, হোমিওপ্যাথিক বোর্ড, নার্সিং কাউন্সিল, ফার্মেসি কাউন্সিল, রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ, প্রাথমিক শিক্ষাএকাডেমি থেকে ডিপ্লোমা শিক্ষাকার্যক্রম পৃথক করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ডিপ্লোমা শিক্ষাবোর্ড, চট্টগ্রাম ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, খুলনা ডিপ্লোমা শিক্ষাবোর্ড, রাজশাহী ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড, সিলেট ডিপ্লোমা শিক্ষাবোর্ড, বরিশাল ডিপ্লোমা শিক্ষাবোর্ড, রংপুর ডিপ্লোমা শিক্ষাবোর্ড, ময়মনসিংহ ডিপ্লোমা শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠা এ শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আর তা হলেই আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণ সাধিত হবে। অভাব, অভিযোগ, অনুযোস্তা মুক্ত পরিবেশে জীবন যাপনের অবকাশ সৃষ্টি হবে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির সুন্দর ও কল্যাণকর পরিবেশে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ উন্মোচন হবে।
লেখকদ্বয়- সভাপতি/ মহাসচিব, ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ Khanaranjanroy@gmail.com