১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ || ২৮শে মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

কামরুল হাসান * আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি  এ দেশে আজ প্রতিটি সেক্টরের উন্নয়ন হচ্ছে দ্রুত গতিতে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় অনুসারে ২০১৫ সালের ১ জুলাই বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত এক তথ্যে তা ওঠে এসেছে। এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হতে ২০২১ টার্গেটে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার ৪৬ বছরে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অবদানও কম নয়। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি যে অবস্থানে রয়েছে তার চেয়ে আরও ভালো অবস্থানে থাকতে পারত। যদি দেশের উন্নয়নে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আরও সক্রিয় থাকত। একটু চিন্তা করলেই দেয়া যায়, সব মানুষ একটি শান্তিপূর্ণ উদার গণতান্ত্রিক দেশ চায়- যেখানে থাকবে পরস্পর সহযোগিতা, সহিঞ্চুতা, শ্রদ্ধাবোধ, সমানাধিকার, স্বাধীনভাবে মাথা তুলে জেগে ওঠার সুযোগ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, কলহ প্রায়ই ঘটছে। অথচ জনগণ প্রতিহিংসা ও অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ দেখতে চায় না। রাজনীতিতে সহনশীলতা ও সমঝোতা আবশ্যক। প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান হওয়া দরকার। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উদার মানসিকতা পোষণ করতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে উদার ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঠিক চর্চা করাই শ্রেয় বলে মনে করি।

একটি দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি গণতন্ত্র । উদার গণতন্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেলে বাংলাদেশ আরও দ্রুত গতির সঙ্গে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারবে।  তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোকে সব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাও জরুরি। পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্যমুক্তি, সুশিক্ষা, সুশাসন ও জবাবদিহিতা  বজায় থাকতে হবে। গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম যেটি নিশ্চিত করে মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকার। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতি হচ্ছে সেই রাজনীতি, যে রাজনীতিতে কেউ কারও প্রতি অনধিকার হস্তক্ষেপ করবে না এবং সবাই সত্যের আদর্শ ধারণ করে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাবে।

ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সুস্থধারার রাজনীতি পরিচালনায় প্রকৃত চালিকাশক্তি জনগণ। অন্যদিকে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পূর্বশর্ত হচ্ছে- জনগণ হবে সকল ক্ষমতার উৎস এবং সব রাজনীতিকরা ব্যক্তিস্বার্থ পরিহার করে শুধুমাত্র জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাবে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা করবে সাধারণ মানুষের শান্তি ও কল্যাণ। আর যে কথাটি বলা বেশি দরকার তা হচ্ছে-গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নেতারা হিংসাপরায়ণ হয়ে কেউ কারও বিরোধিতা করবে না, শুধুমাত্র যুক্তিসঙ্গত কারণেই বিরোধিতা করবে, গঠনমূলক সমালোচনা করবে। আর এতেই ফিরে আসবে সত্যিকার অর্থে শান্তি। বজায় থাকবে সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক পরিবেশ।

স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর মুখোমুখি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া ! বসলেন একই সোফায়

তাই বলতে বাধা নেই যে ‘উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বড়ই অত্যাবশ্যক। কারণ রাজনীতিতে উদারতার অভাবেই দেশ দিন-দিন নিম্নগামী হতে পারে।   উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতিই বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ সাফল্যের মুকুট উপহার দিতে পারে।

এ কথাও বলতে কোনো বাধা নেই যে, উদারতা ছাড়া রাজনীতি আর নাবিক ছাড়া জাহাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ ধরনের জাহাজ নদীর গতিপথ হারিয়ে ওল্টো পথে চলতে-চলতে কোনো এক সময় যাত্রীসমেত ডুবে যেতে পারে নদীর গভীরে। ফলস্বরূপ জাহাজ ও যাত্রী সবার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়। ঠিক তেমনি উদারতাহীন গণতন্ত্রও টিকিয়ে রাখতে পারে না প্রকৃত গণতন্ত্র।

আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর রাজনৈতিক দলসমূহের দেশপ্রেম রয়েছে। গণতন্ত্রের প্রতিও রয়েছে তাদের অবিচল আস্থা, বিশ্বাস ও দৃঢ়তা। স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের ক্ষমতার পালাবদল হয়। নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানায়। বিজয়ী প্রার্থী সরকার পরিচালনায় পরাজিত প্রার্থীর সহযোগিতা কামনা করেন। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশেও কয়েকটি ঘটনার আলোকে বলা যেতে পারে, আমরাও উদার ও শক্তিশালী গণতন্ত্রের পথে হাঁটছি। প্রথমত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি মাহমুদুর মান্না এক সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আসীন থাকলেও মনস্তাত্ত্বিক দূরত্বে তিনি দল থেকে বের হয়ে ‘নাগরিক ঐক্য’ নামে আলাদা দল গঠন করেন। নতুন দল গঠনের পর টেলিভিশন টকশোসহ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষেদাগার করেন। তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বিরুদ্ধেও কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। এমন পারস্পরবিরোধী অবস্থানের পরও অসুস্থ মাহমুদুর রহমান মান্নাকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদের হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। এতে উদার গণতন্ত্র ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সুস্থ ধারার রাজনীতির দৃষ্টান্তই প্রস্ফুটিত হয়। যা বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতির বিরুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

দ্বিতীয়ত, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে সহজে অনুমেয়-বিএনপি এখন রাজনীতিতে অনেক ইতিবাচক ভূমিকায়। বিএনপির শীর্ষ নেতারা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে নির্বাচন কমিশন গঠনে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সমাবেশে এমপিদের স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে আওয়ামী লীগের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে। পরবর্তী সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে গণতন্ত্রের ভিত মজবুতের লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনা। এ দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যেমন গণতন্ত্রমনা তেমনি সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলও চান শক্তিশালী গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ধারাবাহিকতা।

তৃতীয়ত, সৈয়দপুর বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কুশল বিনিময়ের ছবি গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যেন দেশের রাজনীতিতে নির্মল-সুবাতাশ বইতে চলেছে। গত ১৯ নভেম্বর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে তাদের দুজনের এই দেখা-সাক্ষাত্ বা কুশল বিনিময়কে আমরা নিছক আনুষ্ঠানিকতা বা লোক দেখানো বলে মনে করি না। বরং আমরা বিশ্বাস করি যে, তারা দুজন আন্তরিকভাবেই কাজটি করেছেন। এটা একটা সহনশীল ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হলো বলে আমি মনে করি। দেশের মানুষও আসলে চায় যে, রাজনৈতিক দলেগুলোর নেতারা পাশাপাশিই বসবে। মত ও পথ ভিন্ন হলেও তারা জাতীয় স্বার্থে মানুষের কল্যাণে, দেশ ও গণতন্ত্র তথা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে কথাবার্তা বলবে। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কিংবা অন্য যে কোনো ইস্যুই হোক তারা পরস্পরকে শত্রুজ্ঞান না করে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে। আর সবার প্রত্যাশা এটিই ।