মো. আবুল হাসান/ খন রঞ্জন রায় * শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে জাতির ভিত। কোনো ভবনের ভিত্তি যদি দুর্বল হয়, তাহলে তার টিকে থাকার ক্ষমতা কমে যায়। যে কোনো সময় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ধসে পড়তে পারে দুর্বল ভিতের ওপর নির্মিত ভবন। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তাই প্রথমেই গুরুত্ব দেওয়া হয় তার ভিতের ওপর। তেমনিভাবে যে কোনো জাতির টিকে থাকা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর পৃথিবীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছিটকে না পড়তে চাইলে প্রয়োজন শিক্ষা। একারণেই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব প্রতিটি জাতির । শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গন আগামী দিনের সমৃদ্ধ নাগরিকদের দায়িত্বে নিয়োজিত। যে শিক্ষা তাদেরকে সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। আজকের শিশুরা প্রকৃত শিক্ষা পেলেই হতে পারবে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী। কেউ হবে শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, কবি, সাংবাদিক তৈরি হবে শিক্ষাঙ্গনেই। শিক্ষাঙ্গনের শ্রেণিকক্ষই শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতির ক্ষেত্র। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশই বর্তমান সমাজের প্রয়োজন মত চাহিদা ও ভবিষ্যৎ সমাজের সম্ভাব্য চিত্রকে সামনে রেখে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা পরিচালনা করে।
উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বমানে উন্নীত করার কোনো বিকল্প নেই। মূলত শিক্ষাই আলো, আর জ্ঞানই শক্তি। কালের বির্বতনে ও সময়ের প্রয়োজনে সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগাটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটও তা থেকে মোটেই আলাদা নয়। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সবকিছুতেই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে আমাদের দেশেও। সবকিছুতেই পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন হয়েছে। কিন্তু সে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায়। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই ঔপনিবেশিক ধারার শৃঙ্খলেই আবদ্ধ রয়েছে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা সুনাগরিক তৈরি করতে খুব একটা সহায়ক হচ্ছে না। রাস্তাঘাট, ফুটপাত সর্বত্র অন্তদৃষ্টিতে উপলব্ধি করলেই তা অনুধাবন করা যায়। মূলত আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও বৈশ্বিকমানে ঢেলে সাজানো সম্ভব হয়নি। কারিকুলামও বিন্যস্ত হয়নি আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসাকে রেখে।
যদিও শিক্ষাখাতকে জাতীয়ভাবে জাতীয় বাজেটে সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। শিক্ষার মান ও দেশকে শতভাগ শিক্ষিতকরণ ও শিক্ষার সাথে জড়িত শিক্ষকদের মানোন্নয়নের কথা চিন্তা করে দেশের সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা। এরপরও শিক্ষার্থীদের প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন এবং শিক্ষার মানে হতাশাজনক চিত্র এসেছে জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নের ফলে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে দায়িত্ব পালনে শিক্ষকরা প্রত্যাশা অনুযায়ী সফল নয়। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। মাঠপর্যায়ের পরিদর্শনেও আছে দায়িত্বে অবহেলা। প্রাথমিক শিক্ষার মানের চিত্র হতাশাজনক, যা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, জাতিসংঘের এসডিজি অর্জন, সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা, শিক্ষানীতি-২০১০ এবং সরকারের রূপকল্প-২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নে প্রাথমিক শিক্ষায় সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকার গত আট বছরে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে।
এখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যেখানে ২০০ শিক্ষার্থী রয়েছে, শিক্ষক রয়েছেন পাচঁজন। শিক্ষকমণ্ডলী তাদের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন পাঠ্যবই ও ব্ল্যাকবোর্ডের মাধ্যমে। এর বাইরে পাঠকে প্রাণবন্ত করতে মাঝে মধ্যে শ্রেণিকক্ষ ও কক্ষের বাইরে তারা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার কৌশল অবলম্বন করেন। পাঠকে শিক্ষার্থীর কাছে আদরণীয় ও স্মরণীয় করে রাখতে তারা সেই সনাতন কৌশলেই আটকে রয়েছেন। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ই-লার্নিং ব্যবস্থা এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। ই-লার্নিং পদ্ধতি মূলত এই সনাতনী পদ্ধতির বিপরীতে শিক্ষার্থীর পাঠকে আরো আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করতে সহায়তা করে। শিক্ষকরা যেমন এখন শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত অনেক শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে সামলাতে হিমশিম খান, ই-লার্নিয়ে শিক্ষকদের চাপ কিছুটা লাঘব হবে।
এই ই-লানিং শিক্ষা পদ্ধতি শিশুর সিলেবাসের বোঝা ও পরীক্ষা পদ্ধতিকেও সহজতর করতে পারে। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি শিশুকে মুখস্থ করার অভিশাপ থেকে রেহাই দেয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বাড়িয়েছে। বিদ্যালয়ে গিয়ে বড় পর্দায় পড়াশোনা শেষে বাড়িতে এসে সে যখন বই খুলে বসবে, তখন বইয়ের ভেতরে জলের আয়নার মতো সব ছবি স্পষ্ট দেখতে পাবে। কমে আসবে মুখস্ত করার অহেতুক চাপ। কমে আসবে নোটবই ও প্রাইভেট টিউটর নির্ভরতাও। এক হিসেবে আমরা শিক্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেই। আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে। নতুন-নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠছে। কিন্তু শধু শিক্ষা খাতের বাজেট বরাদ্দ বাড়া বা নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের মধ্য দিয়েই জাতির মেরুদণ্ড গঠনের প্রক্রিয়ার সফল সমাপ্তি হয় না। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের জন্য যুগোপযোগী পাঠ্যবই, প্রশিক্ষিত শিক্ষক। শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণের নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এখানেই আমাদের অনেকে অসম্পূর্ণতা আছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত অবস্থাও খুব বেশি সুখবর নয়। শিক্ষার মনোন্নয়নে পরিবর্তন নিরূপণের যেসব নির্দেশক রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য বা যোগ্যতা। শিক্ষার মান উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো সর্বোত্তম শিক্ষক থেকে সর্বোত্তম শিক্ষা আদায় করে নেয়া। শিক্ষা ও শিক্ষা পদ্ধতির গুণগত মান কোনো অবস্থায় শিক্ষকদের গুণগত মান অতিক্রম করতে পারে না। শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব শিক্ষকদের যোগ্যতা ও পারদর্শিতার ওপর নির্ভর করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যোগ্য ও পারদর্শী শিক্ষকের সংস্পর্শে এলে তাদের মেধার উন্নয়ন হয়। শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ঢাকা জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় পাঠদানরত মোট শিক্ষক ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৩ জন। এর মধ্যে ৭১ হাজার ৭০২ জন শিক্ষক কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন। এ হিসাবে ঢাকা জেলায় প্রাথমিক পর্যায়ের ২৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ শিক্ষক এখনো অপ্রশিক্ষিত।
মফস্বলের অবস্থা কী হতে পারে তা এই পরিসংখ্যানেই অনুমেয়। এই সব শিক্ষকরা পাঠদানে যেমন দুর্বল বিভিন্ন সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করে অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে এবং সেখানে শিক্ষক হিসেবে যারা রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগ অংশই যে প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করতে পারবে, তার নিশ্চয়তা ও নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ভ্রান্ত নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে। নিয়োগকৃত শিক্ষকদের কারোর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের পূর্ব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ নেই। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৪ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন অ্যাডুকেশন ডিগ্রিধারী নিশ্চিত করা হয়নি। আমাদের দেশে বিএ, এমএ ডক্টরেক্ট ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ দিয়ে একদিকে মেধার ও অর্থের জাতীয় অপচয় হচ্ছে। অন্যদিকে শিশুদের অখাদ্য ও কুখাদ্য খাওয়ানো হচ্ছে।
এইসব প্রযুক্তি জ্ঞানহীন শিক্ষকদের দিয়ে কোন ই-লার্নিং চালু সম্ভব হবে না। ই-লার্নিংয়ের জন্য প্রয়োজন বিস্তর গবেষণা। পর্যাপ্ত গবেষণা ছাড়াই এ শিক্ষা পদ্ধতিকে মাঝপথে নিয়ে ছেড়ে দিলে সেটি সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির মতোই অনেকাংশে কার্যকর ও ফলপ্রসূ হবে না। এ পদ্ধতি পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগে প্রয়োজন বিভিন্ন স্তরের গবেষণা। এই কাজটি সূচারূভাবে করতে পারবেন আন্তর্জাতিকমানের ৪ (চার) বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন অ্যাডুকেশন ডিগ্রিধারী প্রযক্তিবিদগণ। আন্তর্জাতিকমানের গবেষণার মধ্য দিয়েই মূলত বেরিয়ে আসবে কীভাবে ই-লার্নিং শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কার্যকর ও ফলপ্রসূ হবে । নয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দু-একটি ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর সরবরাহ করেই প্রাথমিক বিদ্যালয় আইসিটির আওতায় চলে এসেছে বলে প্রচার চালানো হবে ভয়ঙ্কর বোকামি।
শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প চিন্তার সুযোগ নেই। শিক্ষার গুণগত মান অনেকাংশেই নির্ভর করে শিক্ষকের যোগ্যতা ও দক্ষতার ওপর। এজন্য শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকারী শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। দেশ যখন টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে হাঁটছে, তার লক্ষ্য পূরণের জন্য শিক্ষার প্রতিটি ধাপেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার প্রয়োজন থেকেই পূর্ব শিক্ষা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
নতুন শিক্ষক নিয়োগের সময় ন্যূনতম ৪ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন অ্যাডুকেশন ডিগ্রিধারী নিশ্চিত করতে হবে। ৬ দশক পূর্বে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গড়া প্রাইমারি শিক্ষক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৫৬ থেকে বৃদ্ধি করে প্রতিটি উপজেলা সরকারি বেসরকারিভাবে একাধিক ইনস্টিটিউট অব প্রাইমারি টিচার্স (আইপিটি) প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অবৈজ্ঞানিক ১৮ মাসের ডিপ্লোমা কোর্স বাতিল করে ৪ (চার) বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন অ্যাডুকেশন (ডি.অ্যাড) কোর্স চালু করতে হবে। কোর্স পরিচালনার দায়িত্ব বিভাগীয় ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ডের উপর ন্যাস্ত করতে হবে। তা করতে পারলেই মূলত প্রাথমিক কাজটি শুরু করা সম্ভব।
এটি ঠিক এখনই আমরা চাইলে ইউরোপ-আমেরিকার মতো করে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরকে সাজাতে পারব না; কিন্তু আধুনিকায়নের কাজটি এখনই শুরু করতে হবে। একটি সুশিক্ষিত ও দক্ষ আগামী গড়তে হলে প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হতেই হবে। এটি শুরু করতে হবে প্রাথমিক স্তর থেকেই।
লেখকদ্বয়-সভাপতি/মহাসচিব
ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ।