১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ || ২৮শে মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

মো. আবুল হাসান/খন রঞ্জন রায় *  ক্রমবর্ধমান রফতানি প্রবৃদ্ধির মধ্যেও ধুঁকছে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই দুর্দিন যাচ্ছে এই খাতের রফতানি আয়। এভাবে চলতে থাকলে ২০২১ সালে ৫ হাজার কোটি টাকা রফতানি আয়ের লক্ষ্য শুধু কল্পনাতেই থেকে যাবে। সদ্যসমাপ্ত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ১৩৮ কোটি ডলারের বিপরীতে আয় হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার- যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২১ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তুলনায় ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১২৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২৮ কোটি ডলার। চামড়া ২৪ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ২৩ দশমিক ৭১ শতাংশ কমে রফতানি হয়েছে ১৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ২৩ কোটি ২০ লাখ টাকা।

চামড়াজাত পণ্য থেকে ৫৪ কোটি ডলারের রফতানি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৩৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। জুতা ও অন্যান্য পণ্যের লক্ষ্যমাত্রায় ৬০ কোটি ডলারের বিপরীতে আয় হয়েছে ৫৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৫৩ কোটি ডলার। এছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১১৩ কোটি ডলারের চামড়া এবং চামড়াজত পণ্য রফতানি করা হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছিল ১১৬ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার।

চামড়াকে গুরুত্ব দিয়ে ইতোমধ্যে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তা গত বছরের তুলনায় দশ শতাংশ কম। এবার প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ঢাকায় ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা। গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। অন্যদিকে সারাদেশে ছাগলের লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং প্রতি বর্গফুট বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজার এবং চলমান বাণিজ্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এ বছর বাস্তবভিত্তিক চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। চামড়া ব্যবসায়ীদের অনেকে মনে করছেন, দাম কমানোর ফলে প্রতিবেশি ভারতে চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে চামড়ার দাম কমানোর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে মাদরাসা ও এতিমখানাগুলো।

দেশের অর্থনীতিতে চামড়া শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে চামড়া কেনা-বেচা নিয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সে দাম ঠিক থাকে না। সিন্ডিকেট চক্র চামড়ার দাম নিজেদের ইচ্ছামতো নির্ধারণ করে। যারা কোরবানি দেন, তাদেরকে এ নিয়ে খুব একটা সচেতন হতে দেখা যায় না। সাধারণত কোরবানির চামড়া বা তার বিক্রিত অর্থ মাদরাসা ও এতিমখানায় দেয়া হয়ে থাকে। এসব চামড়ার বিক্রিত অর্থ দিয়ে যা আয় হয় তার মাধ্যমেই মাদরাসা ও এতিমখানার লাখ লাখ শিক্ষার্থীর বছরের বেশিরভাগ সময়ের ভরণপোষণ ও পড়ালেখার খরচ চালানো হয়। সমাজের দানশীল ব্যক্তিদের দান-অনুদানের মাধ্যমে এসব মাদরাসা ও এতিমখানার খরচ চালানো হয়। এ প্রেক্ষিতে, চামড়ার দাম কমিয়ে দিলে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হবে। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর খরচ যোগানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

কোরবানির চামড়ার দাম কমানোর মধ্য দিয়ে দেশের চামড়া শিল্পের দৈন্যদশা ফুটে ওঠেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, এবার চামড়া রফতানির প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ কমেছে। চামড়া শিল্পটি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, সাভারে স্থানান্তরিত চামড়া শিল্প এলাকা পুরোপুরি চালু না হওয়া। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতির বিষয়টিও বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবেঙ্গর সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেই রয়েছে ৪১৮টি টেনারি শিল্প। ইতোমধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা তৎপর হয়ে ওঠেছে এবং অগ্রীম অর্থ বিনিয়োগ করেছে বলে জানা গেছে। সীমান্তবর্তী এলাকার ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়া ক্রয়ের জন্য ভারত থেকে গরু কিংবা নগদ টাকা নিয়ে থাকে।

আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর একারণে ঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক পরাশক্তির দেশসমূহে চামড়াতে বিনিয়োগের আকাঙ্ক্ষা প্রবল। চামড়ার বিশ্ব বাজারের ৬০ শতাংশই দখলে রাখছে চীন। ২০ শতাংশ ইটালির, ১০ শতাংশ ভারতের, ৭ শতাংশ বাংলাদেশের। বাকী দেশসমূহ মিলেমিশে চামড়াকে লুটেপুটে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে থাকে।

শিল্প বিপ্লবের সূচনাতে ইতালির তুসকানি প্রদেশের রাজধানী ফ্লোরেন্সে প্রতিষ্ঠা করা হয় তুসকানি লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট। ডিপ্লোমা ইন লেদার টেকনোলজিস্টরা ইতালির তুসকানি প্রদেশের রাজধানী ফ্লোরেন্সে দীর্ঘকাল যাবৎ বিভিন্ন চামড়ার পণ্য প্রস্তুত করে আসছে। ভারতের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শহর কানপুরে রয়েছে বৃহৎ চামড়ার বাজার। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকাকালে ব্রিটিশ সৈনিকদের চামড়ার জুতা, রাইফেলের ফিতাসহ নানা পণ্য এখান থেকে তৈরি করা হতো।

তৎকালিন ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে ১৯০৫ সালে ইতালির তুসকানি লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের আদলে কানপুরে লেদার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। এরপর পাকিস্তান সরকার ১৯৫৫ সালে ঢাকার হাজারীবাগে ইস্ট পাকিস্তান লেদার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। মাত্র ১৫ বছরে ডিপ্লোমা ইন লেদার টেকনোলজিস্টদের নিরলস প্রচেষ্টায় হাজারীবাগে ২১৭টি লেদার কারখানা গড়ে ওঠে। হাজারীবাগ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম চামড়ার বাজারে পরিণত হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে এক অজানা রহস্যের কারণে হাজারীবাগের এদেশের একমাত্র লেদার ইনস্টিটিউট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ডিপ্লোমা ইন লেদার টেকনোলজিস্টদের অভাবে দেশের চামড়া শিল্পের অধঃপতন ঘটতে থাকে। প্রশিক্ষিত প্রযুক্তি দক্ষ জনবল সংকটে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি।

চামড়া খাতে সামনের দিনগুলোতে দেশীয় চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বিদেশি অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের অবকাঠামোগত সমস্যা আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অথচ চামড়াজাত শিল্পের প্রধান কাচাঁমাল চামড়া দেশের সব স্থান থেকে সারাবছরই সংগ্রহ করা হয়। তবে প্রতিবছর যে পরিমাণ চামড়ার প্রয়োজন হয় তার ৫০-৫৫ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় ঈদুল আজহার সময়। সচেতনতা ও পেশাদারিত্বের অভাবে শুধু কোরবানির ঈদ মৌসুমে ৩ হাজার কোটি টাকার চামড়া নষ্ট হয়।

ভিশন-২০২১ এর মধ্যে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা আয়ের  যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার তা বাস্তবে পরিণত করতে দরকার বিপুল সংখ্যক ডিপ্লোমা লেদার প্রযুক্তিবিদ। এক্ষেত্রে ৮টি বিভাগে সরকারিভাবে ৮টি এবং বেসরকারিভাবে ২০ থেকে ৩০টি লেদার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবী। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লেদার টেকনোলজিস্টগণ তাদের পেশাগত দায়িত্ব নিয়েই ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

লেখকদ্বয়-সভাপতি  ও মহাসচিব, ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ। Khanaranjanroy@gmail.com