১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ || ২৮শে মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

মো. আবুল হাসান/ খন রঞ্জন রায় * সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন কেবল বাড়ছেই। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময় অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও দুর্ঘটনা থামেনি। প্রতিদিনই খালি হচ্ছে কোনো না কোনো মায়ের বুক। খবরের কাগজে সড়ক দুর্ঘটনার খবর কেবল শিরোনাম হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঘটনার কারণে ইদানীং অবশ্য পত্রিকার ভেতরের পাতায় জায়গা পাচ্ছে।

বিআরটিএ’র তথ্য মোতাবেক সারাদেশে মোটরসাইকেল বাদে নিবন্ধনকৃত যানবাহন ১৫ লাখ ৯ হাজার ৬০৪টি। এসব বাস, ট্রাক, প্রাইভেট গাড়ি, ইত্যাদির বিপরীতে ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে ৭ লাখ ১২ হাজার ৩৩৬ জনের। বাকী ৭লাখ ৯৭ হাজার ২৬৮টি নিবন্ধনকৃত যানবাহন চলছে অদক্ষ, অশিক্ষিত লাইসেন্সবিহীন চালক দিয়ে।

এই ছোট্ট পরিসংখ্যানই বলে দেয়, অদক্ষ, অশিক্ষিত লাইসেন্সবিহীন চালকই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। দক্ষ চালকের অনুপস্থিতিতে নিরাপদ সড়কের দাবিও অকার্যকর হতে বাধ্য। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। চালকদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করার পাশাপাশি সম্মানজনক অর্থনৈতিক সুবিধাও দিতে হবে- যাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষিত মানুষ এ পেশায় যুক্ত হতে আগ্রহী হন। সামাজিকভাবে অবমূল্যায়ন করা হয় বলেই অনেকে এমএ পাস করে পিয়নের চাকরি করলেও এসএসসি পাস করে ড্রাইভারের চাকরি করতে চান না।

বর্তমানে চালকদের প্রায় সময়ই আট ঘন্টার বদলে ১৪-১৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে হয়। দুই ঈদের সময় কর্মঘণ্টা আরও বেড়ে যায়। ফলে চালকদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবন নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ বাস কোম্পানিই চালকদের মাসিক ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে থাকে। আবার রাজধানীর ঢাকার প্রায় সব বাসেই চালক ও হেলপারদের মজুরি দেওয়া হয় ট্রিপ ভিত্তিতে। ফলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থানও সমসাময়িক অন্যান্য পেশাজীবীর তুলনায় সুবিধাজনক নয়। এর পর রয়েছে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

অধিকাংশ বাসচালকই মাদকাসক্ত। বেসরকারি সংস্থার একটি জরিপে বলা হচ্ছে, রাজধানীর ৮৯ শতাংশ বাসচালকই মাদকের সঙ্গে জড়িত। তারা নিয়মিত গাঁজা-ইয়াবা সেবন করে। নৈরাজ্যজনক এই পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে পরিবহন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা বলে সরকার এখন নানা ধরনের ধানাইপানাই নীতির ঘোষণা দিচ্ছে। বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির বিধান বাড়িয়ে রেখে ইতিমধ্যে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন করা হয়েছে। এগুলো মূলত কোনো সমাধানই নয়। কারণ শর্ষের মধ্যে ভূত। যেসব অঘটন পরিবহন সংস্থার মধ্যে ঘটছে তার পরিবর্তন সম্ভব নয় এ কারণে যে এর সবকিছুর জন্যই পরিবহন মালিকরাই দায়ী। এই মালিকরা সবসময় শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তিকে থাকে। এক বৃত্তের খুঁটিতেই এরা বাঁধা থাকে, কাজেই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, এখন পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে শাস্তির নামে সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকঢোল পেটানো সত্ত্বেও কোনো পরিবহন মালিককেই গ্রেফতার করা, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া বা অন্য কোনো ধরনের শাস্তির কোনো ব্যবস্থা সম্ভব হয়নি। বরং তাদের দাম্ভিকতা, নৈরাজ্য বেড়েছে। আধিপত্যের মহড়া দেখানো শুরু করেছে বেআইনি ধর্মঘটের নামে। সম্প্রতি পাশ হওয়া সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনসহ আটদফা দাবীর নামে পরিবহন সেক্টরে ৪৮ ঘণ্টা কর্মবিরতিতে পেশিশক্তি প্রদর্শন করছে। অ্যাম্বুলেন্স, ব্যক্তিগত গাড়ী, জরুরি সেবার পরিবহনেও তাদের অরাজকতা সীমা অতিক্রমের নজির দেখাচ্ছে।

এরপরও পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল কর্মীবাহিনী তৈরি করে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আনতে দক্ষ চালক তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ আরো সম্প্রসারণ করতে হবে। প্রতিবছর চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষিত চালক তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। বেসরকারি যেসব ট্রেনিং ইনস্টিটিউট আছে, তাদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে এবং সেগুলোতে যাতে মানসম্মত প্রশিক্ষণ চলে তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে পুরনো চালকদের জন্য বাধ্যতামূলক ওরিয়েন্টশন কোর্সের ব্যবস্থা করতে হবে। লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়া নিখুঁত করার পাশাপাশি সড়ক আইনের বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে।

দক্ষ চালক তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দিতে বিআরটিসির ৩টি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও ১৭টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আধুনিকায়ন ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প গত মার্চে অনুমোদন পায়। এর মেয়াদ ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। মোট ব্যয়ের পুরোটাই সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে এ প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা। কিন্তু এক টাকাও ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। এ বিবেচনায় চলতি অর্থবছরেও মাত্র ৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।

বরাদ্দ ব্যবস্থার মারপ্যেঁচে না গিয়ে সাধারণ দৃষ্টিতে কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দিতে হবে। সরকারি উদ্যোগে সব জেলায় প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে ড্রাইভিংয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে জনশক্তি তুলতে হবে। চালক-নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করে নিশ্চিত করতে হবে কোনো চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা যেন অবশ্যই মাধ্যমিকের নিচে না হয় (হেলপারের কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে)। যারা ইতিমধ্যে গাড়ি চালনা শিখেছে কিন্তু মাধ্যমিক পাস করেনি, তারা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশব্যাপী প্রায় সতেরশ ‘স্টাডি’ সেন্টারের মাধ্যমে দূরশিক্ষণে (ফ্রি-পাঠ্যবই, ই-বুক, ই-প্লাটফর্ম, ওয়েভটিভি-রেডিও, মোবাইল এসডিকোর্ড ভিডিও লেকচার) লেখাপড়া করে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারে। প্রয়োজন শুধু ইচ্ছা আর আয়োজনের। গাড়িচালক নিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় একটি সংস্থা তৈরি করতে হবে, যার দায়িত্ব হবে চালকদের দক্ষতা আর মাদকাশক্তির পরীক্ষা  (ডোপ টেস্ট) করে ‘চালক-ফিটনেস সার্টিফিকেট’ ইস্যু করা।

সরকারি, আধাসরকারি, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর যেসব গাড়ি আছে তাদের ক্ষেত্রেও একই নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে ড্রাইভার নিয়োগ নীতিমালার পরিবর্তন করে ৪ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন ড্রাইভিং ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ নিশ্চিত করলেই সমস্যার সমাধানের  পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।

অচিরেই বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়ের সাথে যুক্ত হবে। বাংলাদেশের গাড়ী চালনায় এশিয়ার জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া সাথে প্রতিযোগিতা পারদর্শিতা দেখাতে হবে। বাংলাদেশের ড্রাইভিং প্রযুক্তিবিদ্যায় ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হলে উচ্চবেতনে বিদেশে ড্রাইভার রফতানি করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

সরকারিভাবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) ৬ মাস, ৩ মাসের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিআরটিসি ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে প্রশিক্ষক হিসেবে যারা কর্মরত তাদেরও ড্রাইভিং প্রযুক্তিবিদ্যায় প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ নেই। বিআরটিসি’র ট্রেনিং সেন্টারগুলোকেও প্রযুক্তিবান্ধব করে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রশিক্ষক নিয়োগেও ডিপ্লোমা ইন ড্রাইভিং ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিবিদ্যা শিক্ষা কোর্সে নিশ্চিত করতে হবে।

সারাদেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে পরিচালিত ইনস্টিটিউটগুলোতে প্রশিক্ষক নিয়োগ যোগ্যতার সংবিধিবদ্ধ কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ড্রাইভিং প্রযুক্তিবিদ্যা শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কোর্স চালু করাটাই সড়ক আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আর্শ্চযজনক আণবিক বোমার বিস্ফোরণ সদৃশ্য হবে।

লেখকদ্বয়-সভাপতি/মহাসচিব

ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ Khanaranjanroy@gmail.com