২৩শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ || ৬ই জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী   *

ইউসুফ, সেলিম দুই ভাই-সীতাকুণ্ডের মানুষ। আমি পূর্বকোণে থাকার সময় ইউসুফ বেশকিছুদিন পূর্বকোণের সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। তবে ইউসুফ মূলত শিক্ষক, প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী। বাংলাদেশের গ্রামে একসময় এমন বহু শিক্ষক, ডাক্তার, সমাজকর্মী পাওয়া যেত, যারা কৃষক সমিতি, না হয় ন্যাপ বা কমিউনিস্ট পার্টি করতো। আর সংবাদ বা একতা পত্রিকায় সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করতো কিংবা পত্রিকা দুটি ফেরি করতো। ইউসুফও অনেকদিন সংবাদের সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি ছিলেন। ইউসুফ পূর্বকোণ ছেড়ে দেয়ার পর ওর ছোটভাই সেলিমকে পূর্বকোণের সাংবাদিকতা-কর্মে নিয়োজিত করে। তারপর এক সময় আমি নিজেই তো পূর্বকোণ ছেড়ে এলাম। সম্ভবত সেই সময়, যখন হাকিম (আতাউল হাকিম) ভাই, ইস্কান্দর (ইস্কান্দর আলী চৌধুরী) ভাই আর আমি বেকার হয়ে গেলাম, ইউসুফের সঙ্গে যোগাযোগ হলো, ও বললো, সে ‘চাটগাঁর বাণী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছে এবং সেটা নিয়ে কাজ করছে। একইসময় পূর্বকোণের মীরসরাই সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন এসে আমাকে বললো, ‘বন্দর নগরী’ নামে ওর একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে সেটি বের করতে পারি। আমি আর হাকিম ভাই সেই পত্রিকা কয়েক সংখ্যা পরীক্ষামূলকভাবে বের করে বুঝলাম সেটা আমাদের কাজ নয়। নিজামও ছিলো আমাদের সঙ্গে। আরো ছিলো শোয়েব কবির নামে এক ছেলে, যে এখন লন্ডনে সাংবাদিকতা করে। আর মিরু নামে একজন, সে এখন নুরুল ইসলাম বি.এসসি সাহেবের একান্ত সহকারী ।

ইউসুফ পরে চাটগাঁর বাণী’র প্রধান সম্পাদক হয়ে ওর ভাই সেলিমকে সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করে। সেই ইউসুফ গত বেশ ক’দিন ধরে আমার বায়োডাটা খুঁজছিলো। কেন জিজ্ঞেস করলে বললো আমাকে নাকি সংবর্ধনা দেবে। আমি অনেকদিন ঘুরিয়ে শেষমেষ বায়োডাটা দিয়ে তার হাত থেকে নিস্তার পাই। তারপর ইউসুফ আমার কাছে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র পাঠালো এবং আমার বায়োডাটা ফেসবুকে পোস্ট করে দিলো।

গত ২৩নভেম্বর শুক্রবার প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে ছিলো ইউসুফের অনুষ্ঠান। চাটগাঁর বাণী’র উদ্যোগে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে মরণোত্তর পদক; আমাকে, অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম ভাই, চসিক প্যানেল মেয়র ড. নিছার উদ্দিন আহমদ মঞ্জু, সদ্য পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পাওয়া একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে অন্তর্ভুক্ত করে সংবর্ধনা প্রাপকের তালিকা সাজানো হয়েছিলো। চসিক মেয়র আ.জ.ম নাছিরউদ্দিনকে করা হয়েছিলো প্রধান অতিথি। মরণোত্তর পদকের তালিকা দেখে মনে হলো বেশ মাথা খাটিয়ে উদ্যোক্তারা নামগুলো নির্বাচন করেছেন। সত্তরে মীরসরাই ও ফটিকছড়ি থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ-সদস্য সৈয়দ ফজলুল হক বি.এসসি, সাবেক এমপি দ্বীপবন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান এবং প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও উর্দু সাহিত্যের বিশিষ্ট অনুবাদক আখতার উন নবীকে মরণোত্তর পদকের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। উত্তম নির্বাচন।

ইউসুফ, সেলিমকে সাংবাদিকতা করতে হবে এমন দিব্যি কেউ দেয়নি। তবুও তাঁরা যে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় মুখ গুঁজে পড়ে আছেন, সেটা সংবাদপত্রের প্রতি তাঁদের আন্তরিক ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। তারা বের করেন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। দেশে যার বাজার এমনিতেই ছোট, তদুপরি চট্টগ্রামেতো একেবারেই সঙ্কুচিত। পত্রিকার বাজার যেখানে সঙ্কুচিত, আয় সেখানে আরো সঙ্কুচিত। এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার অর্থ জেনেশুনে বিষপান করা। চাটগাঁর বাণী বের করে দুইভাই সেই হলাহল পান করে সম্ভবত  ‘নীলকণ্ঠ’ হতে চান। যাই হোক, পরিণামদর্শী হলে কেউ এমন একটি অনিশ্চিত ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগ করে টাকাগুলো পানিতে ফেলে দেবে না। কিন্তু ইউসুফ-সেলিম ভ্রাতৃদ্বয় নাছোড়াবান্দা। জান কবুল, তবু সংবাদপত্রের ব্রতে তারা যে পণ করেছে, তা’ থেকে কিছুতেই চ্যুত হবেন না। তাই বলে আন্ডারগ্রাউন্ড প্রেস বা দু’নম্বরি সাংবাদিকতাও করবেন না। ধান্ধাবাজি করতে হলে কত ক্ষেত্রই তো আছে, কিন্তু সংবাদিকতার ন্যায় মহৎ পেশাকে কলঙ্কিত করার দাগ কেন তারা গায়ে লাগাবেন? সেদিকে কিন্তু দু’ভাইয়ের ন্যায়নীতিবোধ টনটনে।

নিয়মিত কলাম, মন্তব্য, রাজনৈতিক ভাষ্য, ফিচার দিয়ে পৃষ্ঠা সজ্জিত করে চাটগাঁর বাণীর যে মান তারা দাঁড় করিয়েছেন, সেই মান থেকে অবনত হওয়ার কথা তারা ভাবতেই পারেন না। দু’হাতই চলে, কলম চালনায় দু’ভাই-ই সমান দক্ষ। সে কারণেই চাটগাঁর বাণী একটা ভাল সাপ্তাহিকের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে।

ইউসুফ-দের মতো এমনি সাপ্তাহিক পত্রিকা নিয়ে আরো বেশ ক’জন সাংবাদিক লড়াই করে টিকে আছেন। যেমন অনুজপ্রতিম আবু সুফিয়ান ও জিএম শাহাবুদ্দিন খানের সাপ্তাহিক ‘চট্টলা’, নুরুল আবসারের ‘আন্দরকিল্লা’ এবং মুহাম্মদ জহিরের সাপ্তাহিক ‘স্লোগান’। গোলাম মওলা মুরাদের ‘চট্টগ্রাম প্রতিদিন’ কি প্রতিদিন প্রকাশিত হয়? চেরাগী পাহাড়ে তাদের সাইনবোর্ড দেখি কিন্তু পত্রিকা আমার চোখে পড়েনি। তবে আমি না দেখলেই যে পত্রিকা বের হয় না সেটাই বা কি করে বলি।

সৈয়দ উমর ফারুকের ‘বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ’, আফসার ভাই’র ‘কর্ণফুলী’ এবং আফজল মতিন ভাই’র পুত্রের ‘পূর্বতারা’ কবির সিদ্দিকীর ‘সাঙ্গু’ ও ‘প্রিয় চট্টগ্রাম’-প্রতিদিনই এ দৈনিক পত্রিকাগুলোর হার না মানা অস্তিত্বের লড়াই দেখে দেখে আমি অবাক ও অভিভূত এবং পত্রিকাগুলোর মালিক ও সম্পাদক গোষ্ঠীর প্রতি কুর্ণিশ জানাই। পূর্বতারা ও কর্ণফুলী বহু পুরোনো কাগজ। কর্ণফুলী তো পূর্বকোণ-আজাদীকে রীতিমত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে আপন আবির্ভাবের জানান দিয়েছিলো। রুশো মাহমুদ সম্পাদিত দৈনিক “সুপ্রভাত বাংলাদেশ” লোকবল এবং কলেবরে বড় পত্রিকারই সমগোত্রীয়। চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার অগ্রযাত্রায় উল্লেখিত সমস্ত পত্রিকাই কিছু না কিছু অবদান রেখে চলেছে-একথা মানতেই হবে।

চট্টগ্রামের সাংবাদপত্রের এখন ভরা সংসার। প্রিন্ট মিডিয়া যেমন তেমন, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত বেশ চোখে পড়ছে। ১৯২০-২১ সালে যারা চট্টগ্রামে দৈনিক পত্রিকার ঘর বেঁধেছিলেন, আজ তাঁদের ঘর উপচে পড়া সাংবাদিকের পদচারণা দেখে তারা নিশ্চয় পরলোক থেকে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন।

লেখক- সাবেক বার্তা-সম্পাদক, দৈনিক পূর্বকোণ ও  ডেপুটি এডিটর ,বাংলাদেশ প্রতিদিন।