চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ কাট্টলীতে রয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী এক পল্লী। য়েখানে রয়েছে ৩ টি পাড়া। প্রতিটি পাড়ায় রয়েছে ৪ টি করে বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে থাকে একটি করে পরিবার। এই পল্লীর নাম ‘এস ও এস শিশু পল্লী’।
নগরীর দক্ষিণ কাট্টলীতে ১৯৮৯ সালের ১২ জানুয়ারি শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় এস ও এস শিশু পল্লী। ৭০ জন শিশু নিয়ে প্রায় ৩ একর জায়াগার উপর স্থাপন করা হয়েছে এই প্রকল্প। শিশু পল্লীর ১২ টি বাড়ির প্রত্যেকটিতে রয়েছে অত্যাধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন। প্রতিটি বাড়িতে ১ জন মা ৮–১০ জন শিশুকে লালন–পালন করেন।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ধারণ করে পাড়া এবং বাড়ির নামকরণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের বিখ্যাত আউলিয়া, পাহাড় ও দ্বীপের নামের সাথে মিল রেখেই পাড়ার নামকরণ। এ তিনটি পাড়াগুলোর নাম হচ্ছে আউলিয়া পাড়া, দ্বীপ পাড়া ও পাহাড় পাড়া। আউলিয়া পাড়ায় রয়েছে হযরত শাহ্ আমানত বাড়ি, হযরত শাহ্ জালাল বাড়ি, হযরত বায়েজিদ বাড়ি ও হযরত শাহ্ আব্দুল আজিজ বাড়ি। দ্বীপ পাড়ায় রয়েছে উরির চর বাড়ি, মহেশখালী বাড়ি, কুতুবদিয়া বাড়ি ও সোনাদিয়া বাড়ি। পাহাড় পাড়ার মধ্যে রয়েছে লুসাই বাড়ি, দেয়াং বাড়ি, চিম্বুক বাড়ি ও বাটালি বাড়ি। নগরীর এই শিশু পল্লীতে যারা এসেছেন তাদের কারো মা নেই, কারো বাবা নেই। আবার কারো বাবা–মা উভয়ই নেই। আমাদের সমাজের দৃষ্টিতে এরা এতিম কিন্তু এখানে প্রকৃত এতিমের ছোঁয়া এদের নেই।
বাবা–মায়ের যত্ন হারানো সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মায়ের কোলে তুলে দিতে বিকল্প এক ক্ষেত্র তৈরি করছেন অস্ট্র্রিয়ার নাগরিক প্রফেসর হারম্যান মেইনার।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি এস ও এস শিশু পল্লীর ছেলে মেয়েরা সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, অভিনয়, ড্রইং, সেলাই প্রশিক্ষণ, রান্না কোর্স, ইসলামী শিক্ষা, স্পোকেন ইংলিশ কোর্স, কম্পিউটার শিক্ষা কোর্স, সাতাঁরসহ অন্যান্য কোর্সের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এছাড়াও গার্লস গাইড, হলদে পাখি, কাব স্কাউট কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে।
প্রতিটি বাড়িতে প্রতিদিন রান্না হয় উন্নত মানের খাবার। প্রত্যেকটি বাড়িতে রয়েছে ডাইনিং টেবিল, ফ্রিজ, টেলিভিশন, উন্নতমানের খাট, কম্পিউটার, সোফা সেট, সাইকেল ও বিভিন্ন খেলার সামগ্রী। অর্থাৎ একটি আধুনিক পরিবারে যা যা থাকে সব কিছু রয়েছ এই শিশুপল্লীতে।
হযরত বায়েজিদ বাড়িতে গেলে দেখা হয় শিশুপল্লীর সবচেয়ে প্রবীণ মা সুফিয়া খাতুনের সাথে। তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, “ এই শিশুপল্লী প্রতিষ্ঠালগ্ন থকে প্রায় ২৯ বছর ধরে বায়েজিদ বাড়িতে মায়ের দায়িত্ব পালন করে আসছি। এখানে আমার ৭ বাচ্চা রয়েছে, সবাই অত্যন্ত মেধাবী ও ভদ্র”।
বায়েজিদ বাড়ির বড় মেয়ে নাহিদা আক্তারের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা তিন বোন (আপন) এই বাড়িতে থাকেন। নাহিদা, শাহিদা ও চায়না। নাহিদা ও শাহিদা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছে। জেএসসি পরীক্ষায় দু’জনই জিপিএ– ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।
কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলে অনেকগুলো মেডেল চোখে পড়ে। মেডেল গুলো কার প্রশ্ন করতেই নাহিদা মুচকি হেসে বলে, মেডেলগুলো সব সে এবং শাহিদা পেয়েছে। নাহিদা ব্যাডমিন্টন ও শাহিদা ক্রিকেটে খুব ভালো। তারা দু’জনই স্কুল থেকে জাতীয় পর্যায়ে খেলে এই মেডেলগুলো অর্জন করেছে।
এস ও এস শিশুপল্লী চট্টগ্রাম প্রকল্পের পরিচালক ফয়জুল কবির জানান, শিশু ভর্তি নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের শর্ত হচ্ছে বয়স হতে হবে শূন্য থেকে পাঁচ বছর। যদি আপন ভাইবোন হয় এবং সে ক্ষেত্রে একজনের বয়স পাঁচ বছরের কম এবং অন্য জনের বয়স আট বছর পর্যন্ত হলেও আমরা নিয়ে থাকি। যাতে তারা মানসিক ভাবে ভালো থাকে। বর্তমানে আমাদের ৯৩ জন শিশু রয়েছে।
আধুনিক সুবিধাসম্বলিত একটি প্রাইমারি স্কুল রয়েছে এস ও এস শিশু পল্লীর কম্পাউন্ডে । তবে ক্লাস ফোর–ফাইভ থেকে সরকারি– বেসরকারি বিভিন্ন ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর চেষ্টা করেন কর্তৃপক্ষ। সেজন্য তাদের কোচিং, টিউটরেরও ব্যবস্থা করে থাকেন। বর্তমানে মুসলিম হাই স্কুলে পাঁচ জন, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে আট জন, গরীবে নেওয়াজ স্কুলে ২৫ জন, সিটি গার্লস স্কুলে একজন ও সিলভার বেলস স্কুলে দু’জন শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে।
১৩ বছর পর্যন্ত ছেলেরা এই শিশু পল্লীতে থাকতে পারে। ১৪ বছর থেকে তাদের যুব পল্লীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে মেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা পর্যন্ত এখানে থেকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হলে মেয়েদের হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতে হয়। তবে ছেলে– মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশুনার খরচ শিশু পল্লী কর্তৃপক্ষ বহন করে থাকে। বাংলাদেশের তৎকালীন শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয় এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ১৯৭২ সালের ১৭ মে ঢাকার মিরপুরে প্রথম এস ও এস শিশু পল্লী স্থাপিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও সিলেটে শিশু পল্লী রয়েছে। ছিন্নমূল, অসহায়, পিতৃমাতৃহীন শিশুদের পারিবারিক পরিবেশে মায়ের ভালোবাসা ও আদর যত্নে লালন–পালন করে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই শিশু পল্লী স্থাপন করেন হারম্যান মেইনার। বর্তমানে বিশ্বের ১৩৫ টি দেশে এই শিশু পল্লীর প্রকল্প চালু আছে। যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ছাত্র-ছাত্রীরাও নিজেদের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে দান করছেন এসব শিশুদের জন্য ।