ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনকে উপলক্ষ করে সবকয়টি ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকে করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদ।রোববার(১৬সেপ্টেম্বর) দুপুর পৌনে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয় সংলগ্ন আবদুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষে শুরু হওয়া এই বৈঠক পৌনে ৪টার দিকে শেষ হয়।
বৈঠকে দ্রুত ডাকসু নির্বাচন আয়োজন ও ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহাবস্থানের পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন নেতারা।
এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।
বৈঠকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র মৈত্রী, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের প্রভোস্টরাও অংশ নেন।
বৈঠক শেষে সকল ছাত্র সংগঠনের নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। পরিবেশ পরিষদের সভায় ওঠেআসা বিভিন্ন দাবি ও প্রশাসনের আশ্বাসের কথা জানান তারা। সেখানে তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন ও ক্যাম্পাসে সকল ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিতকরণের দাবির কথা জানান।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো, আমরা তার পরিসমাপ্তি চাই। ১৬ বছর পর পরিবেশ পরিষদের প্ল্যাটফর্মে এখানে ১৩টি সংগঠন কথা বলতে এসেছি। সবার পক্ষ থেকেই মতামত নেওয়া হয়েছে। একটি কমন প্ল্যাটফর্মে কমন এজেন্ডায় আমরা একমত ছিলাম যে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য ডাকসু নির্বাচন হোক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সকলের মতামতের ভিত্তিতে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া হবে।
ক্যাম্পাসে সকল ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থানের ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি হলে ছাত্রলীগ কর্মীদের সংখ্যা গড়ে ৩০ শতাংশ। এর বাইরে যারা আছেন তারা অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত। আমাদের নেতাকর্মীদের বলেছি, এখানে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন বলতে কিছু নেই। আমরা সবাই ভ্রাতৃসম ছাত্র সংগঠন। সহাবস্থানের জন্য যে ‘ক্রাইটেরিয়া’ রয়েছে সেটা পূরণ করতে হবে।
গোলাম রাব্বানী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় তখন প্রথম ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হয়েছিলো। পরবর্তীতে ছাত্রলীগের কারণে একদিনও ক্যাম্পাস বন্ধ হয়নি। যারা নিয়মিত ছাত্র আছেন তারা আসুন, প্রশাসনের সাথে কথা বলুন-আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো।
তিনি বলেন, বিগত নির্বাচনে ছাত্রদলের এক নেতাকে সরাসরি পেট্রোল বোমাসহ ধরা হয়েছিলো। আমি তাদের কাছে নিশ্চয়তা চাই, তারা হলে আসলে যেন পকেটে করে ককটেল রাখবেন না, পেট্রোল বোমা ছুঁড়বেন না। এটা নিশ্চিত করতে পারলে, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সহাবস্থানের ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি রাজীব আহসান বলেন, ডাকসু নির্বাচনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। ডাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের দাবির মধ্যে ছিলো, আগে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক সহাবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও মধুর ক্যান্টিনে রাজনীতি করার যে স্বাভাবিক পরিবেশ, তা নিশ্চিত করতে হবে। হলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থাকার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। হলগুলোর ভীতিময় পরিবেশ দূর করতে হবে। মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের সিট বন্টন করতে হবে। নির্বাচন করবে ছাত্র সংগঠনগুলো।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোতে যখনই সহাবস্থান নিশ্চিত থাকবে, তখনই ডাকসু নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ হবে বলে আমরা মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছে। প্রশাসনের কাছে আমরা একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি।
ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ও তফসিল ঘোষণার কথা বলেছি। এর আগে সকল রাজনৈতিক দলের সহাবস্থান নিশ্চিত করে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা বলেছি, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। কেননা এটি স্বতন্ত্র। এর আগেও ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও নির্বাচন হয়নি। প্রশাসনের কাছে দাবি রেখেছি,যাতে এবারও এরকম কিছু না হয়। আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে সুস্পষ্ট তারিখ চেয়েছি।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের একাংশের সভাপতি ইমরান হাবীব রুমন বলেন, আমরা সুস্পষ্টভাবে বলেছি, আগামী অক্টোবরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করে নভেম্বরের মধ্যেই ডাকসু নির্বাচন দেওয়া উচিত। জাতীয় নির্বাচনের মারপ্যাঁচে আগের মতো এবারও উদ্যোগটা যেন ঝিমিয়ে না পড়ে। আমরা মনে করি, এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনটা হোক।
আলোচনা শেষে নিজ লাউঞ্জে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমদ, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. কবি মুহম্মদ সামাদ, প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল।
উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, এখানে প্রত্যেকটি ক্রিয়াশীল সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতিতে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকল সংগঠনের নেতারাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ মেনে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলো।গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, সংসদীয় মূল্যবোধ সংরক্ষণ করে শিক্ষার্থীরা আলোচনা করেন। তাদের আলোচিত বিষয়গুলো আমাদের প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল বডি লিখে রেখেছেন। এটা নিয়ে পর্যালোচনা করে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবো।
তিনি বলেন, আলোচনা শেষে এ নিয়ে সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেছে। আলোচনাকে সবাই সাধুবাদ জানিয়েছে। তাদের সাথে কবে নাগাদ ডাকসু ইলেকশন দেয়া যায়, ক্যাম্পাসে সহাবস্থান, সম্ভাব্য তারিখ এসব নানাবিধ বিষয় নিয়ে ছাত্ররা আলোচনা করেছে। শিক্ষার্থীদের সাথে যে আলোচনা হয়েছে, এটা নিয়ে প্রভোস্ট কমিটির সাথে আমরা বসে পর্যালোচনা করবো। শিক্ষার্থীদের সাথে এটা আমাদের প্রাথমিক আলোচনা, আমরা পরবর্তীতে আরো বসবো।
‘কবে নাগাদ ডাকসু নির্বাচন দেওয়া হবে’- এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, প্রভোস্ট কমিটি, শৃঙ্খলা পরিষদ ও সিন্ডিকেট থেকে একটি নির্দেশনা তো আগেই দেওয়া আছে। ডাকসু নির্বাচনের জন্য কাজের যে লোড, যে কর্মপরিধি, তা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের এই কমিটিগুলো একটা নির্দেশনা ইতোমধ্যেই দিয়েছে, সেটা হলো; মার্চ ২০১৯। এই নিরিখে এখন পর্যন্ত আমাদের ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলছে। আশাকরি অক্টোবরের মধ্যে খসড়া যে ভোটার তালিকা, সেটি প্রণয়ন করবো। এই ভোটার তালিকা প্রণয়ন একটি জটিল কাজ। সেটি করতে পারলে অনেক দূর এগিয়ে যাবো।
‘কারা ভোটার হতে পারবে’- এমন প্রশ্নে- তিনি বলেন, ডাকসুর যে কনস্টিটিউশন আছে, সে অনুযায়ীই ভোটার তালিকা হবে।
ডাকসু নির্বাচন দেয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সব দলের সহাবস্থান নিশ্চিত করা নিয়ে ছাত্র নেতাদের দাবি সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, হলগুলোতে অবস্থানের জন্য প্রভোস্টবৃন্দ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। মধুর ক্যান্টিনকেন্দ্রিক যে রাজনৈতিক চর্চা, সেটি সকলের জন্য উন্মুক্ত। সেখানে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের যে কার্যক্রম চালাবে, তাতে কারো জন্য প্রশাসন থেকে কোন বাধা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে আলোচনা স্থলে ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ: আলোচনা শুরুর আগে সকাল ১১টা ২৫ মিনিটে মধুর ক্যান্টিন থেকে রিক্সায় চেপে উপাচার্যের কার্যালয়ে আসেন ছাত্রলীগের চার নেতা; কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক হোসাইন সাদ্দাম।
পরে সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন সহকারী প্রক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজীব আহসান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক বাশার সিদ্দিকীকে নিয়ে উপাচার্যের কার্যালয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম।
আলোচনা শেষে প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক আবার একই গাড়িতে তাদের উঠিয়ে দেন। তবে ডাকসুর দাবিতে সবচেয়ে সোচ্চার তিন বাম সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন ও ছাত্রফ্রন্টের নেতারা আলোচনা শুরুর ২০ মিনিট পর ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে কার্যালয়ে প্রবেশ করেন।